তূর্য বাইনের লেখা ‘শিক্ষার সর্বনাশে কার উল্লাস’ (২৯-১১) শীর্ষক প্রবন্ধটি সময়োচিত ও প্রাসঙ্গিক। স্মরণীয়, রাজ্যে এক সময় স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা প্রায় প্রতি বছরই হয়েছে এবং সেই সুবাদে হাজার হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা নিযুক্ত হয়েছেন, স্কুলে পড়াচ্ছেন। কিন্তু, এখন বিষয়টা যেন অন্তঃসারশূন্য হয়ে উঠল। আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা তোতা-কাহিনীর সেই নিন্দুকরাও আসরে নেমে পড়লেন। মাঝপথে যোগ্যদের প্রাণও ওষ্ঠাগত হল। তা হলে শিক্ষার এই সর্বনাশে কার উল্লাস? নিন্দুকরা তো অনেকেরই উল্লাস দেখছেন। অনেকেই বলবেন, এ ক্ষেত্রে নিন্দুকরাই ঠিক দেখছেন।
কিন্তু আমার প্রশ্ন অন্যত্র। আমরা দেখছি শুধুই বঞ্চনা আর যন্ত্রণা। অসংখ্য শিক্ষক-শিক্ষিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। তাঁরা বেতনহীন হয়ে পড়লে ছেলেপুলে নিয়ে সংসার চালাবেন কী করে? এত কাল চাকরি করার পর চাকরি হারানোয় যে সঙ্কট তৈরি হল তার থেকে মুক্তি কী ভাবে সম্ভব! নতুনরা যাঁরা এই পেশায় আসার বিষয়ে চিন্তা করছিলেন, সঙ্কট থেকে বাঁচার জন্য হয়তো অন্য জীবিকা গ্রহণ করবেন। তবে নিঃসন্দেহে এতে ভাল মেধার অপচয় ঘটবে। তাতে নিশ্চয়ই কিছু আসে যায় না। কিন্তু অন্য জীবিকা গ্রহণে বাধ্য হওয়া সেই ছেলে-মেয়েদের যন্ত্রণা হবে অপরিসীম।
দেখা যাচ্ছে, এই পর্বে সবচেয়ে লাভবান বেসরকারি স্কুলের মালিকপক্ষ। এই বিপর্যয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অভিভাবকেরা সন্তানকে বেসরকারি স্কুলে ঠেলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে মালিকপক্ষ আর্থিক দিক থেকে রাতারাতি কুবেরের অনুগ্রহ পাচ্ছেন। শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত থাকায় দেখছি, বেসরকারি স্কুলের প্রতি সেকশনে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এত কাল ২৫ থেকে ৩০-এর মধ্যে ঘোরাফেরা করলেও সেই সংখ্যা এখন ঘুরছে ৪৫ থেকে ৫০-এ।
প্রশ্ন, প্রান্তিক মানুষগুলি কী করবেন? ভাবতে হবে আজ এঁদের ছেলেমেয়েদের কথাও, যারা অনেকেই সরকারি স্কুলে পড়ে। সেখানে শিক্ষকের আকাল চলছে। শ্রেণিকক্ষে বসে ৬৫ থেকে ৭০ জন কচিকাঁচা। প্রতিকূল পরিবেশ, তবুও তো পড়ে। হয়তো মিড-ডে মিল খাওয়ার প্রত্যাশাতেই আসে, তবুও আসে তো। এখন তো আবার শোনা যাচ্ছে ডিমের দাম বেড়েছে। তাই মিল থেকে তুলে দেওয়া হচ্ছে প্রাপ্য ডিমটুকুও। তবে আজও কিছু স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা নিজেদের পয়সায় এই বরাদ্দটুকু বাঁচিয়ে রেখেছেন। তাঁরাই সমাজের সম্পদ। তাঁরা আজও জাতির মেরুদণ্ড।
সূর্যকান্ত মণ্ডল, কলকাতা-৮৪
সুরাহার উপায়
তূর্য বাইনের লেখা ‘শিক্ষার সর্বনাশে কার উল্লাস’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা পরিচালনার প্রশ্নে স্কুল সার্ভিস কমিশনের ভূমিকা দুর্ভাগ্যক্ৰমে আর হয়তো ‘প্রশ্নাতীত’ রইল না। সমস্যা মেটার পরিবর্তে ক্রমাগত একটার পর আর একটা জট এমন ভাবে সামনে আসছে, যা সহজে খোলার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এর ফলে যেমন ভুগতে হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের এবং নতুন চাকরিপ্রার্থীদের, তেমন সরকার-পোষিত বিদ্যায়তনের পড়ুয়াদের সঙ্গে সামগ্রিক ভাবে রাজ্যের বিদ্যালয়-স্তরের শিক্ষা-ব্যবস্থাকেও পরিস্থিতির শিকার হতে হচ্ছে।
আমার মতে, সমাধান হিসাবে এমন করা যেতে পারে যে, সাম্প্রতিকতম পরীক্ষার ফলের উপরই ভিত্তি করে পুরনো (২০১৬-র ‘যোগ্য’ চাকরিহারা এবং অসফল পরীক্ষার্থী) এবং নতুনদের জন্য পৃথক তালিকা বার করে প্রথমটি থেকে সফল পরীক্ষার্থীদের নিয়ে পূরণ করা হল চাকরি হারানোর ফলে তৈরি হওয়া শূন্য পদ আর দ্বিতীয় তালিকা থেকে পূরণ হল অতিরিক্ত ভাবে সৃষ্ট হওয়া শূন্য পদ। এর ফলে অভিজ্ঞতার জন্য দশ নম্বর বরাদ্দ হেতু যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে, সেটাও যেমন কেটে যাবে, অন্য দিকে, সমস্যা সমাধানের একটা রাস্তাও মিলবে। অবশ্য, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এর চেয়েও ভাল রাস্তা পাওয়া সম্ভব। এবং রাজনীতি দূরে সরিয়ে রেখে সেই প্রচেষ্টাই এখন আশু প্রয়োজন।
গৌতম নারায়ণ দেব, কলকাতা-৭৪
বড় ক্ষতি
তূর্য বাইনের লেখা ‘শিক্ষার সর্বনাশে কার উল্লাস’ প্রবন্ধ নিয়ে কিছু কথা। শিক্ষার সর্বনাশ নিয়ে সাধারণ মানুষ তো নয়ই, কোনও রাজনৈতিক দলেরও উল্লসিত হওয়ার কথা নয়। আগেও রাজনৈতিক দলগুলি ক্ষমতায় এসে কিছু অনৈতিক কাজ করেছে ঠিকই, তবে বলা যায়, সমান তালে ভাল কাজের পরিসংখ্যানও পাওয়া গিয়েছে। যেমন বিদ্যালয়গুলি অবৈতনিক হয়েছে, শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি হয়েছে, মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলি উচ্চ মাধ্যমিকে পরিণত হয়েছে। তবে, নিয়োগ সংক্রান্ত ব্যাপারে পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগ থাকার ফলেই ‘স্কুল সার্ভিস কমিশন’ গঠিত হয়েছে। বছরে হাজার হাজার শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতী শিক্ষকতার পেশায় নিযুক্ত হতে পেরেছেন। মহামান্য আদালতের নির্দেশে কারও নিয়োগ হয়নি, কারও চাকরিও যায়নি। কিন্তু গত দশক থেকে শিক্ষাব্যবস্থার এই হাল কেন? সাধারণ মানুষের মনে এটাই প্রশ্ন।
নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে সেই প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি এবং ‘সিস্টেম’-এর গলদ আজ শিক্ষাব্যবস্থাকে এক অন্ধকার জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে। সেই কারণেই চাকরিপ্রার্থীরা মহামান্য আদালতে যেতে বাধ্য হয়েছেন। আর বিরোধীরা তো সে সুযোগ নেবেনই।
অস্বীকারের জায়গা নেই যে, মহামান্য আদালত রাজ্য সরকার এবং শিক্ষা দফতরকে বার বার বলা সত্ত্বেও চাল-কাঁকর আলাদা করতে পারেনি বলেই চাকরি খোয়াতে হয়েছে যোগ্য শিক্ষকদের। আদালতের নির্দেশে আবার স্কুল সার্ভিস কমিশনকে নতুন করে পরীক্ষা নিতে হল। এই পরীক্ষাতেও সিস্টেম-এ গলদ থাকার অভিযোগে এবং অযোগ্যদের পুনরায় পরীক্ষায় বসতে দেওয়ার অভিযোগ তুলে আবার মামলা দায়ের হয়েছিল আদালতে। অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, এই পরীক্ষাও আদালতের নির্দেশে শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়ে যাবে কি না।
প্রবন্ধকারের কথার সূত্র ধরে বলা যায়, শিক্ষার সর্বনাশে শাসক বিরোধীরা উল্লাস করছেন বা করবেন কি না জানি না, তবে শিক্ষাব্যবস্থার বড় ক্ষতি হয়ে গেল। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা শাসকের ভাবনাতে তো নেই-ই, বিরোধীরাও তা নিয়ে তেমন ভাবে ভাবিত নন বলেই দেখা যাচ্ছে।
স্বপন আদিত্য কুমার বিশ্বাস, অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
হতাশাজনক
‘শিক্ষার সর্বনাশে কার উল্লাস’ প্রবন্ধটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও যুক্তিপূর্ণ। বহু বছর কাজ করার পর হঠাৎই কর্মহীন হয়ে পড়লে এই চাকরি না থাকার যন্ত্রণা আরও বেশি করে বেঁধে। সেই পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই এই মানুষগুলিকে যেতে হয়েছে। যোগ্য চাকরিহারাদের পুনরায় পরীক্ষায় বসে চাকরি ফিরে পাওয়াটাও অযৌক্তিক বলে মনে করি। কারণ তাঁরা যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষাতে ইতিপূর্বেই সফল হয়েছেন। সেই সুবাদেই তাঁরা এত বছর চাকরিও করেছেন। শিক্ষক নিয়োগের নতুন পরীক্ষায় তাঁরা আবার নতুনদের সঙ্গে পরীক্ষা দিলেন। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, প্রশাসনও যেন কায়দা করে কিছু অভিযুক্তকেও ওই পরীক্ষায় বসার সুযোগ দিল। এই পরীক্ষাতেও কর্তৃপক্ষ কি জল ঢেলে দিলেন? যার জন্যে আইন-আদালতকে আবার টেনে আনতে হল? প্রশ্ন হল যাঁরা যোগ্য শিক্ষক, তাঁরা কেন কর্তৃপক্ষের এত বড় ভুলের খেসারত দেবেন? প্রকৃত যোগ্য শিক্ষকদের দোষটা ঠিক কোথায়?
সব দেখে শুনে হতাশ লাগে। এই সমাজে আগে যেমন সৎ এবং অসতের একটা ভারসাম্য রক্ষিত হত, যত দিন যাচ্ছে, তা যেন একেবারে ভেঙে পড়ছে। অসতের সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে। রাজনীতির চাবিকাঠি চলে গিয়েছে দুর্বৃত্তদের হাতে।
প্রদীপ কুমার সেনগুপ্ত, ব্যান্ডেল, হুগলি