Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

কলম বলবে নারীর কথা, তাতেও যে আসে কত বাধা

এখনও কতটা ‘পরাধীন’ এ দেশের মেয়েরা? নিজের কথা বলার অধিকার আদৌ আছে কি তাঁদের? কতটা ক্ষমতা হাতে পান তাঁরা? আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আগে বৃহস্পতিবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘উইমেন্স কনক্লেভ’ অনুষ্ঠানের আলোচনাচক্রে বারবার ঘুরে এল এ সব প্রশ্নই।

স্বাতী মল্লিক
শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৯ ০১:৪৭
Share: Save:

এখনও কতটা ‘পরাধীন’ এ দেশের মেয়েরা? নিজের কথা বলার অধিকার আদৌ আছে কি তাঁদের? কতটা ক্ষমতা হাতে পান তাঁরা? আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আগে বৃহস্পতিবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘উইমেন্স কনক্লেভ’ অনুষ্ঠানের আলোচনাচক্রে বারবার ঘুরে এল এ সব প্রশ্নই।

‘হার লাইফ, হার স্টোরি: ডকুমেন্টিং উইমেন্স লাইভস’ শীর্ষক আলোচনাচক্রে লেখক-গবেষক কোটা নীলিমা যেমন সাফ জানালেন, এ দেশে মেয়েদের নিয়ে লেখালেখি করা সম্ভবই নয়! কারণ তাঁর বক্তব্য, ‘‘পিতৃতান্ত্রিক সমাজ আজও মেয়েদের কুক্ষিগত করে রেখেছে। তা সেই মেয়ে গ্রাম্য-শহুরে, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, নিজের পায়ে দাঁড়ানো বা পরনির্ভরশীল— যা-ই হন।’’ তাই তো আজও বাইরের দুনিয়ায় পা রাখতে গেলে অনুমতি নিতে হয় মেয়েদের।

এ দেশের নারীদের কথা লেখা কতটা শক্ত? কাশ্মীরি লেখক এবং অধ্যাপক শাহনাজ় বশির শুনিয়েছেন তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা। কাশ্মীরের পটভূমিকায় লেখা তাঁর বই ‘দ্য হাফ মাদার’ এক মায়ের গল্প। দিনের পর দিন কোর্টকাছারি থেকে শুরু করে হাসপাতাল-মর্গে যিনি চক্কর কাটেন নিজের ‘নিখোঁজ’ ছেলেকে ফিরে পেতে। শাহনাজ়ের কথায়, ‘‘প্রকাশক লেখাটা পড়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনি ওই মহিলার যৌন দিকটা তো এক বারও লিখলেন না!’’ অর্থাৎ, মেয়েদের যৌনতাটাই যেন একমাত্র বিক্রয়যোগ্য! প্রায় একই অভিজ্ঞতা নীলিমারও। আত্মঘাতী চাষিদের স্ত্রীদের নিয়ে সম্প্রতি বই লিখেছেন তিনি। ‘উইডোস অব বিদর্ভ, মেকিং অব শ্যাডোস’ নামে ওই বইয়ের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ‘‘ওঁদের প্রশ্ন করতে গেলে গ্রামের অনেকের কাছে শুনতে হয়েছে, ওঁরা তো মেয়ে, ওঁদের রান্নাঘর-ঘরের কাজ নিয়ে প্রশ্ন করুন। চাষবাস, সার, কৃষিঋণ, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া— এ সব নিয়ে ওঁরা কী বলবেন!’’ অথচ কী কারণে, কতটা জীবনযুদ্ধের পরে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আত্মহত্যার রাস্তা বেছে নিয়েছেন ওই কৃষকেরা, তার সবটা জানেন শুধু তাঁদের স্ত্রীরাই। কিন্তু সমাজ-রাষ্ট্রের চোখে সেই মহিলারা ‘অদৃশ্য’।

মেয়েদের কথা বলতে গিয়ে বারবার প্রশ্নের মুখে পড়েছেন দিল্লির সাংবাদিক নেহা দীক্ষিতও। তিনি জানালেন, ২০১৩ সালে মুজফ্‌ফরাবাদে হিংসার সময়ে একটি গ্রামের মোড়লের বাড়িতেই ১৯ জন মহিলার গণধর্ষণের খবর লিখেছিলেন তিনি। তাঁর খেদোক্তি, ‘‘লেখাটা জমা দেওয়ার পরেই সেটা আটকে দিয়ে আমার কাছে ওই মহিলাদের ফোন নম্বর চাওয়া হয়। বলা হয়েছিল, আগে খতিয়ে দেখতে হবে সত্যি সত্যিই তাঁদের সঙ্গে এমনটা হয়েছে কি না। কতটা সংবেদনশীলতার অভাব ভাবুন!’’

তবে কি পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ধ্বজাধারী শুধু পুরুষেরাই, উঠেছে প্রশ্ন। মহিলাদের একঘরে করে রাখার এই যুগের আগে সমাজে মহিলাদের অবস্থান ভাল ছিল কি না, সেই প্রশ্নও তুলছেন অনেকে। উত্তরে কখনও এসেছে ধর্ম-জাতপাত, কখনও নারী-নিগ্রহের প্রসঙ্গ। শবরীমালা-বিতর্কের পরে মন্দির ছুঁয়ে আসা কনকদুর্গাকে যে ভাবে হেনস্থা করেন তাঁর শাশুড়ি, তা পিতৃতন্ত্রের প্রভাবেই। মহিলাদের যৌনাঙ্গের চর্মকর্তন (ফিমেল জেনিটাল মিউটিলেশন) প্রথা নিয়ে কাজ করা, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দেবাঙ্গনা চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, কথা বলতে গিয়ে তিনি দেখেছেন, ধর্ম ও বিশ্বাসের প্রভাবে এই প্রথা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন না অধিকাংশ মহিলাই।

তবে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে থেমে না গিয়ে লড়াই করার মন্ত্রই হাতে তুলে দিচ্ছেন বক্তারা। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক তথা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা রিমি চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘আমরা কার সঙ্গে থাকতে চাই, বাঁচতে চাই, সেটা ঠিক করার স্বাধীনতাটুকুও যদি পাই, তবে দু’প্রজন্ম পরে হয়তো এ দেশে জাতপাত, ধর্মের নামগন্ধ থাকবে না। সেই দিনের আশাতেই লড়াই চলুক।’’ হোক লড়াই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

International Women's Day Moden Literature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE