ক্রমশ কাগজ-কলমহীন হয়ে উঠছি আমরা। কবেই হারিয়ে ফেলেছি বুকপকেটের ডায়েরি ও কলম। এখন আর ও সব লাগে না, স্মার্টফোনই যথেষ্ট। বুকপকেটের সেই ডায়েরি কত কিছুর সাক্ষ্য বহন করত— কারও নাম-ঠিকানা, প্রতি দিনের কোনও না কোনও বিশেষ ঘটনা, পথ নির্দেশ, হিসাবনিকাশ ইত্যাদি। যদিও সেই ডায়েরি আজও আছে, আছে কলমও। শুধু হারিয়ে গেছে লেখার ইচ্ছেটা। বলা ভাল, হাতে লেখার প্রয়োজন পড়ছে না। তবু ব্যাঙ্ক-পোস্ট অফিসে একটা সইয়ের বড় দরকার পড়ে। সেখানে তো অনলাইন সই-তে হবে না। অফিসারের সামনে সইটা জরুরি আর তখনই প্রয়োজন হয় কলমের। হঠাৎ প্রয়োজনে কলমের গুরুত্বটা বোঝা যায়। এ রকম পরিস্থিতিতে প্রায়শই দেখা যায় যাঁর সইয়ের দরকার তিনি ইতিউতি তাকাচ্ছেন। এক সময় কারও কাছ থেকে ধার করতে হয় কলমটি। ভাগ্যিস কোনও কোনও মানুষ এখনও সঙ্গে রাখেন এই বিশেষ বস্তুটি।
এই প্রযুক্তির যুগে ইমেল, ওয়টস্যাপ— সবই কাগজ-কলমহীন। মোবাইল, ল্যাপটপ থেকে টাইপ করে মুহূর্তে হরেক তথ্য পৌঁছে দেওয়া যায় নির্দিষ্ট ঠিকানায়। ফর্ম ফিল-আপ থেকে পেমেন্ট— সব এখন অনলাইন। ফলে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও তৈরি হয়েছে লেখার প্রতি অনীহা। লেখার দরকার কী, জ়েরক্স করে নিলেই হল। তাতে সময় ও পরিশ্রম দুটোই বাঁচবে। ধৈর্য ধরে লেখার চলটা উঠেই যাচ্ছে আস্তে আস্তে। ফলে, হাতের লেখাটা এখন আর জরুরি নয়। বড়দেরও আর ছোটদের বলতে শোনা যায় না হাতের লেখায় যত্নশীল হওয়ার জন্য— “ধরে ধরে সুন্দর হাতের লেখার প্রতি নজর দাও।” ক্যাশলেশ লেনদেনের মতো ‘পেপারলেস’ হয়ে ওঠার মধ্যে দিয়ে বিবর্তন ঘটেছে হাতের লেখারও। তবে কি হারিয়ে যাবে লেখার সৌন্দর্য ও শিল্প? কারও কারও লেখার মধ্যে ফুটে ওঠে এক শিল্প সুষমা। লোকে বলে মুক্তোর মতো হস্তাক্ষর, যা নিয়মিত অভ্যাসের মধ্য দিয়ে সুন্দর হয়ে ওঠে। আর সেই অভ্যাসটাই যদি না থাকে, তা হলে সুন্দর কি আর সুন্দর থাকে? আজও পুরনো দলিল দস্তাবেজ দেখলে বোঝা যায়, সে সময়ে লোকে হাতের লেখাকে কতটা গুরুত্ব দিতেন। সে দিন এখন অতীত।
সনৎ ঘোষ, খালোড়, হাওড়া
নববর্ষ
বছরের প্রথম দিনটি অর্থাৎ নববর্ষকে কেন্দ্র করে আমাদের বাঙালিদের মধ্যে বিচিত্র অনুভূতি ভেসে ওঠে। মফস্সলে নববর্ষ পালনের এক ভিন্ন ছবি দেখা যায়। শহরে চাকচিক্য বেশি লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন লেখাপত্র থেকে জানা যায় আশি বা নব্বইয়ের দশকের দিকে মফস্সলে নববর্ষ পালনের বিশাল সমারোহ ছিল না। তা একদম সাধারণ ভাবে পালিত হত। একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে আমাদের ছোটবেলাতে দেখেছি নববর্ষ বা অক্ষয় তৃতীয়ার দিন হালখাতা হত বিভিন্ন দোকানে। শপিং মল তখনও সে ভাবে প্রবেশ করেনি। মফস্সলে দু’-একটি মাত্র দোকানে ছিল চাকচিক্য।
কাপড়ের দোকান, মুদিখানা, স্টেশনারি, আসবাবপত্রের দোকান— ছোটখাটো জায়গায় গিয়ে এই নির্দিষ্ট দিনে বাবার সঙ্গে ক্যালেন্ডার, মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে আসতাম। ক্যালেন্ডার আর মিষ্টির প্যাকেট সংগ্রহ করতে করতে ঝোলা ভর্তি হয়ে যেত। বাড়িতে এলেই ছোটদের মধ্যে এক রকম প্রতিযোগিতা শুরু হত কে টিফিনে কোন মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে যাবে। কোন দোকানে ভাল প্যাকেট দিয়েছে, তা নিয়ে শুরু হয়ে যেত কাড়াকাড়ি। হালখাতার এই দিনে দোকানগুলোতে ক্রেতাদের আপ্যায়নের ক্ষেত্রে কোনও বৈষম্য থাকত না। বর্তমানে হালখাতার নিমন্ত্রণ রক্ষার জন্য উল্লেখ করা থাকে নির্দিষ্ট নিয়ম-রীতি। তখন দেখতাম ক্রেতা সমস্ত ঋণ পরিশোধ করে আবার নগদ টাকার বিনিময়ে কোনও অলঙ্কার বা অন্য কোনও সামগ্রী কিনে ফিরতেন। কারণ, ক্রেতার আগের বছরের খাতা বন্ধ করে নতুন বছরে হিসেবের খাতা শুরু হত। তখন এই বিশেষ দিনটিতে গয়নার মজুরিতে ছাড় দেওয়া হত। যদিও এখন সেটা সারা বছর ধরে নানা উৎসবকে কেন্দ্র করে চলে।
এক সময়ের সুপ্রসিদ্ধ দোকানগুলিতে এখন আর সেই আড়ম্বর করে হালখাতা হয় না। কারণ তার অনেকগুলির জায়গায় এই কয়েক বছরে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বড় বড় শপিং মল। সেখানে ঘটা করে সারা বছর ধরে বিভিন্ন ছাড়ের প্রচার চলে। এখন তো সরাসরি টাকা দিয়ে জিনিস কেনার চল কমেই চলেছে। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন মানুষজন। কার্ডের মধ্যে ধার হয় ব্যাঙ্কে। দোকানদার ও ক্রেতার মধ্যে স্থান করে নিয়েছে ব্যাঙ্ক। ফলে ক্রেতার লাভ ক্ষতির পুরোভাগ ঢোকে ব্যাঙ্কে। আবার ক্রেতার জিনিস কেনার সময় যুক্ত হচ্ছে জিএসটি।
এখন আমাদের দেখানোর বিষয়টি বড় হয়ে উঠেছে। তাই শপিং মল থেকে নেওয়া বললে অনায়াসে তার যেন কদর বেড়ে যায়। তা ছাড়া, এখন অনেকেই ‘কেনাকাটা’ বলেন না, বলেন ‘শপিং’। বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে সারা বছর এই শপিং রমরমিয়ে চলে। দুটোর সঙ্গে একটা ফ্রি, বছর শেষে সেল, বিশেষ দিনে ছাড়, আরও কত কী বিজ্ঞাপন হামেশাই দেখা যায়। এ ছাড়াও নগদ টাকার পরিবর্তে জায়গা করেছে অনলাইন টাকা দেওয়ার রীতি। এখনকার এই আধুনিকতা পিছনে ফেলে দিচ্ছে পাড়ার দোকানদারদের। অনেকে দোকানকে আধুনিক করে তুলতে সমর্থ। কিন্তু যাঁদের পক্ষে তা সম্ভব নয়, তাঁদের ব্যবসা ধুঁকছে। সেই সংখ্যাটা কিন্তু কম নয়। হালখাতার সেই রীতি, বিশ্বাস আর পারস্পরিক আস্থা যেন হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। পারস্পরিক সম্পর্ক এখন আর আগের মতো নেই।
সুকমল দালাল, খণ্ডঘোষ, পূর্ব বর্ধমান
বিশ্বাসহীনতা
দ্রুত পরিবর্তনশীল সামাজিক পরিসরে একান্ত বিশ্বাসভাজন মানুষের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে। পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পরিসরেও এক চূড়ান্ত বিশ্বাসহীনতার বাতাবরণ তৈরি হয়ে চলেছে নিরন্তর। একান্ত চেনা বৃত্তেও আজ বিশ্বাস করে ব্যক্তিগত কথা ভাগ করে নিতে চাইলে, নানা ভাবে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। আসলে বিশ্বাসহীনতা যে আগে ছিল না, তেমনটি নয়। আবার বিশ্বাসভাজন মানুষের সংখ্যা যে আজকের সমাজে একেবারে নেই, তা-ও নয়। যদিও নানা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত খবরে চোখ রাখলেই বোঝা যায় সব কিছুর সঙ্গেই যেন এক সর্বগ্রাসী বিশ্বাসহীনতা জড়িয়ে আছে। বিশ্বাসভাজন বন্ধু, প্রিয়জন সবাই যেন এক স্বার্থপরতার বৃত্তে জড়িয়ে গেছে। তবু কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই অমোঘ উক্তিটি মনে পড়ে। ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে তিনি বলেছিলেন ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’। অবশ্য এই আপাত অস্থির, মূল্যবোধহীন সময়ে দাঁড়িয়ে তিনি কী বলতেন, জানা নেই। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর এক গানের বাণীতে বলেছিলেন “গঙ্গা সিন্ধু নর্মদা কাবেরী যমুনা ঐ/ বহিয়া চলেছে আগের মতন, কই রে আগের মানুষ কই।” প্রায় একশো বছর আগে হয়তো লিখেছিলেন এই গান। এই সময়ের প্রেক্ষাপটে তা হলে নজরুল কী বলতেন বা লিখতেন, খুব জানতে ইচ্ছে করে।
মানস কুমার সেনগুপ্ত, কলকাতা-৭৪
ট্রেন বৃদ্ধি
বাঙালির সমুদ্র ভ্রমণের গন্তব্যগুলির মধ্যে দিঘা অন্যতম। সম্প্রতি দিঘায় জগন্নাথদেবের মন্দির উদ্বোধন হওয়ার পর স্বাভাবিক ভাবেই এই জায়গায় পর্যটকের সংখ্যা আরও বাড়বে বলেই মনে হয়। কিন্তু এই জায়গায় যাওয়া-আসার ট্রেন একেবারে হাতেগোনা। যেগুলি চলে সেগুলিও হামেশাই দেরিতে যাতায়াত করে।
তাই রেলওয়ে বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বিনীত অনুরোধ, পর্যটকদের সুবিধার জন্য দিঘা লাইনে ট্রেনের সংখ্যা আরও বাড়াতে উপযুক্ত ব্যবস্থা করা হোক।
তাপস দাস, সিঙ্গুর, হুগলি