নতুন ছোটগল্পে বাংলা ও বাঙালির কাছে ফিরলেন সলমন রুশদি
Salman Rushdie

জাদু এবং বাস্তবতা

আহা, এই মুহূর্তে উল্টোডাঙা আইল্যান্ডের নাম হোক ‘বাবরের প্রার্থনা’, নিউ টাউনের বিশ্ববঙ্গ গেট ‘সূর্যতোরণ’। ম্যান্ডেভিল রোডের নাম ‘সেই সময়’।

গৌতম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৫:৪১

আটাত্তর বছর বয়সে তাঁর জাদু কিঞ্চিৎ ম্লান, কিন্তু প্রতিভা অব্যাহত। জাদু আসলে ইন্দ্রজাল বা ভেলকি। জাদুদণ্ড, গিলিগিলি গে ইত্যাদি জাদুকরী বয়ানে চোখ টেনে বিভ্রমে মন ভোলায় সে। প্রতিভা অন্য জিনিস। বিচার বিবেচনা বুদ্ধির সঙ্গে সম্পর্ক তার। ভর্তৃহরি নামে পুরাকালের এক জাদু-দার্শনিক তাই প্রতিভার অন্য নাম দিয়েছিলেন বিমর্শ। সাধারণের বিচার-বুদ্ধি-বিবেচনায় যে সব আসে না, কবি, লেখকদের ধীশক্তিতে ধরা দেয় তারা।

সলমন রুশদির সাম্প্রতিক গল্পগ্রন্থ দি ইলেভেনথ আওয়ার অনেকটাই এক ওয়েটিং রুম নিয়ে। যে লোকটা মারা গেল, সে কি সঙ্গে সঙ্গে ভূত হয়ে গেল? তার আত্মা সকলের অজ্ঞাতে উড়ান দিয়ে রহস্যময় কোনও স্বর্গ বা নরকে পৌঁছে গেল? কাগজ, টিভি খুললে প্রত্যহ এত লোক হারিয়ে যায়, সকলেই কি স্মৃতিভ্রংশের শিকার হয়ে বাড়ির রাস্তা ভুলে যায়? না ঢুকে পড়ে রহস্যময় নগরীর কোনও রহস্যমাখা বিপণিতে? বাইরে থেকে সব ঠিক, কিন্তু ওকলাহোমা বা অন্য কোনও নগরীর সেই বিপণিতে ঢুকলে চোখে পড়ে এক বৃদ্ধ দোকানদার, পরে কথা বলতে বলতে আয়নার দিকে চোখ পড়লে চমকে উঠতে হয়। আরে, ওই বৃদ্ধ তো আমি! যুবকবয়সে দোকানে ঢুকলাম, এখন বুড়ো! পাঁচটি ছোটগল্পে এ ভাবেই জীবন-মৃত্যুর সব সীমারেখা ভেঙে দেন রুশদি।

তারই মাঝে বাংলার ঝিলিক! ‘দ্য মিউজ়িশিয়ান অব কহানি’ গল্পের অতিপ্রাকৃত শক্তিসম্পন্ন গায়িকা বালিকা বয়সে উডস্টক ফেস্টিভ্যালের পাশাপাশি ডোভার লেন সঙ্গীত সম্মেলনে সকলকে মুগ্ধ করে, তাকে রবিশঙ্কর সেতার বাজানো শেখান। ওই গল্পে মুম্বইয়ের শিল্পপতি মজনু ফিরদৌসের সঙ্গে সেই গায়িকা চাঁদনির বিয়ে। ফিরদৌস-সাম্রাজ্যের টিভি চ্যানেল, খবরের কাগজ মাসের পর মাস উৎসবের আনন্দে ফেটে পড়ে। একদা যেমন ভারত চমকে গিয়েছিল লখনউয়ের প্রয়াত বাঙালি শিল্পপতির বাড়িতে বিবাহ-আয়োজনে। এ দিকে রূপকথার বিয়ে, ও দিকে ‘লেট’ গল্পে এশীয় ছাত্রীকে দেখে প্রয়াত অধ্যাপকের মনে পড়ে, তাঁর যৌবনে পৃথিবীর পূর্ব দিকে এক যুদ্ধে যোগ দিতে চেয়েছিলেন। পাকিস্তানের কবল থেকে সেই এলাকা যুদ্ধ শেষে নিজেকে মুক্ত করে, নাম হয় বাংলাদেশ।

কত দিন বাদে এ ভাবে বাংলা ও বাঙালির কাছে ফিরলেন রুশদি? তাঁর আগের উপন্যাস ভিকট্রি সিটি ছিল ইতিহাসের বিজয়নগর সাম্রাজ্য নিয়ে, গোল্ডেন হাউস ট্রাম্পের আমেরিকা নিয়ে। শালিমার দ্য ক্লাউন উপন্যাসে অবশ্য তাঁর পূর্বপুরুষের ভিটে কাশ্মীরে ফিরেছিলেন লেখক। সেখানে পাক হানাদারেরা বিদ্যুৎকেন্দ্রের আলো নিবিয়ে দেয়, ডাল লেকের রাস্তায় ট্যাঙ্ক ঢোকে, খুশবুদার ওয়াজ়ওয়ান রান্না সুবাস ছড়ায়, আর পাশাপাশি দুটো গ্রাম সীমান্ত রক্ষার জন্য বাসনকোসন নিয়ে মারপিট করে। ‘বুকার অব বুকারস’-প্রাপ্ত তাঁর প্রথম সাড়া-জাগানো উপন্যাস মিডনাইট’স চিলড্রেন-এর শেষাংশে অবশ্য ’৭১-এর ডিসেম্বরে যুদ্ধ-শেষের চমৎকার বর্ণনা ছিল। নায়ক সালিম সিনাই ঢাকায় চলে এসেছে, পিকচার সিংহ নামের এক জাদুকর সালিমের পুরনো বন্ধু, ডাকিনী পার্বতীকে নিয়ে সেখানে হাজির, দুই বন্ধুর মিলন। নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাবে ভেবে সালিমকে পার্বতী তার বেদেনির ঝুড়িতে ভরে নেয়। পার্বতীও সালিমের মতোই মধ্যরাতের সন্তান। ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট রাত বারোটায় জন্ম, তার মধ্যেও আছে তাই অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা। দুই বন্ধুর মিলনেই তো ‘৭১-এর ১৫ ডিসেম্বরের ‘বটমলাইন’! রুশদি দেখান, ভারতীয় সেনাধ্যক্ষ মানেকশ’ এবং পাক সেনাধ্যক্ষ নিয়াজ়ি-ও পরস্পরের পুরনো বন্ধু, আত্মসমর্পণের টেবিলে গল্পগুজব চলছে।

নিউ ইয়র্কবাসী লেখক কেন বাঙালির এত আপনার জন? ময়দানে ফোর্ট উইলিয়ামের প্রবেশপথের পাশে এখনও নিয়াজ়ির আত্মসমর্পণের মুরাল আঁকা আছে। তবে হাল আমলে নাম বদলে গিয়েছে। রেড রোড দিয়ে আসার সময় চোখে পড়ে, ইংরেজদের তৈরি ওই দুর্গের নাম এখন বিজয়দুর্গ। আর মুরাল আঁকা প্রবেশপথের নাম বিজয়দ্বার। তখন এই সঙ্কলনের ‘কহানি’ গল্পটা মনে পড়ে। সেখানে কথক জানায়, মুম্বইয়ের রাস্তা যে ভাবে নাম বদলায়, মেরিন ড্রাইভ, উইলিংডন ক্লাব, কুইন’স নেকলেস, ক্যাফে প্যারেড সব বদলে গিয়েছে, তাল রাখতে না পেরে সে মনে মনে রাস্তার নতুন নাম দিয়েছে। কবি, লেখক ও সিনেমার নামে। শোলে চক, অমর আকবর অ্যান্টনি রোড, তেন্ডুলকর টেরেস ইত্যাদি! আহা, এই মুহূর্তে উল্টোডাঙা আইল্যান্ডের নাম হোক ‘বাবরের প্রার্থনা’, নিউ টাউনের বিশ্ববঙ্গ গেট ‘সূর্যতোরণ’। ম্যান্ডেভিল রোডের নাম ‘সেই সময়’। তার পর সেই সময়ের সাউথ পয়েন্ট, চিরসবুজ দুর্গাপুজো, কত কী! এই শহরে নাম বদলের বিধাতারা ভেবে দেখতে পারেন।

এখানেই মিডনাইট’স চিলড্রেন উপন্যাসের লেখক হয়ে ওঠেন আমাদের আত্মজন। এই উত্তর-ঔপনিবেশিক সময়ে শুধু মুম্বই-ই নাম বদলায় না। কলকাতার ডালহৌসি স্ক্যোয়ার হয়ে যায় বিবাদী বাগ। বাদী অবশ্য অনুপস্থিত। নামটা রাইটার্সে অলিন্দ যুদ্ধের তিন সেনানী বিনয়, বাদল, দীনেশের নামের অপভ্রংশ যে! ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ’-এর বিরুদ্ধে আজীবন গেরিলা যুদ্ধ চালালেন যিনি, সেই হো চি মিনের নামেই আমেরিকান কনসুলেটের রাস্তা। মিন্টো পার্ক হয়ে যায় শহিদ ভগৎ সিংহ উদ্যান। তার পর দেশ জুড়ে রেকারিং ডেসিমালের মতো ঢ্যা রা রা রা। মোগলসরাই হয়ে গেল দীনদয়াল উপাধ্যায়, ইলাহাবাদ হল প্রয়াগরাজ। নাম বদল করেই আমাদের দেশপ্রেমিক উদ্গার।

সব নাম অবশ্য উচ্চারণের জন্য নয়। এই সঙ্কলনের প্রথম গল্প দক্ষিণ ভারতের এক শহরে। ভি সিনিয়র আর ভি জুনিয়র দু’জনে পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকে। কথকের বয়ান, দু’জনের আসল নাম এত বড় যে মাথায় থাকে না। তবে দুটোই ভি দিয়ে শুরু। তাই এক জন ভি সিনিয়র, অন্য জন ভি জুনিয়র। দু’জনের ব্যালকনি পাশাপাশি। সেখানে দাঁড়িয়ে দু’জনে গল্প করে। সিনিয়রের বাড়িতে বন্ধু, আত্মীয়বর্গ পা ফেলে না, জুনিয়রের ঠিক উল্টো। পথ-দুর্ঘটনায় জুনিয়র আগে মারা যায়। সিনিয়র ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ভাবে, আমারই তো আগে যাওয়া উচিত ছিল। তখনই মৃত জুনিয়রের অন্ধকার বারান্দায় এক ছায়াশরীর। জীবন আর মৃত্যু পাশাপাশিই থাকে, দু’জনে কখনও ঝগড়া করে, কখনও বা নীরবে অন্যের সান্নিধ্য উপভোগ করে।

ছোটগল্পের কাছেও তো বহুদিন বাদে ফিরলেন রুশদি। তাঁর শেষ ছোট গল্প সঙ্কলন ইস্ট ওয়েস্ট বেরিয়েছিল ১৯৯৪ সালে। ২৭টি গল্পের সঙ্কলন, কোথাও এক জন লাল রুবির জুতো চুরি করে প্রাক্তন বান্ধবীকে উপহার দেয়, যাতে বন্ধুনী মঙ্গলগ্রহে চলে যেতে পারে। সেখানে তার বর্তমান প্রেমিক আটকে আছে। এক রিকশাওয়ালা একদা সিনেমার নায়ক ছিল, এখন তার প্রেমিকা নিঃসঙ্গ এক বিধবাকে চিঠি লেখে। প্রতিটি গল্পেই ছিল প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মিলন ও সংঘর্ষের অনুভূতিমালা। তিন দশক পেরিয়ে আজ তাঁর জীবনের দ্বিতীয় ছোটগল্প সঙ্কলনে রুশদি প্রাচ্য-পাশ্চাত্য ছাপিয়ে এগিয়ে গেলেন আর একটু দূর। জীবন ও মৃত্যুর রহস্যময় সম্পর্ক। সেখানে কখনও বৈরিতা, কখনও বা বন্ধুতা।

এটাই কি তাঁর কাছে প্রত্যাশিত ছিল না? যে লোকটা সে দিনও মঞ্চে ছুরির আঘাতে আহত হয়েছে, তার আগে দিনের পর দিন আয়াতোল্লা খোমেনির মৃত্যু-ফতোয়া মাথায় নিয়ে বেঁচেছে, সে-ই তো জীবন ও মৃত্যুকে নিয়ে এই মজা করতে পারে। মাত্র পাঁচটা গল্পের ক্ষীণতনু অবয়বে, জাদু হারানোয় কী আসে যায়? গাব্রিয়েল মার্কেসের শেষ উপন্যাস মেমরিজ় অব মাই মেলাঙ্কলি হোর-ও তো ছিল মাত্র কয়েক পৃষ্ঠার, ‘শতবর্ষের নির্জনতা’র ধারে কাছে সে আসে না। লেখকের জাদুবাস্তবতা হারিয়ে যায়? না কি, আমরা পাঠকরাই চেনা লেখককে পড়তে পড়তে পড়তে ক্রমশ শুয়োরের মাংস হয়ে যাই!

রুশদি মানে সাহিত্য-সিনেমার অজস্র রেফারেন্স, ক্রস-রেফারেন্স। এখানে যেমন এসেছে তাঁর প্রিয় ছবি পথের পাঁচালী, কখনও তারকোভস্কির সোলারিস। কিন্তু এই পঞ্চকের সবচেয়ে বড়, প্রায় ৮০ পৃষ্ঠার দ্য মিউজিশিয়ান অব কহানি গল্পের আড়ালেও তো নিঃশব্দে থেকে গেল বাংলার অভিজ্ঞান। সুজয় ঘোষ ও বিদ্যা বাগচীর মতো বাঙালির নাম না নিয়েও তাঁদের অমর করে রাখলেন আধুনিক ভারতীয় ইংরেজি সাহিত্যের পথিকৃৎ। রাজনীতির উচ্চকিত ঢেঁড়া পেটানোয় বাংলা ও বাঙালির জয় ঘোষিত হয় না, দরদি সাহিত্যে হয়।

কে ভুলতে পারে ‘লেট’ গল্পের সেই দরদ? অধ্যাপক সকালে উঠে দাঁত মাজতে গিয়ে দেখলেন, আয়নায় তিনি। বিছানায় তাঁর শায়িত নিঃস্পন্দ দেহ। তা হলে কি মধ্যরাতেই তিনি মারা গিয়েছেন? তিনি ফাইল ঘাঁটেন, ইজিচেয়ারে বসে ছাত্রীকে দেখা দেন। তার পর কুয়াশার মধ্যে উবে যান। মরে গেলেই কি ‘প্যারাডাইস লস্ট’? আগে তো অশরীরী হয়ে সকলের চোখের আড়ালে ভিড়াক্রান্ত ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা। ছুরিকাহত হওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে নাইফ লিখেছিলেন, আজ আবার মরণের পারে এনে ফেললেন আপন সৃজনক্ষমতাকে। অভেদানন্দ ওই বইয়ে আত্মার অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে এক্টোপ্লাজ়মের কথা শুনিয়েছিলেন, রুশদিও অধ্যাপকের ছায়াশরীর বোঝাতে সেই এক্টোপ্লাজ়মের উল্লেখ করেন।

এখানেই এই বইয়ের জয়। নাম না করে, নীরবে এত বাঙালির কথা, বাঙালির রেফারেন্স সলমন রুশদি আগে কখনও বলেননি। দুনিয়ার সব কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা নীরবেই চালাতে হয়। সেটাই জাদু এবং বাস্তবতা।

আরও পড়ুন