Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

রাস্তাই উধাও, ত্রাণ পাঠাতে প্রাণান্ত

ভূমিকম্পের পাঁচ দিন পরে কাঠমান্ডুতে ধ্বংসস্তূপের নীচে এক তরুণীকে জীবন্ত উদ্ধারের অবিশ্বাস্য কাহিনিও এ তল্লাটে তেমন অনুরণন সৃষ্টি করছে না! জেলার দুর্গততম এলাকা যেখান থেকে শুরু, সেই বালুয়ায় ওমবাহাদুর ঠাকুরির কাছে গ্রামের ভগ্নস্তূপ সরানোটাও বিলাসিতা মনে হচ্ছে। কাঠমান্ডুর ঘটনা নিয়ে চারপাশের জটলার আলোচনায় বৃদ্ধকে অত্যন্ত বিরক্ত মনে হল— ‘‘সে তো আমাদের গ্রামের ভেঙে পড়া ঘরের নীচেও কত লোক এখনও চাপা পড়ে আছে!’’

 চিতার যেন শেষ নেই। কাঠমান্ডুর বাগমতী নদীর তীরে শ্মশান। ভূমিকম্পে মৃতদের শেষকৃত্য চলছে একের পর এক। শুক্রবার।  ছবি: রয়টার্স।

চিতার যেন শেষ নেই। কাঠমান্ডুর বাগমতী নদীর তীরে শ্মশান। ভূমিকম্পে মৃতদের শেষকৃত্য চলছে একের পর এক। শুক্রবার। ছবি: রয়টার্স।

ঋজু বসু
গোর্খা (নেপাল) শেষ আপডেট: ০২ মে ২০১৫ ০১:৩৩
Share: Save:

ভূমিকম্পের পাঁচ দিন পরে কাঠমান্ডুতে ধ্বংসস্তূপের নীচে এক তরুণীকে জীবন্ত উদ্ধারের অবিশ্বাস্য কাহিনিও এ তল্লাটে তেমন অনুরণন সৃষ্টি করছে না! জেলার দুর্গততম এলাকা যেখান থেকে শুরু, সেই বালুয়ায় ওমবাহাদুর ঠাকুরির কাছে গ্রামের ভগ্নস্তূপ সরানোটাও বিলাসিতা মনে হচ্ছে। কাঠমান্ডুর ঘটনা নিয়ে চারপাশের জটলার আলোচনায় বৃদ্ধকে অত্যন্ত বিরক্ত মনে হল— ‘‘সে তো আমাদের গ্রামের ভেঙে পড়া ঘরের নীচেও কত লোক এখনও চাপা পড়ে আছে! কিন্তু যারা চাপা পড়েনি, তারাই বা একটু জল, খাবার বা ওযুধ ছাড়া কত দিন যুঝতে পারবে?’’

ওমবাহাদুরের ছেলে দুবাইয়ে গিয়েছেন, গাড়ির মেকানিকের কাজ নিয়ে। ভূমিকম্পে জখম পুত্রবধূকে নিয়ে বৃদ্ধ পাহাড় থেকে নেমে এসেছেন, ত্রাণবাহী কোনও ছোট ট্রাক ফিরতি পথে জেলা সদরে গেলে চড়ে বসবেন। আকাশে ক’দিন ধরে কপ্টারের চক্কর দেখে চিৎকার করে হাত-পা নেড়েও ফল পাননি। সহায়-সম্বলহীন হয়ে আর কত দিন বসে থাকবেন?

বৌমাকে হাসপাতালে ভর্তি করার তাগিদে মরিয়া বৃদ্ধ তাই কোনও মতে গ্রাম ছেড়ে নেমে পড়েছেন। ওঁদের সঙ্গে দেখা পাহাড়ের খাঁজে জেলার বারা কিলো মোড়ে। জেলা সদর, হাসপাতাল ইত্যাদিকে ডাইনে রেখে বাঁ দিকে পাহাড়ি রাস্তা এগিয়ে গিয়েছে এক সব-হারানোর দেশের দিকে। খসে পড়া পাথরে ছাওয়া সরু পাহাড়ি রাস্তা। জিপের পিছনে অসহ্য ঝাঁকুনি। অসুস্থ মেয়েটিকে কী ভাবে আনলেন?

বৃদ্ধ অসহায় ভঙ্গিতে শুধু হাতটা কপালে ঠেকালেন।

ওমপ্রসাদ ঠাকুরি তা-ও মোটে ক’ঘণ্টা পাহাড় ভেঙে নেমে আসতে পেরেছেন। আরও দূরে নীল-সবুজ ধূসর পাহাড়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে যে স্থানীয় মানুষ অখ্যাত যে সব জনপদের নাম বলছেন, তা যেন সভ্যতাকেই ব্যঙ্গ করছে! দূর-দূরান্তের পাহাড়ে উদ্ধারকারী হেলিকপ্টার-বাহিনী রোজই আবিষ্কার করছে এক-একটা দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া জনপদ। ভারতীয় বায়ুসেনাও নেমে পড়েছে। তা-ও প্রশাসন কবুল করছে, স্রেফ গোর্খা জেলাতেই ৮৫ শতাংশ ধস্ত খান তিরিশেক গ্রামে এখনও ছিটেফোঁটা ত্রাণ পৌঁছানো যায়নি!

প্রাকৃতিক দুর্যোগের কাছে পরাজিত অসহায় সভ্যতার একটা প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বালুয়ায় পাহাড়ি ধসে ঢাকা অসমাপ্ত সাঁকো। গুটিকয় মোটরবাইকও চাপা পড়েছে। নেপালের সেনাবাহিনী জায়গাটা হেঁটে পেরোতে পারেনি। বালুয়ায় গায়ছক বা অন্যান্য গ্রামে পৌঁছতে পায়ে পায়ে পাহাড় ভাঙতে হবে।

শোরপানির গ্রামীণ প্রশাসন-এলাকাতেও যেতে হবে একই ভাবে। ভূকম্পের উৎসস্থলের আরও কাছে— বারপাক যেতে গেলে সাঁকোর অভাবে পাহাড়ি পাকদণ্ডী বেয়ে নীচে নামতে হবে। তার পরে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে ফের নির্দিষ্ট খাঁজ ধরে পাহাড়ি খাড়াই বেয়ে ওঠা। বারপাক ছাড়িয়ে আরও দূরের পাহাড়ে লারপাক। সেখানে পৌঁছতে তো দিন কাবার।

দূরে পাহাড়ের ও-পারের গ্রামে গ্রামে মোবাইলের খুঁটি চোখে পড়ে়। কিন্তু রাস্তার নাম-গন্ধ নেই। যে টুকু ছিল, ভূমিকম্পের ধাক্কায় পাহাড়ের পাথর খসে তারও দফারফা।

খুব দুর্গম জায়গায় যাওয়ার দরকার নেই, গোর্খা জেলা থেকে সামান্য নেমে তানাহু জেলার পাওয়ারহাউস এলাকাতেই তিন দিন ধরে একটা পাথর সরাতে জেরবার হচ্ছেন ফৌজি ইঞ্জিনিয়ারেরা। উপরের ক্যাম্প থেকে সেনাবাহিনীর গাড়ি নামার পথও বন্ধ। ইঞ্জিনিয়ার্স রেজিমেন্টের তরুণ লেফটেন্যান্ট কুমার তামাংয়ের নেতৃত্বে হাতুড়ি-শাবলে ঠুকঠুক করে পাথর ভাঙা চলছে তো চলছেই। তারই মধ্যে পাশের পাহাড়ি ঢালের বাড়ির একটা ঘর গুঁড়িয়ে দিয়ে গেল পাহাড়-খসা পাথর! জানা গেল, ওটা ছিল বাড়ির শৌচালয়।

প্রত্যন্ত গ্রামেও যেখানে বাড়ির ছেলেরা ভারত, আরব মুলুক কিংবা মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুরে ছোটখাটো যা হোক একটা চাকরির খোঁজে পাড়ি জমাচ্ছেন, সেখানে ইন্টারনেট, ফেসবুক, স্কাইপ শব্দগুলো তত অচেনা নয়। কিন্তু সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বা স্বাস্থ্য পরিকাঠামো সেই মান্ধাতার আমলেই পড়ে আছে। গোর্খা জেলা হাসপাতালের চিফ মেডিক্যাল অফিসার সুধা দেবকোটা বলছিলেন, পঞ্চাশ বেডের একটা হাসপাতালে রাতারাতি পাঁচগুণ রোগী! নিরুপায় হয়ে শ’খানেক আহতকে ‘রেফার’ করতে হয়েছে। এ দিকে বাইরের রোগীর চাপে রাজধানী কাঠমান্ডু হাত তুলে দিয়েছে।

ফলে চিকিৎসা পেতে গোর্খার ভরসা এখন পোখরা ও নারায়ণঘাট। অথচ প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে যাঁদের হেলিকপ্টারে চাপিয়ে উদ্ধার করে আনা হচ্ছে, তাঁদের হাসপাতালে পৌঁছানোর মতো যথেষ্ট সংখ্যক অ্যাম্বুল্যান্স নেই। মনে পড়ল দিন দুয়েক আগের অভিজ্ঞতা। গোর্খার হেলিপ্যাডে গিয়ে সেনাবাহিনীর লোকজনের মুখে শুনেছিলাম আকুল অনুরোধ— ‘জখমি’ মেয়েটাকে একটু গাড়িতে তুলে নিন। প্রত্যন্ত সিমজিম পাতলে গ্রামের সেই আহত বাসিন্দা শাকুন গুরুঙ্গকে জওয়ানেরা গাড়ির সিটে শুয়ে পা সামান্য মুড়ে দিতেই তরুণী যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠেছিলেন। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী লক্ষ্মী কুঁয়ারও তাঁকে সামলাতে গাড়িতে উঠলেন। শাকুনের সারা গায়ে অসহ্য যন্ত্রণা। গাড়ি একটু গতি নিলেই কেঁদে উঠলেন ‘বিস্তারা, বিস্তারা’ (আস্তে আস্তে) বলে। টানা চার দিন ধংসস্তূপে চাপা পড়ে থাকার পরে সেটাই ছিল ওঁর প্রথম পরিচর্যা।

হতভাগ্য গ্রামীণ নেপালে এটুকুও পাওয়া এই মুহূর্তে কপালের জোর। গোর্খায় জেলা হাসপাতালে আন্তর্জাতিক ডক্টর্স উইদাউট বর্ডার সংগঠনের ফরাসি চিকিৎসকেরা স্বাস্থ্যকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন, যাতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পরিকাঠামো গড়ে তোলা যায়। কিন্তু সেখানে পৌঁছানো যাবে কী ভাবে, তা-ই তো লাখ টাকার প্রশ্ন!

এরই মধ্যে বারা কিলো মোড়ে দেখা হল মদন ঘিমিরে ও জারিনা গুরুঙ্গের সঙ্গে। পোখরার মেয়ে জারিনা সদ্য ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে বাবার অবাধ্য হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছেন। নিউজিল্যান্ডে পড়াশোনা করা মদনও আবু খৈরানিতে বাবার সোনার দোকান নিয়ে পড়ে থাকতে নারাজ। ত্রাণের জন্য ওষুধ-জল-নুডল্‌স নিয়ে বারপাকের রাস্তায় বাসে উঠে পড়েছেন।

কিন্তু ত্রাণ মজুত থাকলেও দুর্গতদের হাতে পৌঁছানোটা মস্ত কাজ। বিস্তর বাধা। পায়ে হেঁটে ঢুকতে না-পারলে জেলা সদর থেকে বালুয়ার পরে এগনো কার্যত অসম্ভব। আবার ও-দিক থেকে বালুয়ায় আসাটাও দুরূহ। তাই অনেক সময়ে ত্রাণ নিয়ে বালুয়া পৌঁছেও দুর্গতদের অপেক্ষায় হতভম্ব হয়ে বসে থাকতে হচ্ছে।

বিপর্যয়ের পটভূমিতে হাত বাড়িয়ে দেওয়া ও হাত ধরতে চাওয়ার এই দুস্তর ফাঁকটুকুর নামও এখন নেপাল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE