লিয়োনেল মেসি বা কোনও বিশ্বমানের ফুটবল তারকাকে ‘মেসি প্রোগ্রাম’ বা অনুরূপ উদ্যোগের মাধ্যমে ভারতে আনার প্রচেষ্টা আবারও এই গোড়ার প্রশ্নটা তুলে ধরল: ভারতীয় ফুটবলের পরিচালনাগত দৃষ্টিভঙ্গিটা আসলে কী? এমন আয়োজন সাময়িক উন্মাদনা ও প্রচারের আলো তৈরি করলেও, ফুটবলের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে এর বাস্তব অবদান প্রায় শূন্য। কয়েক ঘণ্টার অনুষ্ঠান বা প্রতীকী উপস্থিতির মাধ্যমে বিশ্বের কোথাও ফুটবল এগোয়নি; তা এগোয় পরিকাঠামো, প্রশিক্ষণ, বয়সভিত্তিক দল গঠন ও প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচের ব্যবস্থাপনায় ধারাবাহিক বিনিয়োগে। কোনও দেশ ফুটবল ব্যবস্থাপনায় উন্নয়নের বদলে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টকে অগ্রাধিকার দিলেও ফল ধরা পড়ে পরিসংখ্যানেই।
একশো চল্লিশ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার দেশ ভারত আজও ফিফা বিশ্বকাপে খেলতে পারেনি। ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ভারতের সেরা অবস্থান নব্বইয়ের বাইরে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রায়শই একশোর আশপাশে। এই পরিসংখ্যান ভারতকে সেই সব দেশের সঙ্গে তুলনায় দাঁড় করায়, যাদের জনসংখ্যা বা অর্থনৈতিক সামর্থ্য ভারতের তুলনায় অনেক কম। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মরক্কো, ক্রোয়েশিয়ার মতো দেশ নিয়মিত বিশ্বকাপে খেলে। কলকাতার মতো শহরে, যেখানে ফুটবল সাংস্কৃতিক ভাবে প্রোথিত, সেখানে এই ব্যবধানকে আগ্রহের অভাব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। এর একমাত্র ব্যাখ্যা, একটি সংগঠিত উন্নয়ন কাঠামোর অনুপস্থিতি।
তারকাখচিত ফুটবল-আয়োজনের আর্থিক দিকটি আরও স্পষ্ট ভাবে এই বৈপরীত্য তুলে ধরে। বিশ্বমানের ফুটবল তারকাকে আনতে যে বিপুল ব্যয় হয়— উপস্থিতি ফি, নিরাপত্তা, যাতায়াত ও থাকার ব্যবস্থা, স্টেডিয়াম-প্রস্তুতি, প্রচার ও ব্যবস্থাপনার খরচ মিলিয়ে তা প্রায়ই বহু কোটি টাকায় পৌঁছয়। এই ব্যয়ের পরেও কোনও দৃশ্যমান উন্নতি দেখা যায় না নিবন্ধিত খেলোয়াড় বা লাইসেন্সপ্রাপ্ত কোচের সংখ্যায়, বয়সভিত্তিক লিগে বা প্রতিভা-সন্ধান পরিকাঠামোয়। যে সব দেশ ফুটবলে সফল, সেখানে একই বা তার থেকেও কম অর্থ দীর্ঘমেয়াদি অ্যাকাডেমি, স্কুল লিগ, কোচিং শিক্ষা ও ধারাবাহিক স্কাউটিং ব্যবস্থায় বিনিয়োগ হয়। সমস্যা অর্থের অভাবে নয়, অর্থ ব্যয়ের দিগ্নির্দেশে।
অনেকে বলেন, এ ধরনের আয়োজন তরুণ ফুটবলারদের অনুপ্রাণিত করবে। পরিসংখ্যানের বিচারে এই যুক্তি দুর্বল: সুযোগহীন অনুপ্রেরণা নিষ্ফল। ভারতে খুব অল্পসংখ্যক শিশুরই কাঠামোগত ফুটবল প্রশিক্ষণের সুযোগ রয়েছে, আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কোচের সংখ্যা জনসংখ্যার তুলনায় খুব কম। অধিকাংশ প্রতিভাবান খেলোয়াড় কৈশোর পেরোতেই ঝরে যায়— আর্থিক চাপ, প্রতিযোগিতার অভাব, সুস্পষ্ট ভবিষ্যৎ না থাকায়। কয়েক ঘণ্টার একটি অনুষ্ঠান বছরের পর বছর প্রশিক্ষণ, খেলাধুলার বিজ্ঞানভিত্তিক সহায়তা, চিকিৎসা পরিষেবা বা ম্যাচ অভিজ্ঞতার বিকল্প হতে পারে না। বিশ্ব ফুটবলের সাফল্য সরাসরি যুক্ত দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ, শৈশবের কারিগরি উন্নয়ন ও নিয়মিত প্রতিযোগিতার সঙ্গে— এর কোনওটাই এ ধরনের আয়োজনে পূর্ণ হয় না।
কলকাতার বাস্তবতা এই সমস্যা আরও প্রকট করে তোলে। ‘ভারতীয় ফুটবলের মক্কা’ নামে পরিচিত এ শহরেও স্কুল স্তরে ফুটবল ক্রমশ কমছে। পেশাদার যুব অ্যাকাডেমির সংখ্যা সীমিত, জেলা স্তরের প্রতিযোগিতামূলক কাঠামো দুর্বল। ময়দান আবেগ তৈরি করে, কিন্তু আবেগ একা আন্তর্জাতিক মানের ফুটবলার তৈরি করতে পারে না। প্রয়োজন সুসংহত ব্যবস্থা— স্কুল থেকে ক্লাব পর্যন্ত নির্বিঘ্ন পথ, বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণ-পরিবেশ, পুষ্টি ও চিকিৎসা সহায়তা, দীর্ঘমেয়াদি খেলোয়াড় পর্যবেক্ষণ। এগুলি ছাড়া প্রতিভা রাজ্য স্তরের গণ্ডি পেরোতে পারে না।
বিশ্বের যে সব দেশ নিজেদের ফুটবল বদলে ফেলেছে, তারা তা করেছে নিজেদের ব্যর্থতা স্বীকার করে, নীতিগত ভাবে সম্পদের দিক পরিবর্তন করে। জার্মানির ক্রীড়াজগতে কাঠামোগত সংস্কার, জাপানের ‘গ্রাস রুট’ কেন্দ্রিক পেশাদার লিগ ব্যবস্থা, মরক্কোর জাতীয় অ্যাকাডেমি-ভিত্তিক মডেল— সবই পরিসংখ্যানগত ব্যর্থতার উত্তর হিসেবে গড়ে উঠেছে, তাকে ঢাকা দিতে নয়। কোনও দেশই দুর্বল ফলকে চাপা দিতে তারকা আমদানি করে প্রতীকী সাফল্যের আশ্রয় নেয়নি।
যুবভারতীর অনুষ্ঠানের মতো আয়োজনে অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ আসলে উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রমাণ নয়, আত্মবিশ্বাসের অভাবের চিহ্ন। এতে প্রশাসন সব পরিসংখ্যানগত সূচক, যেমন খেলোয়াড়ের গভীরতা, কোচিং ঘনত্ব, যুব প্রতিযোগিতার সংখ্যা ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা ইত্যাদি উপেক্ষা করেই অগ্রগতির দাবি করতে পারে। অর্থনীতির ভাষায়, এর সুযোগমূল্য অত্যন্ত বেশি। প্রতিটি বড় ইভেন্ট মানে হাজার হাজার প্রশিক্ষণ সেশন, শত শত কোচ ও অগণিত ম্যাচ আয়োজনের সুযোগ হারানো।
ভারত যেখানে বিশ্বকাপের বাইরে থেকে যাচ্ছে, সেখানে ছোট জনসংখ্যা ও সীমিত সম্পদের দেশগুলো নিয়মিত ফুটবলে ভারতকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আমাদের ব্যর্থতা প্রতিভা বা আগ্রহের নয়, নীতিগত সিদ্ধান্তের। যত দিন ভারতীয় ফুটবল প্রতীকের সঙ্গে উন্নয়নকে গুলিয়ে ফেলবে, তত দিন বিশ্বকাপ আমাদের কাছে খেলার লক্ষ্য নয়, শুধুই পর্দার দৃশ্য হয়ে থাকবে। আর কোনও তারকা, যত মহানই হোন না কেন, ঝটিকা সফরে এসে এই অঙ্ক বদলে দিতে পারবেন না।