Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

#মিটু: প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নারী যৌন পীড়নের শিকার

২০০৬ সালে #মিটু আন্দোলন শুরু হলেও ২০১৭-র ১৫ অক্টোবর সামাজিক মাধ্যমে তা ভাইরাল হয়। লক্ষ লক্ষ মহিলা নিজেদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। লিখছেন মিমি সরকারঅতি সাম্প্রতিক কালে বিশ্বের সর্বত্র বহু আলোচিত এবং আলোড়িত একটি চর্চা হল #মিটু মুভমেন্ট। সর্বপ্রকার যৌন নিপীড়ন, যৌন হেনস্থা এবং যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে প্রধানত সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল এক নারী আন্দোলন।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০১৮ ০২:০০
Share: Save:

অতি সাম্প্রতিক কালে বিশ্বের সর্বত্র বহু আলোচিত এবং আলোড়িত একটি চর্চা হল #মিটু মুভমেন্ট। সর্বপ্রকার যৌন নিপীড়ন, যৌন হেনস্থা এবং যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে প্রধানত সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল এক নারী আন্দোলন। সম্প্রতি ভারত-সহ বিশ্বের প্রায় ৮৫টি দেশে #মিটু আন্দোলন স্ফুলিঙ্গের আকার ধারণ করেছে। যা অন্য সব আন্দোলনের চেয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। সমাজের সব ক্ষেত্রে, বিশেষত, কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের প্রতি অবমাননাকর আচরণের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে অক্টোবর মাসের ১৫ তারিখে মার্কিন অভিনেত্রী আলিসা মিলানো একটি হ্যাশট্যাগ মিটু নাম দিয়ে প্রচার শুরু করেন। টুইটারের মাধ্যমে জনসমক্ষে আসার এক দিনের মধ্যেই যা দু’লক্ষ বার ব্যবহৃত হয়। মিলানো এবং তাঁর সহযোগী মাইকেল বাকের সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যৌন হেনস্থার শিকার সব স্তরের মহিলাদের, তাঁদের সঙ্গে ঘটা ঘটনা প্রকাশ্যে আনতে অনুরোধ করেন। এই ডাকে সাড়া দিয়ে হলিউড সেলিব্রিটি গিনেথ প্যালট্রো, আসলি জোর্ড, জেনিফার লরেন্স প্রমূখ নিজেদের কথা টুইট করে জানাতে থাকেন।

যদিও এই আন্দোলনের সূত্রপাত ২০০৬ সালে মার্কিন সমাজকর্মী তারানা বারকের হাত ধরে। এই সময়ে #মিটু নামে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করে মাই স্কেপ সোশ্যাল নেটওয়ার্কে তুলে ধরেছিলেন। ১৩ বছর বয়সী এক বালিকা তার প্রতি হওয়া যৌন নির্যাতনের অভিজ্ঞতার কথা তারানাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তৎক্ষণাৎ কিছু করতে না পারলেও তারানা প্রতিক্রিয়ায় মেয়েটিকে শুধু জানিয়েছিলেন #মিটু, অর্থাৎ ‘আমিও’। এবং তার হাত ধরেই শুরু হয় ‘এম্পাওয়ারমেন্ট থ্রু এমপ্যাথি’ অর্থাৎ, কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের সহানুভূতির আদর্শের দ্বারা ক্ষমতা প্রদান। বারকে উল্লেখ করেন, এ ক্ষেত্রে নির্যাতিতা কখনওই একা নন এবং তাঁর লজ্জিত হবার কোনও কারণ নেই। কারণ, যৌন নির্যাতন নির্যাতিতার প্রতি অন্য কারও দ্বারা সংঘটিত হয়। তিনি দেখিয়েছেন, প্রায় ৭০ হাজার মহিলা, যাঁরা সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে কৃষিক্ষেত্র এবং ফার্মে কাজ করে দিনাতিপাত করেন, তাঁরা কীভাবে দিনের পর দিন বর্ণবৈষম্য এবং যৌন নির্যাতনের শিকার। কিন্তু পরিবারের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের তাগিদে তাঁরা অভিযোগ প্রকাশ্যে আনতে পারেন। এবং প্রতিনিয়ত ম্যানপাওয়ার এবং মাসেল পাওয়ার দ্বারা ভীতিপ্রদর্শনের ফলে ঘটনার অভিঘাত, দোলাচল থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, তিনি অভিনেত্রী, মডেল-সহ অন্য কর্মক্ষেত্রে নিযুক্ত মহিলারা কী ভাবে লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার, তা-ও প্রকাশ্যে এনেছেন।

যাই হোক, ২০০৬ সালে #মিটু আন্দোলন শুরু হলেও ২০১৭ সালের ১৫ অক্টোবর সামাজিক মাধ্যমে #মিটু আন্দোলন ভাইরাল হয়। লক্ষ লক্ষ মহিলা তাঁদের নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। হলিউড, সংগীত জগৎ থেকে শুরু করে বিজ্ঞান, শিক্ষা, রাজনীতি, বাণিজ্য, ক্রীড়া, ধর্মীয় ক্ষেত্র, শিশুরা, এমনকি সেনাবাহিনীর ঘটনাও এই আন্দোলনের মাধ্যমে প্রকাশ্যে আসে। শুধুমাত্র ২০১৬ সালেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৫ হাজার মহিলা সেনা কর্মীর উপর নির্যাতনের ঘটনা পেন্টাগন তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে। এই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হিসাব করে দেখিয়েছে, সমগ্র বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নারী কোনও না কোনও ভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার। এবিসি নিউজ এবং দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট তাদের একটি সমীক্ষায় দেখিয়েছে, ৫৪ শতাংশ মার্কিন মহিলা তাঁদের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের কথা স্বীকার করেছেন। যার মধ্যে ৯৫ শতাংশ অভিযোগের কোনও বিচারই হয়নি। যা সত্যিই এক মারাত্মক অভিযোগ।

২০১৭ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৮-র অক্টোবর এই এক বছরে #মিটু আন্দোলন বিশ্বের ৮৫টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। যার মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, আরব, ইজরায়েল, ব্রিটেন, ইটালি, ফ্রান্স, স্পেন, রাশিয়া, চিন, জাপান, কোরিয়া, ভিয়েতনাম উল্লেখযোগ্য। এমনকি এই সব দেশের পার্লামেন্টেও #মিটু আন্দোলন নিয়ে জোরদার আলোচনা হয়েছে। এবং নারী নিগ্রহের সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত রকম আইন বিষয়ে নতুন করে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। মার্কিন সেনেটর হেইডি হেট ক্যাম্প, ম্যেজি হিরোনো, এলিজাবেথ ওয়ারেন প্রমূখ যৌন নির্যাতনের কথা সামনে নিয়ে এসেছেন। মার্কিন কংগ্রেসে ১৯৯৫ সালের কংগ্রেশনাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি অ্যাক্ট-এর সংশোধনী উত্থাপিত হয় এবং মিটু কংগ্রেস নামে তা পাস হয় #মিটু আন্দোলনের ফলস্বরূপ।

ভারতে আজকের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বিশ্লেষণ করলে #মিটু আন্দোলন এই মুহূর্তে ভীষণ ভাবে প্রাসঙ্গিক। উল্লেখ্য, ভারতে যৌন হয়রানি বা যৌন আক্রমণকে ইভটিজিংয়ের নাম দেওয়া হয়ে থাকে। যাতে এই অপরাধের বিচারকে সহজেই ভুল পথে পরিচালিত করা, নিস্তেজ করা, দুর্বল করা বা দমন করা যায়। কারণ, লিঙ্গ হিসাবে এখনও মহিলাদের পুরুষের সমকক্ষ করে গড়ে তোলা যায়নি। কিন্তু #মিটু আন্দোলন ভারতীয় মহিলাদের তাদের কর্মক্ষেত্রের অধিকার ও নিরাপত্তা সম্পর্কে ভাবতে শেখাচ্ছে। এবং পুরুষদেরও এই বিষয়ে সচেতন হতে শিক্ষা দিচ্ছে বলা যায়।

২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর সমাজকর্মী ইনজি পেনু এবং রায়া সরকার নামের ক্যালিফোর্নিয়াবাসী এক জন ভারতীয় ছাত্রী সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর বন্ধুদের উদ্দেশ্যে ৬০ জন উচ্চশিক্ষিত এবং শিক্ষক হিসেবে প্রশংসিত প্রফেসর এবং শিক্ষকের নামের তালিকা প্রকাশ করে তাঁদেরকে এড়িয়ে চলতে পরামর্শ দেন। সতর্কীকরণ হিসেবে পোস্ট করা হলেও দ্রুত তা ভাইরাল হয় এবং সম্ভবত এখান থেকেই ভারতে মিটু আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।

সীতানগর স্কুলের বাংলার শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

MeToo Sexual harassment মিটু
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE