Advertisement
১৩ জুন ২০২৪
Education

বিশ্বাসটা কি আর ফিরবে

গত কয়েক দশক ধরে এ রাজ্যে একটু সঙ্গতিসম্পন্ন শহুরে অভিভাবকরা অসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলই বেছে নিচ্ছিলেন।

—প্রতীকী ছবি।

তূর্য বাইন
শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০২৪ ০৮:১৮
Share: Save:

কলকাতা হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশে ২০১৬-র এসএসসি পরীক্ষার ভিত্তিতে নিযুক্ত শিক্ষকদের পুরো প্যানেলটি বাতিল হওয়ার পর থেকে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক চাপান-উতোর। সরকার-পোষিত বিদ্যালয়ে প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ নিয়ে একের পর এক দুর্নীতির মামলায় হাই কোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায়ে অসদুপায় অবলম্বনে নিয়োগপ্রাপ্ত অযোগ্য শিক্ষকদের সঙ্গে একই সুতোয় ঝুলছে মেধার ভিত্তিতে নিযুক্ত যোগ্য শিক্ষকদের ভবিষ্যৎও। সরকারি বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষকের অভাবে নিয়মিত পঠনপাঠন বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, শিক্ষকদের যোগ্যতা নিয়ে ছাত্রছাত্রী-অভিভাবক মহলেও দানা বাঁধছে সন্দেহ। শিক্ষকদের প্রতি সমাজে যে শ্রদ্ধার আসন পাতা, তা যে কিছুটা হলেও এলোমেলো হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই।

গত কয়েক দশক ধরে এ রাজ্যে একটু সঙ্গতিসম্পন্ন শহুরে অভিভাবকরা অসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলই বেছে নিচ্ছিলেন। নিম্নবিত্ত পরিবারের বহু অভিভাবক আজকাল কষ্ট করে হলেও ছেলেমেয়েদের অসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করছেন। এই প্রবণতা শহর ছাড়িয়ে এখন মফস্‌সলেও। গত বছর অগস্টে প্রকাশিত এক সংবাদপত্র-প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্রেফ পড়ুয়ার অভাবে এ রাজ্যে ৮,২০৭টি স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা ৩০-এর নীচে থাকায় সেগুলি উঠে যাওয়ার মুখে। এর মধ্যে ২২৬টি স্কুল পড়ুয়াশূন্য; ৫০-এর নীচে পড়ুয়ার সংখ্যা, এমন স্কুলের সংখ্যা কয়েক হাজার। এই তালিকায় প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরের সব স্কুলই রয়েছে।

ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলিতে ঠিক বিপরীত চিত্র। সন্তানকে ভর্তি করতে অভিভাবকদের লাইন, নামী স্কুলে ভর্তির ইন্টারভিউ দিতে সন্তানের সঙ্গে মা-বাবারাও রীতিমতো তালিম নেন। সন্তানের ভবিষ্যৎ বিবেচনায় উত্তরোত্তর বাড়তে থাকা ফি-এর বোঝা বইতেও তাঁরা প্রস্তুত। নিখরচার সরকারি স্কুলের মিড-ডে মিল, পোশাক, সাইকেল, ভাতা, ট্যাব বা মোবাইল কেনার এককালীন নগদ টাকার সুবিধা উপেক্ষা করে এ রাজ্যের অভিভাবকদের এই পদক্ষেপ এক দিকে সরকার-পোষিত স্কুলগুলিকে অস্তিত্ব-সঙ্কটে ঠেলে দিচ্ছে, অন্য দিকে বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিসত্তা সম্পর্কে অজ্ঞতা আগামী প্রজন্মের মধ্যে জন্ম দিচ্ছে এক আবেগশূন্য যান্ত্রিকতার।

সরকারি বিদ্যালয় নিয়ে এই নেতিবাচক ধারণার নেপথ্যে নানা কারণ: নড়বড়ে পরিকাঠামো, শিক্ষকদের একাংশের পেশাদারিত্বের অভাব, শিক্ষা-বহির্ভূত নানা কাজে শিক্ষকদের ও বিদ্যালয়ের যথেচ্ছ ব্যবহার, বিদ্যালয়ের পঠনপাঠনের সময়ে হস্তক্ষেপ ইত্যাদি। একই সঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রে একের পর এক কর্পোরেট সংস্থার প্রবেশে ভারতের সর্বত্র এক সমান্তরাল অসরকারি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, যার প্রভাব পড়েছে এ রাজ্যেও। অসরকারি বিদ্যালয়ের প্রযুক্তিনির্ভর উন্নত পরিকাঠামো, সময়োপযোগী পাঠ্যক্রম, পড়ুয়াদের ঝকঝকে সাজ-সরঞ্জামের বিজ্ঞাপন তো আছেই, একই সঙ্গে অসরকারি শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের স্বার্থে সরকারি বিদ্যালয়ের ত্রুটিবিচ্যুতি ও অসরকারি বিদ্যালয়ের উৎকর্ষ নিয়ে তুলনামূলক প্রচারও চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে সরকারি স্কুলগুলিকে।

তবুও ২০১৯-এ দেশ জুড়ে সরকারি ‘ইউনিফায়েড ডিসট্রিক্ট ইনফর্মেশন সিস্টেম ফর এডুকেশন’-এর তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে করা এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ৮৫.৭% পড়ুয়া সরকারি বিদ্যালয়ে পাঠরত। কিন্তু একই সঙ্গে এ কথাও মনে রাখা প্রয়োজন, কোভিডের জন্য প্রচুর ছাত্রছাত্রী শিক্ষাঙ্গন থেকে বিদায় নিয়েছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ ক্রমশ সঙ্কুচিত হওয়ায় নিম্নবিত্ত পরিবারের পড়ুয়াদের একাংশ বিদ্যালয় ছেড়ে নানা অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমনির্ভর কাজে যুক্ত হচ্ছে, পাড়ি দিচ্ছে ভিন রাজ্যেও। এ রাজ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস তেমনটাই ইঙ্গিত করে।

একই সঙ্গে এ রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগে সরকারের নানা কেলেঙ্কারি সামনে এসেছে। ২০১৪ সালের টেট-এর মাধ্যমে নিযুক্ত প্রায় ৩৬ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি কলকাতা হাই কোর্টে বাতিল হওয়ার পর, সুপ্রিম কোর্টের অন্তর্বর্তিকালীন স্থগিতাদেশে সেই ‘বাতিল’ শিক্ষকরা এখনও বহাল। তবে তাঁদের একাংশ যে ঘুষের বিনিময়ে চাকরি কিনেছিলেন, সেই অভিযোগ এখনও অপ্রমাণ হয়নি। এরই মধ্যে ২০১৬-র এসএসসি-র বাতিল প্যানেলের প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষকের একটা বড় অংশ যে অসদুপায়ে চাকরিতে ঢুকেছিল, এ কথা এসএসসি ও মধ্য শিক্ষা পর্ষদও মেনে নিয়েছে।

দেরিতে হলেও যদি কখনও যোগ্যদের শিক্ষাঙ্গনে প্রত্যাবর্তন ও অযোগ্যদের বিতাড়ন সম্ভব হয়, তাতেও সরকার-পোষিত স্কুল ও তার শিক্ষকদের প্রতি পড়ুয়া ও অভিভাবকদের আস্থা ফিরবে কি না বলা শক্ত। অভিভাবকেরা যদি সন্তানদের জন্য অসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলই বেছে নেন, আর ছাত্রের অভাবে যদি একের পর এক সরকারি স্কুল উঠে যায়, তবে আর্থিক সঙ্গতিহীন, একান্ত ভাবে সরকারি স্কুলের উপর নির্ভরশীল পড়ুয়ারা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। তাই সরকারি স্কুলগুলিতে শিক্ষার উপযুক্ত পরিমণ্ডল তৈরি করে পড়ুয়া ও অভিভাবকদের আস্থা ফেরাতে উপযুক্ত পদক্ষেপ জরুরি। বাংলার জনসম্পদ অদূর ভবিষ্যতে যদি শিক্ষাবঞ্চিত, খয়রাতি-নির্ভর রাষ্ট্রীয় বোঝা হয়ে ওঠে, তা চরম লজ্জার হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE