Review of Book

নিঃসঙ্গ, রাজনৈতিক, আর ‘যে জন আছে মাঝখানে’

শিল্পীমাত্রেই নিঃসঙ্গ, শিল্পের জগৎ এক অপার একাকিত্ব— এ সব আমরা শুনে থাকি, কিন্তু বুঝি না। এর মানেটা যে ঠিক কী, চন্দনা সুন্দর লিখেছেন।

শিশির রায়
শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৬:২২
—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

মেয়ে লিখছেন বাবা আর মায়ের কথা। যে মেয়ের বাবা-মায়ের নাম সোমনাথ ও রেবা হোর, বাংলা তথা ভারতের (বিশ্বেরও নয় কি?) ছাপচিত্র দৃশ্যকলা ও ভাস্কর্যের জগতে দুই স্বনামধন্য শিল্পী— তাঁদের নিয়ে চন্দনা হোরের স্মৃতিকথা, এমনিতেই আগ্রহ জাগাতে বাধ্য। সোমনাথ হোরের জন্মশতবর্ষ-উদ্‌যাপনে কলকাতা, শান্তিনিকেতন ও অন্যত্র বড় প্রদর্শনী হয়েছে, ফিরে দেখা হয়েছে তেভাগার ডায়েরি, চা-বাগানের কড়চা বা ক্ষতচিন্তা, ভাঙন-এর স্রষ্টা শিল্পীকে, তাঁর শিল্পদর্শন নিয়ে বহুচর্চিত কথাগুলোর পুনরাবৃত্তিও হয়েছে। তবু কিছু কথা বলা বাকি ছিল— বাইরের, গোল-গোল সব কথা বলা হয়ে গেলেও ভিতরের যে কথা বলা বাকি থেকে যায়; যে কথা বলার লোক বিরল, কিংবা মেলে না। চন্দনা হোর এই বইয়ে সেই আঁতের কথাগুলো লিখে দিয়েছেন, কোনও কৃত্রিম পরিশীলনের রাখঢাক রাখেননি। মাত্র ৬৮ পৃষ্ঠার বইটি ঠাসা আত্মবিস্ফোরণের বারুদে; পড়তে পড়তে মনে হয়— সোমনাথ ও রেবা হোরকে নিয়ে এমন কথা এ ভাবে আগে লেখা তো দূরস্থান, জানাও যায়নি, ভাবাও যায়নি!

শিল্পীমাত্রেই নিঃসঙ্গ, শিল্পের জগৎ এক অপার একাকিত্ব— এ সব আমরা শুনে থাকি, কিন্তু বুঝি না। এর মানেটা যে ঠিক কী, চন্দনা সুন্দর লিখেছেন। এক শিল্পীদম্পতি, দু’জনের সৌন্দর্যবোধ আলাদা, মানবিক সম্পর্কগুলোর ধ্যানধারণাও দুই মেরুর, কিন্তু একই বাড়িতে আলাদা ঘরে বা স্টুডিয়োয় তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন দিন মাস বছর পেরিয়ে। মা-টি সারা দিন ধরে তৈরি করছেন ক্যানভাস, ডিমের সঙ্গে পিগমেন্ট মিশিয়ে বানাচ্ছেন রং, এঁকে যাচ্ছেন নিজস্ব এক তৈলচিত্র মাধ্যমে, কখনও প্যাস্টেল কালি-কলম পেনসিলে, আবার কখনও হাত দিচ্ছেন টেরাকোটাতেও; এক ফাঁকে একটু রান্না করে নিচ্ছেন, মেয়েকে খাওয়াচ্ছেন আবার স্বামী বা ঘরের কাজের লোকেদের দেখাশোনা-যত্নআত্তিতেও ত্রুটি হচ্ছে না কোনও— এর মধ্যে কোথায় লুকিয়ে থাকতে পারে একাকিত্ব? খুব সুন্দর লেখেন চন্দনা, “ওর (রেবার) ভিতর একরকম ব্রিটিশ একাকিত্ব ছিল।” সুপ্রিম কোর্টের চিফ জাস্টিসের নাতনি, সম্পন্ন ঘরের মেয়ে আর্ট স্কুলে পড়তে এলেন, আলাপ আর বিয়ে হল সোমনাথ হোর নামের এক তরুণ শিল্পীর সঙ্গে, এক দিকে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলেন, অন্য দিকে স্বেচ্ছায় বরণ করলেন দারিদ্র ও অনিশ্চয়তায় ভরা এক ভবিষ্যৎকে। কলকাতা, দিল্লি, আবার কলকাতা, শেষে শান্তিনিকেতন— এই জীবন-যাত্রায় সোমনাথ হোরের ছায়া হয়ে থাকেননি কখনও রেবা হোর, থেকেছেন নিজের ঘরটিতে সতত কর্মময়তায়, অথচ এক গভীর একাকিত্বের বৃত্তেও। সোমনাথ হোরকে নিয়ে লেখাপত্তরের তো অভাব নেই, কিন্তু মেয়ের কলমে রেবা হোর যেন এই বইয়ের ‘আবিষ্কার’। চন্দনা লেখেন, “শান্তিনিকেতনে এসে মা আর চাকরি করতে চাইল না, তার একটি কারণ রয়েছে। এক পরিবার থেকে দু’জনের চাকরি করা... তার মধ্যে মা আর যেতে চায় নি। কারণ, একই পরিবার থেকে দু’জন চাকরি করলে অন্য আরেকটি পরিবারের আরেকজন চাকরি পাবে না, এরকমই মনে করত, ওরা।”

জীবনবন্ধনে

চন্দনা হোর

৩০০.০০

দেবভাষা

পড়ে স্তম্ভিত হতে হয়, শিল্পের সঙ্গে মানবিক বিশ্বাসকে কোন আত্মিক স্তরে মিশিয়ে নিলে এমন সিদ্ধান্ত সম্ভব। শুধু কমিউনিস্ট মতাদর্শে প্রত্যয়ই এ পথে তাঁদের এগিয়ে দিয়েছিল, বললে পুরোটা বলা হয় না। রাজনৈতিক বিশ্বাসকে রোজকার যাপনে মিলিয়ে নিতেন, এমন কত বাঙালি তো এই সেদিনও ছিলেন আমাদের মধ্যে। কিন্তু শিল্পের চর্চায় তাকে মিলিয়ে নেওয়া একটা ভিন্ন, অন্য ব্যাপার। “প্রাত্যহিক ভাত-ডাল-তেল-নুনের জন্য যে সংগ্রাম এবং পরিবেশগত যে যুদ্ধ— এদের মধ্যে যে ব্যাপার রয়েছে, সেখান থেকে শুরু করলে জীবন অন্য এক বড়ো যাত্রার দিকে যেতে পারে,” লেখেন চন্দনা: রেবা-সোমনাথরা জীবনের সেই ‘বড় যাত্রা’টা বরণ করেছিলেন সানন্দে। সে সময়ের শান্তিনিকেতনে এই জীবনটা ছিল, প্রতিভাবান ‘বড়’ মানুষেরা অনায়াসে মিশে যেতেন খেটে-খাওয়া, ‘ছোট’ লোকেদের সঙ্গে, একটা সর্বজনীন ‘ভাগ করে জীবন কাটানোর আনন্দ, যূথবদ্ধতার চেতনা’ ছিল তাঁদের। সেই চেতনা শুধু জীবন জুড়েই থাকত না, ভরে থাকত শিল্পেও।

শিল্পীর জীবনের এই দিকটায় আলো, এ বইয়ের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে। চার পাশের আঘাত, হিংসাও আত্মসাৎ করেন শিল্পী, সময়ের হলাহল গিলে নিয়ে উজাড় করে দেন শিল্পসুধা। সত্তর দশকের শান্তিনিকেতনে নকশাল আর বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের প্রতিক্রিয়া কী করে সোমনাথ হোরকে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছিল ‘উন্ডস’ আর ‘স্যাভেজ’ সিরিজ়, নব্বই দশকের শান্তিনিকেতনের চার পাশে হঠাৎ বেড়ে যাওয়া ‘ক্রাইম’, সাঁওতাল মেয়েদের ধর্ষণ কী ভাবে তাঁকে দিয়ে গড়িয়ে নিচ্ছিল ‘দ্রৌপদী’র মতো ভাস্কর্য, সে কথাও লেখেন চন্দনা। আক্ষরিক অর্থে তা ‘অরগ্যানিক’ কাজ— সাইকেল চালানো শিখতে গিয়ে বালিকা কন্যার হাঁটু কেটে-ছড়ে গেছে, সেই রক্তমাখা ব্যান্ডেজ নিয়ে পাল্পের উপর ছাপ নিচ্ছেন পিতা তথা শিল্পী, সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে ‘পাখির কঙ্কাল, পিউবিক হেয়ার, গাছের ডালের ছাপ, আঁচড়ের দাগ, পাথরের ছাপ’ আর এই সব নিয়ে তৈরি হয়ে উঠছে ‘উন্ডস’! দ্রৌপদী-র কোমর থেকে পা পর্যন্ত পোড়া দাগ কেন, উত্তরে যে শিল্পী বলেন, “মেয়েদের পুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা সারাক্ষণই সমাজে হচ্ছে। নানা ভাবে।... আমি এই ঘটনার প্রতিরোধ হিসেবে মেটালের উপর এই ধরনের তামার পাতিনাটা এনেছি, যে, পুড়েও সে দাঁড়িয়ে আছে, যুদ্ধ করছে— এই আগুনের মধ্যে।”

রেবা-সোমনাথের যৌথ প্রদর্শনী চলছে এই মুহূর্তে কলকাতায়, সেই আবহেই এ বইয়ের প্রকাশ এক নতুন মাত্রা যোগ করল। সৌরভ দে ও দেবজ্যোতি মুখোপাধ্যায় ‘শুরুর কথা’য় লিখেছেন বইটির ‘হয়ে ওঠা’র যাত্রা, নরম আদরে। স্নিগ্ধ, কৃষ্ণেন্দু চাকীর নিরাভরণ প্রচ্ছদটিও।


আরও পড়ুন