হারানো বিমানের সন্ধানে মার্কিন রণতরী। ছবি: এপি।
প্রায় সাড়ে বাইশ লক্ষ বর্গ নটিক্যাল মাইল বিস্তৃত এলাকা জুড়ে এ বার খোঁজ় চলবে নিখোঁজ এমএইচ ৩৭০-এর। মঙ্গলবারের সাংবাদিক সম্মেলনে এমনই জানালেন মালয়েশিয়ার পরিবহণ মন্ত্রী হিশামুদ্দিন হুসেইন।
নতুন সূত্র বলতে দু’টি। মলদ্বীপের একটি প্রত্যন্ত দ্বীপের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, বিমানটি রাতে নিখোঁজ হওয়ার পরদিন সকালবেলায় একটি বিমান উড়ে যেতে দেখেছিলেন তাঁরা। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের মতোই ওই ধবধবে সাদা বিমানটির গায়ে লাল ছোপ ছিল। ওঁরা জানিয়েছেন, এত নিচু দিয়ে কোনও বিমান উড়ে যেতে এর আগে কখনও দেখেননি। ঢাউস বিমানটির দরজাগুলো অবধি মাটি থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।
আর তাইল্যান্ড বায়ুসেনা জানিয়েছে, ঘটনার দিন রাতে তাদের রেডারে একটি যাত্রী-বিমান ধরা পড়েছিল। হতে পারে, সেটিই এমএইচ ৩৭০। মালয়েশিয়ার সামরিক রেডারে এমএইচ ৩৭০-কে মালাক্কা প্রণালীতে দেখা গিয়েছিল। তাই বায়ুসেনার রেডারও মালাক্কা প্রণালীর কথাই বলছে। এত দিন পরে তারা মুখ খুলল কেন? তাই সেনার বক্তব্য, বিষয়টিকে তারা গুরুত্ব দেয়নি। তাদের কাছে কেউ কিছু জানতেও চায়নি।
এত দিন ধরে এত জটের পরেও যে তথ্যের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে, সব পক্ষ যে সব কথা জানাচ্ছে না এ দিনের পর সেই সন্দেহ আরও দানা বাঁধছে। বিশেষত মালয়েশিয়ান বিমানের ইঞ্জিন প্রস্তুতকারক সংস্থা রোলস রয়েসের কাছে ইঞ্জিন চালু-বন্ধের সমস্ত খুঁটিনাটি তথ্য রেকর্ড হয়। নিখোঁজ বিমানটির ইঞ্জিন ঠিক কখন বন্ধ হয়েছিল, তা-ও জানার কথা ওই সংস্থার। অথচ সংস্থার তরফে দাবি করা হয়েছে, এ বিষয়ে মন্তব্য করা হবে না। সন্দেহ তাই বাড়ছেই। অবিলম্বে আসল তথ্য না জানালে অনশনে বসার হুমকি দিয়েছেন চিনের নিখোঁজ বাসিন্দাদের আত্মীয়রা।
গত কাল দাবি উঠেছিল, পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তের তালিবান অধ্যুষিত এলাকায় কোথাও বিমানটি নামানো হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু দু’দেশের তালিবান মুখপাত্রই এ দিন সেই সম্ভাবনা খারিজ করে দিয়েছেন। অন্য দিকে, পাকিস্তান, কাজাকস্তান এবং কিরঘিজস্তানও জানিয়ে দিয়েছে, এমন কোনও বিমানের হদিস তাঁরা পাননি। ভারতও এমন কোনও বিমানের হদিস পায়নি বলেই জানিয়েছিল। তবু সন্দেহ করা ছিল, কোনও ভাবে প্রাইমারি রেডারের নজর এড়িয়ে উত্তর করিডরের দিকে উড়েছিল কিনা বিমানটি। ভারতের বায়ুসেনার অফিসাররা জানাচ্ছেন, যে এলাকা দিয়ে ওড়ার কথা ভাবা হচ্ছে, সেখানে চিন এবং ভারতের প্রাইমারি রেডার এতটাই শক্তিশালী যে একটি বিমান চুপি চুপি সেখান দিয়ে উড়ে যেতে পারে না। ট্রান্সপন্ডার বন্ধ করা থাকলেও বায়ুসেনার রেডার তাকে ঠিক ধরে ফেলবে।
বিমান বিশেষজ্ঞদের একাংশ এখন দাবি করছেন, হয়তো নিজের শেষ বার্তাতেই গোলমালের ইঙ্গিত দিতে চেয়েছিলেন কো-পাইলট ফারিক আব্দুল হামিদ। ৮ মার্চ, শুক্রবার রাত ১টা ১৯ মিনিটে শেষ বারের মতো বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআরের কো পাইলট ফারিক এটিসি-কে বার্তা দিয়েছিলেন, “অলরাইট, গুড নাইট।” কিন্তু এ সব ক্ষেত্রে ‘রজার অ্যান্ড আউট’এই শব্দবন্ধ ব্যবহার করে থাকেন পাইলটরা। প্রশ্ন উঠছে ফারিক তা হলে প্রথা ভাঙলেন কেন?
এ ক্ষেত্রে দু’টি মত রয়েছে। এক, যে সময় বার্তাটি পাঠানো হয়েছিল, সে সময় হয়তো ছিনতাইকারীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল বিমানের ককপিট। প্রথা-ভাঙা বার্তা পাঠিয়ে আসলে হয়তো ফারিক বোঝাতে চেয়েছিলেন, সব কিছু ঠিকঠাক নেই। দুই, পাইলট জাহারি আহমেদ শাহ এবং কো-পাইলট ফারিক আব্দুল হামিদই বিমান-ছিনতাইয়ের নেপথ্যে। সে ক্ষেত্রে ফারিকের বার্তা হয়তো ষড়যন্ত্রের সূচনাসঙ্কেতও হতে পারে। বিশেষত তার পর যে ভাবে এটিসি-র সঙ্গে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআরের, তা থেকে সেই সম্ভাবনাই জোরদার হচ্ছে।
মঙ্গলবার দ্বিতীয় সম্ভাবনাকে আরও উস্কে দিয়েছে এক মার্কিন দৈনিকের দাবি। সেখানে মার্কিন তদন্তকারীদের একাংশ জানিয়েছেন, বিমানের কম্পিউটার সিস্টেমে বদল এনেই প্রথম বার তার অভিমুখ পাল্টে দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের মতে, বাকি বিমানের মতো ওই বিমানের ককপিটের কম্পিউটারেও কুয়ালা লামপুর থেকে বেজিং এই রুটের যাবতীয় তথ্য ‘লোড’ করা হয়েছিল। সাধারণত, মনিটরে এই তথ্য দেখেই এক শহর থেকে অন্য শহরে উড়ে যান পাইলট। আবার মনিটরে দেখিয়ে দেওয়া নির্দিষ্ট পয়েন্ট থেকে পাইলট যোগাযোগ করেন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (এটিসি)-র সঙ্গে। এ ক্ষেত্রেও প্রথম এক ঘণ্টা নিশ্চয়ই এ ভাবেই উড়েছিল বিমান।
আর তার পরেই অভিমুখ বদল। কলকাতার এক বিমান পরিবহণ বিশেষজ্ঞের কথায়, “যে ভাবে আচমকা রুট বদলে অন্য শহরের দিকে বিমানটি উড়ে গিয়েছে, তা থেকে ধরে নিতে হবে ককপিটে বসে পাইলটকে নতুন করে নয়া রুটের তথ্য লোড করেছেন। যার অর্থ সেটি আফগানিস্তান বা পশ্চিমের যে দেশের দিকেই উড়ে যাক না কেন, সেই দেশে যাওয়ার নির্দিষ্ট রুটের যাবতীয় তথ্য লোড করা হয়েছিল কম্পিউটারে।” তাঁর আরও দাবি, এই তথ্য লোড করা না থাকলে উড়তেই পারবেন না পাইলট। কারণ, এটিসি-র সঙ্গে তিনি সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে পাইলটের একমাত্র ভরসা ওই তথ্যই। কিন্তু তিনি এ-ও জানাচ্ছেন, নতুন করে ওই তথ্য ভরা বেশ কঠিন কাজ। একা পাইলটের পক্ষে তা করা মুশকিল।
মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স মাঝখানে দাবি করেছিল, উত্তর করিডর কিংবা দক্ষিণ করিডর বলতে যে দু’টি এলাকার ছবি দেখানো হচ্ছে, তার কোনওটিতেই বিমান চালানোর অভিজ্ঞতা নেই জাহারি এবং ফারিকের। কারণ ওই এলাকাগুলিতে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের কোনও রুট নেই। কিন্তু তথ্য বদলের সম্ভাবনা সামনে আসার পর অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, অভিজ্ঞতা নিষ্প্রয়োজন। অন্য রুটের তথ্য লোড করে দিলে তা মেনেই বিমান উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারবেন পাইলট। উপরন্তু ভারতীয় বায়ুসেনার এক অফিসারের মতে, “বায়ুসেনার দু’টি রেডারের মধ্যে সামান্য কিছু এলাকা থেকে যায় যেখান দিয়ে উড়ে গেলে রেডারে সেই বিমান ধরা পড়ে না। কিন্তু এই এলাকা খুব সামান্যই। আকাশে ঠিক কোথায় সেই এলাকা রয়েছে তা বায়ুসেনার অফিসার ছাড়া আর কারও জানার কথা নয়।” শুধুমাত্র আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে কেউ এত সূক্ষ্ম অঙ্ক কষে এগোবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। বাকি রইল তবে ছিনতাইয়ের সম্ভাবনা।
কোথায় রাখা হয়েছে ছিনতাই হওয়া বিমানটিকে? ২২ লক্ষ বর্গ নটিক্যাল মাইল জুড়ে তারই হদিস বের করার চেষ্টা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy