E-Paper

ইতিহাস মুছে কি উন্নয়ন হয়

‘পূর্ব কলকাতার জলাভূমি’ বলতে আজ আমরা যা বুঝি, অতীতে তার বিস্তার ছিল বহু দূর। ব্রিটিশ আমলে তৈরি মানচিত্রে দমদম থেকে শুরু করে রাজারহাট, লবণ হ্রদ ছাড়িয়ে দক্ষিণের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে ‘সল্ট ওয়াটার লেক’ নামে অভিহিত করা আছে।

মৌমিতা সাহা

শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০২৫ ০৪:১৫

কলকাতার পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত বিস্তীর্ণ জলাভূমিতে গত শতকের শেষ দশকে যখন ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার’ স্থাপনের প্রকল্প গৃহীত হল, তখন তার বিরুদ্ধে একটি জনস্বার্থ মামলাকে ঘিরে বেশ হইচই পড়ে। শেষ অবধি দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর নির্মাণকারী সংস্থার বিপুল জমির দাবি নাকচ হল। ১৯৯২ সালে বিচারপতি উমেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রায়ে ‘পূর্ব কলকাতার জলাভূমি’ আইনি মর্যাদা পেল; তার এক দশকেরও বেশি পরে মূলত পরিবেশবিদ ধ্রুবজ্যোতি ঘোষের চেষ্টায় অঞ্চলটি ‘রামসার সাইট’ ঘোষিত হল। কিন্তু, পূর্ব কলকাতার জলাভূমির চরিত্র পরিবর্তন ঠেকানো গেল না; শহরের পরিবেশ রক্ষায় তাকে অপরিবর্তিত রাখার গুরুত্বের কথাও পাত্তা পেল না।

‘পূর্ব কলকাতার জলাভূমি’ বলতে আজ আমরা যা বুঝি, অতীতে তার বিস্তার ছিল বহু দূর। ব্রিটিশ আমলে তৈরি মানচিত্রে দমদম থেকে শুরু করে রাজারহাট, লবণ হ্রদ ছাড়িয়ে দক্ষিণের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে ‘সল্ট ওয়াটার লেক’ নামে অভিহিত করা আছে। এরই একটি খণ্ডিত অংশ আজকের ‘পূর্ব কলকাতার জলাভূমি’। লবণ হ্রদ ও রাজারহাট অঞ্চলটি হল বিদ্যাধরী নদীর একটি অবলুপ্ত ধারার অববাহিকা। অনেকগুলি ভৌগোলিক পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে উন্নীত হয়েছে এই অঞ্চলের নদীমাতৃক জনপদ। বিদ্যাধরী, নোয়াই, সুতি, বাগজোলাকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলের ভাঙাগড়া। ব্রিটিশ শাসনে জঙ্গল কেটে আবাদ তৈরি হওয়ার সুবাদে সুন্দরবনের এই উত্তরাংশ জমিদারদের হাতে এসেছিল। তবে, জল-জঙ্গল-শ্বাপদসঙ্কুল বনাঞ্চলে যে বসত ও আবাদ অঞ্চল গড়ে উঠেছিল, তার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব ছিল গরিব প্রজাদের, যাঁদের অধিকাংশই হিন্দু রাজবংশী, নমশূদ্র এবং মুসলমান।

পরিবেশগত ভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ এই জলাভূমিতে নিউ টাউন তৈরির কাজ প্রথমে শুরু হয় উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ২৪টি মৌজার ৩০ বর্গ কিলোমিটার জমি নিয়ে, বর্তমানে যা ৯৩.৯ বর্গ কিলোমিটার আয়তনে বিস্তৃত হয়েছে। কোনও রকম ‘এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট’ ছাড়াই ১৯৯৫ সালে এত বড় শহর তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল। ২০০০ সাল অবধি রাজারহাটে ১৪৯৪.৬ একর জমিঅধিগ্রহণ করা হয়েছিল, যার মধ্যে মাত্র ২১৪.২ একর জমি চাষিরা স্বেচ্ছায় দিয়েছিলেন। বিপুল কৃষিজমি, বাগান, বাগিচা, মাছচাষের জমি অধিগ্রহণ করে শহর তৈরি করতে যাওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই নানাবিধ প্রতিবাদ হয়েছিল। সে সময়ে সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে চোখ বোলালে স্পষ্ট হবে যে, কী প্রবল হিংসার মধ্যে দিয়ে এই শহরের গোড়াপত্তন হয়েছিল।

বলা হয়েছিল, কলকাতা শহরের বিকেন্দ্রীকরণের জন্য দরকার নিউ টাউন। বাস্তবিক কি তাই ঘটেছে? ঘটনা হল, কলকাতা বা তার পার্শ্ববর্তী এলাকার উচ্চবিত্ত-উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণি এখানে ফ্ল্যাট কিনে রাখছে বিনিয়োগ হিসাবে, বসবাস করার জন্য নয়। মূল প্রোজেক্ট রিপোর্টে অর্থনৈতিক দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ পুনর্বাসন স্কিম ছিল। তাতে আজ অবধি ঠিক কত টাকা কী ভাবে খরচ হয়েছে এবং কত জন লাভবান হয়েছেন, সেই পরিসংখ্যান অধরা। সরকারি ও সমবায় ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কিছু ফ্ল্যাট ছাড়া নিউ টাউন কখনওই মধ্যবিত্তের আশ্রয়স্থল হিসাবে গড়ে ওঠেনি।

অন্য দিকে, ভূমিপুত্ররা চাষাবাদ ছাড়া অন্য কিছু জানতেন না, ফলে নিউ টাউনে তাঁরা রুটিরুজি হারান। জমিহারাদের জীবিকার সুবিধার্থে শুরুতে কিছু সমবায় গোষ্ঠী গঠন ও ট্রেনিং প্রোগ্রাম হয়েছিল। কিন্তু তার বর্তমান পরিণতি কী, সম্ভবত কারও জানা নেই। বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে থাকা ভূমিহারাদের সিংহভাগ এখন জমির দালাল, অটো বা টোটো চালক, অস্থায়ী ছোট দোকানদার, দারোয়ান কিংবা গাড়ির ড্রাইভার হয়েছেন। মেয়েদের মধ্যে অধিকাংশ বাড়ি বাড়ি কাজ করেন নয়তো আনাজ বিক্রি করেন। মূল প্রোজেক্ট রিপোর্টে এঁদের থাকার জন্য নিউ টাউনে ‘সার্ভিস ভিলেজ’ তৈরি করার কথা ছিল। অর্থাৎ ধরেই নেওয়া হয়েছিল নিউ টাউনের ধনী মানুষের সেবার জন্য গরিবদের প্রয়োজন হবে। মূল স্রোতে যে তাঁদের ঠাঁই হবে না, তা প্রথম থেকেই স্পষ্ট ছিল। যাঁদের জায়গা, তাঁদেরই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে তোলার এই প্রক্রিয়া থেকে নগরায়ণের ইতিহাসের সম্ভবত মুক্তি নেই।

বিদ্যাধরী অববাহিকার বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ তিলে তিলে নষ্ট হয়েছে। যেটুকু বেঁচে আছে তা শুধুমাত্র ‘পূর্ব কলকাতার জলাভূমি’র মধ্যে। রাজারহাটের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ঘুনি-যাত্রাগাছি বেসিনের মধ্যেই অবস্থিত। নিউ টাউন-সহ কলকাতার উত্তর ও পূর্বে যতগুলি পুরসভা আছে, তার নিকাশির ঢাল হল এই বেসিনের অভিমুখে। এর উপর দিয়েই লোয়ার বাগজোলা খাল প্রবাহিত হয়ে কুলটি গাঙে পড়েছে। সেই বেসিন বুজিয়ে শহর হচ্ছে। ফলে লক্ষ কোটি টাকা দিয়ে নগরায়ণ হলেও নিউ টাউনের জল জমার সমস্যা মেটানো প্রায় অসম্ভব।

২০২১ সালে নিউ টাউনের কোচপুকুরে একদল ইতিহাস-গবেষক দু’হাজার বছরের পুরনো প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন। অর্থাৎ রাজারহাট শুধুমাত্র বাস্তুতন্ত্রের কারণে নয়, ঐতিহাসিক কারণেও একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। নিউ টাউনে মেট্রো রেলের খনন কার্যের সময় মাটি থেকে উঠেছিল একটি বড় জাহাজের ভগ্নাবশেষ। কোথায় গেল সেই সব প্রত্ন নিদর্শন? সংরক্ষণ হয়নি। নিউ টাউনকে ঘিরে আছে রাজারহাটের পাঁচটি গ্রাম পঞ্চায়েত। বহু পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংসের পরও সুজলা সুফলা রাজারহাটকে আজও সেখানে দেখা যায়। যেখানে রয়েছে শতাব্দীপ্রাচীন মন্দির, দেবদেবীর থান, মসজিদ, দরগা, জমিদারদের বাড়ি, লোকজ সংস্কৃতির নানা নিদর্শন। এখানে হিন্দুরা যান পিরবাবার থানে, হুজরা শরিফে আবার বাবা পঞ্চাননতলার থানে মানত করতে আসেন মুসলমান গ্রামবাসীরা। আগ্রাসী নগরায়ণ গিলে খাচ্ছে এই সহাবস্থানের বাস্তুতন্ত্রকেও।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Urbanization Wetlands Ecosystem Environmental degradation

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy