Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

ঘুমন্ত শিশুকে বাড়িতে রেখে কাজে বেরোন অর্পিতা

দাঁড়িয়ে থাকার বিলাসিতা তাঁর চলে না। এক ছুটে গিয়ে গেট তুলতে হয় তাঁকে। তারপরেও অবশ্য অবসর মেলে না। বৈদ্যুতিন বোর্ডে চোখ রেখে দেখতে হয় কোন ট্রেন ঢুকছে। তার সিগন্যালও যে তাঁকেই দিতে হবে। সামান্য ভুলচুক হলেই সর্বনাশ।

কর্তব্যরত: অর্পিতা ঘোষ। নিজস্ব চিত্র

কর্তব্যরত: অর্পিতা ঘোষ। নিজস্ব চিত্র

সুপ্রকাশ মণ্ডল
শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৯ ০৫:২৩
Share: Save:

মুখে হুইস্‌ল, হাতে পতাকা। লাইনের ধারে দাঁড়িয়ে তিনি। ট্রেন ছুটছে। ট্রেন বেরোতে না বেরোতে তাঁকেও ছুটতে হয়।

দাঁড়িয়ে থাকার বিলাসিতা তাঁর চলে না। এক ছুটে গিয়ে গেট তুলতে হয় তাঁকে। তারপরেও অবশ্য অবসর মেলে না। বৈদ্যুতিন বোর্ডে চোখ রেখে দেখতে হয় কোন ট্রেন ঢুকছে। তার সিগন্যালও যে তাঁকেই দিতে হবে। সামান্য ভুলচুক হলেই সর্বনাশ।

সকাল থেকে দুপুর তাই অক্লান্ত অর্পিতার দৃষ্টি সজাগ। অর্পিতা ঘোষ পলতার ১৮ নম্বর রেলগেটের ‘গেট-উওম্যান’। রেলের খাতায় তাঁর অবশ্য পরিচয় ‘লেডি গেটম্যান’। বাবার ছেড়ে যাওয়া চাকরি করছেন তিনি। যেহেতু তাঁর বাবা গেটম্যান ছিলেন, তাই তিনি অন্য কোনও পদে সুযোগ পাননি। তবে তাতে পিছিয়ে যানিনি তিনি। চ্যাল্যেঞ্জ নিয়ে পার করে দিয়েছেন সাত নারী দিবস। রোজ ভোরে দেড় বছরের ঘুমন্ত ছেলেকে বাড়িতে রেখে ডিউটিতে বেরোন অর্পিতা। ফিরে সংসার সামলান।

অবসরের আগেই অর্পিতার বাবা, নৈহাটির বিজয়নগরের বাসিন্দা গৌতম ঘোষ স্বেচ্ছাবসর নিয়েছিলেন। অর্পিতা তখন সবে মাধ্যমিক পাশ করেছেন। অর্পিতা জানান, সেই সময়ে রেল বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল, অসুস্থতা বা অন্য কারণে যাঁরা স্বেচ্ছাবসর নিচ্ছেন, তাঁরা ২০ বছর চাকরি করে থাকলে, সেই চাকরি তাঁদের ছেলে-মেয়েরা পেতে পারে।

এই নির্দেশের পরেই চাকরির জন্য আবেদন করেন, অর্পিতা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে চাকরি মেলেনি। অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও আড়াই বছর। প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়ার পরেই তাঁকে ডাকে রেল। জানানো হয়, লেডি গেটম্যানের চাকরি পেতে পারেন তিনি। তিনি রাজি কিনা? দ্বিধা থাকলেও রাজি হয়ে যান তিনি। প্রথমে প্রশিক্ষণ, তার পরে গেট সামলানোর কাজে পাঠানো হয় তাঁকে।

অর্পিতা বলেন, ‘‘সাত বছর আগে যখন কাজে যোগ দিই, তখন হাতল ঘুরিয়ে গেট তুলতে-নামাতে হত। তাতে শারীরিকভাবে যথেষ্ট সক্ষম থাকতে হত। বছরখানেক হল মোটর চালিত গেট চালু হয়েছে।’’

শিয়ালদহ-নৈহাটি মেন লাইন অত্যন্ত ব্যস্ত। অর্পিতা জানান, দু’টি আপ এবং দু’টি ডাউন লাইনে অনবরত ট্রেন চলাচল করে। ফলে সবসময় সজাগ থাকতে হয়।

রেলের গেট সামলানোর দায়িত্ব বরাবরই ছিল পুরুষদের। রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, তার কারণও রয়েছে। রেলগেট খোলা থাকার কারণে প্রচুর দুর্ঘটনা ঘটে, আবার রেলগেট বন্ধ থাকা নিয়েও গোলমাল হয়। সবক্ষেত্রেই গেটরুমে হামলা হয়। অর্পিতা কিন্তু মুন্সিয়ানার সঙ্গে দায়িত্ব সামলাচ্ছেন।

শুধু গেট সামালানোই নয়, অর্পিতার একটি বাড়তি দায়িত্বও রয়েছে। ট্রেন আসার আগে সিগন্যালও তাঁকেই দিতে হয়। অন্যান্য জায়গায় এই দায়িত্ব থাকে স্টেশন মাস্টার বা কেবিনম্যানের উপরে।

তাঁর কাজ কতটা কঠিন?

অর্পিতা বলেন, ‘‘উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগাতে হয় সব সময়ে। হয়তো ট্রেন আসছে, এ দিকে গেটের সামনে মুমুর্ষু রোগী নিয়ে অ্যাম্বুল্যান্স হাজির। তখন অন্য গাড়ি আটকে রেখে শুধুমাত্র অ্যাম্বুল্যান্সের জন্য গেট খুলে দিতে হয়।’’ এই সিদ্ধান্ত যথেষ্ট কঠিন বলে মনে করেন তিনি। তবে কর্তৃপক্ষ তাঁর কাজে যথেষ্ট সাহায্য করেন। তাঁকে শুধু সকালের শিফটেই ডিউটি দেওয়া হয়।

শুধু চাকরিই নয়, এরই মধ্যে নৈহাটি ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র কলেজের সান্ধ্য বিভাগ থেকে স্নাতক হয়েছেন অর্পিতা। বিয়ে করেছেন নৈহাটিরই ছেলে রাজু সরকারকে। রাজু বেসরকারি সংস্থার কর্মী। সেখানে শ্বশুর-শাশুড়ি, বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা, ছোট ছেলে। ঘর সামলে, বাচ্চা-বুড়ো সামলে ছুটছেন অর্পিতা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

International Women's Day Indian Railway
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE