Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

বাইক-বাহন বীরাঙ্গনার লড়াই জারি

কুন্তীর বাবা ফণী গড়াই বলেন, ‘‘জমি জমা নেই। ধারদেনা করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলাম। মেয়েটাই সমস্ত কিছু করে। ও-ই সংসারটা চালায়।’’

কুন্তী গড়াই। নিজস্ব চিত্র

কুন্তী গড়াই। নিজস্ব চিত্র

সমীর দত্ত 
কেন্দা শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৯ ০৬:১২
Share: Save:

মস্ত বড় দু’টো ঝোলা। এক একটার ভিতরে অন্তত পনেরো কেজি করে আনাজ আছে। শসা, টোম্যাটো, গাজর— এই সব। কথা বলতে বলতেই তুলে মোটরবাইকের হাতলে ঝুলিয়ে দিলেন কুন্তী। পা রাখার জায়গাটায় বস্তার মধ্যে আলু। কম করে হলেও আধ কুইন্টাল ওজন হবে। পিছনে ঝোলায়, বস্তায় আরও নানা কিছু। সবটা নিয়ে দু’চাকায় পুরুলিয়ার হাট চষে বেড়ান কেন্দার কুন্তী গড়াই।

বয়স বছর তিরিশেক। মানবাজার, জিতুঝুড়ি, গোপালনগর, কেন্দার লোকজনের কাছে তাঁর হেলমেট পরা মুখটা বেশ পরিচিত। কুন্তীর রোজগারেই চলে সংসার। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা। স্কুলে পড়া ছেলে। কুন্তীকে কেউ জায়গা ছেড়ে দেয়নি। ১৭ বছরে বিয়ে। জানাচ্ছেন, বর্ধমানের মাল্লারপুর গ্রামে ছিল শ্বশুরবাড়ি। বিয়ের তিন মাসের মাথায় অসুখে ভুগে স্বামী মারা যান। গর্ভে সন্তান নিয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন বাপের বাড়িতে।

কুন্তীর বাবা ফণী গড়াই বলেন, ‘‘জমি জমা নেই। ধারদেনা করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলাম। মেয়েটাই সমস্ত কিছু করে। ও-ই সংসারটা চালায়।’’ মা শিবানী গড়াইয়ের মনে পড়ে, বাড়ি আসার কয়েক মাস পরে ছেলের জন্ম দিয়েছিলেন কুন্তী। সেই ছেলেও এখন হাইস্কুলে উঠে গেল।

বছর আঠারোর তরুণী তিনি তখন। পদে পদে নানা বাধা। নানা ভয়। নানা হয়রানি। কুন্তী লড়ে গিয়েছেন। বলছিলেন, ‘‘ছেলেটার ছ’মাস বয়সে কঠিন অসুখ করেছিল। হাতে টাকা নেই। বাবার হাতেও না।’’ সোনার কানের দুলটা বেচে দিয়ে পাঁচশো টাকা পেয়েছিলেন। চিকিৎসায় খরচ হয়েছিল শ’তিনেক। বাকিটা নিয়ে পড়শির সাইকেল ধার করে বেরোন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে দুশো টাকায় আতা কেনেন। বাসে চড়ে পুরুলিয়া শহরে গিয়ে কিছু টাকা লাভ হয়েছিল।

তখন গ্রামেগঞ্জে ৪-৫ টাকায় পেঁপে মিলত। কয়েক বস্তা কিনে পরের দিন সকাল সকাল চলে গিয়েছিলেন পুরুলিয়ার আড়তে। দশ টাকা করে বিক্রি করে আবার কিছু টাকা লাভ হল। এ ভাবেই শুরু। প্রথমে একটা ভ্যানে আনাজ নিয়ে কাছের হাটে যেতেন। হাতে কটা টাকা জমা হতে কিনে নেন পুরনো মোটরবাইক।

মানবাজার কিসান মান্ডির পাইকারি আনাজ বিক্রেতা নিমাই মোদক, টিঙ্কু দত্তরা বলেন, ‘‘কুন্তী প্রায় এক দশক ধরে আনাজের ব্যবসা করছেন। গ্রাম থেকে আনাজ নিয়ে এসে এখানে বিক্রি করেন। আবার গ্রামে যে আনাজ মেলে না, সেগুলো নিয়ে যান।’’ কুন্তী জানাচ্ছেন, ব্যবসার জন্য ব্যাঙ্ক থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিল। কোনাপাড়া, তালতল, পাথরকাটা, জামবাইদের মতো বিভিন্ন ছোট-বড় হাটে ঘুরে যা লাভ হয়েছে, সেটার থেকে ঋণ শোধ হয়ে গিয়েছে।

ঝামেলায় পড়েননি কখনও? ‘‘ঝামেলা বলতে ঝামেলা’’, বলেন কুন্তী, ‘‘এক বার ভিন্ গাঁ থেকে ফিরছি। ক’টা মাতাল ছেলে পথ আটকে দাঁড়াল। অশালীন সব ইঙ্গিত করছিল। আমি সটান ওদের উপর দিয়েই বাইক চালিয়ে দিই। ভয়ে ছিটকে যায়।’’ এক জন শাড়ির আচল টেনে ধরতে মারেন এক লাথি। কুন্তী বলেন, ‘‘ক্ষমা চেয়েছিল বলে থানায় যাইনি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

International Women's Day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE