Threat Culture

ভৃত্যতন্ত্র

কলেজের নিজস্ব কমিটির এক্তিয়ার সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী প্রশ্ন তুললেও প্রাতিষ্ঠানিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় তাঁরা সরব হননি। ফলত, যা প্রত্যাশিত, তা-ই ঘটেছে।

শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০২৫ ০৫:১৫

যত বদলায়, ততই থাকে আগের মতো— ইংরেজি এই প্রবাদ বাক্যটি যেন খোদাই হয়ে গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার গায়ে। গত বছর আর জি কর কাণ্ডের পর অধ্যক্ষ বদল হয়েছিল, রোগী কল্যাণ সমিতি ভেঙে গড়া হয়েছিল। সে সব নেহাত প্রসাধনী পরিবর্তন। বদলায়নি হুমকি-সংস্কৃতি, ধর্ষণ-সংস্কৃতি। কেবল চিকিৎসকের ধর্ষণ-হত্যার বিচার নয়, যে কর্মসংস্কৃতি তা সম্ভব করে, তার নিরসন চেয়ে জুনিয়র ডাক্তার এবং বৃহত্তর নাগরিক সমাজ স্পষ্ট বার্তা দিয়েছিলেন সরকারের কাছে। সরকার কান দেয়নি। শাসক দলের প্রশ্রয়প্রাপ্ত কিছু ছাত্র ও শিক্ষক চুরমার করছেন সমাজের অমূল্য সম্পদ— চিকিৎসকের নৈতিকতা, পেশাদারি সৌজন্য, শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক। দুর্বিনীত ছাত্রের কাছে অপমানিত শিক্ষক চোখের জল ফেলছেন, নেশাগ্রস্ত ইন্টার্ন চিকিৎসকের হাতে নিগৃহীত হচ্ছেন টেকনিক্যাল পাঠক্রমের ছাত্রী। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জবাব চাইতে গেলে অভিযুক্তই হুমকি দিয়ে চুপ করিয়ে দিচ্ছে। সংবাদ প্রতিবেদনে রাজ্যের নানা মেডিক্যাল কলেজ থেকে উঠে এসেছে এমন চিত্র। কর্তৃত্বের এই সঙ্কট অপ্রত্যাশিত নয়। যে দিন আন্দোলনরত জুনিয়র চিকিৎসকদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভায় এ রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষরা নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়েছিলেন, সে দিনই পথ তৈরি হয়েছিল অবাধ দুর্বৃত্তায়নের। কলেজের নিজস্ব কমিটির এক্তিয়ার সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী প্রশ্ন তুললেও প্রাতিষ্ঠানিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় তাঁরা সরব হননি। ফলত, যা প্রত্যাশিত, তা-ই ঘটেছে। বদলির ভয়, বরখাস্তের ভয়, অপমানিত হওয়ার ভয়ে নীরবতা আর নিষ্ক্রিয়তাকে বর্ম করেছেন পদাধিকারীরা।

বিবেকহীন, লজ্জাহীন প্রশাসকের মূঢ় সমর্থন একটি ব্যবস্থাকে অবক্ষয়ের কোন অতলে পৌঁছতে পারে, আর জি কর কাণ্ড তার প্রমাণ। নিজের হাসপাতালে এক উচ্চশিক্ষার্থী চিকিৎসকের ধর্ষণ-হত্যা, এবং তার পরেও মূল্যবান প্রমাণ বিনষ্ট করার মতো অকল্পনীয় অপরাধ যে ঘটতে পেরেছে, তা বস্তুত এক দীর্ঘ দিনের ধ্বংসলীলার ফল। উচিত-অনুচিত, কর্তব্য-অকর্তব্যের বোধ-বিচারকে ধ্বংসের কার্যসূচিই আজ হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক কার্যসূচি। ক্ষমতা থাকলে নিয়ম-বিধি মানার প্রয়োজন নেই, এই শুধু নয়। নিয়ম-বিধি না মেনে ক্ষমতার প্রমাণ দেওয়ার পালা চলছে হাসপাতালের ওয়র্ডে, করিডরে, সেমিনার কক্ষে। এটা সম্ভব হচ্ছে, কারণ সর্ষের মধ্যে ভূতের মতো, বিধিবদ্ধতা নিশ্চিত করে যে প্রতিষ্ঠানগুলি, সেগুলির মধ্যেই ঢুকে বসে রয়েছে লোলজিহ্বা প্রেত। মেডিক্যাল কাউন্সিল প্রতিষ্ঠানটিতে আর জি কর কাণ্ডে অভিযুক্ত চিকিৎসকদের প্রভাব এখনও অক্ষুণ্ণ রয়েছে। চিকিৎসকদের রেজিস্ট্রেশন বাতিল হয়ে যেতে পারে, এমন ভয় দেখিয়ে অবিরত টাকা আদায়ও চলছে। মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ, রোগী কল্যাণ সমিতি, স্বাস্থ্য ভবন, মেডিক্যাল কাউন্সিল— এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানই যখন রাজনৈতিক ক্ষমতার ভৃত্য, দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষক, তখন রোগী, ছাত্রছাত্রী, চিকিৎসকরা যে দল-দস্যুদের অসহায় শিকার হবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী?

আশ্চর্য নয় যে আর জি কর কাণ্ডের সুবিচারের বদলে এখন সেই ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে ধর্ষণ-হত্যা হুমকি সংস্কৃতির একটি উল্লেখনীয় মডেল। তাই সহজেই ক্ষমতার প্রশ্রয়প্রাপ্তরা অন্যদের শাসাতে পারেন, ‘আর জি কর করে দেব’ বলে। সারা রাজ্যে নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্যাতনের অগণিত ছোটবড় ঘটনা সেই স্পর্ধার উক্তির বাস্তব অভিনয় দেখছে। যে রাজনীতি ব্যক্তির ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধির জন্য দেশবাসীর বৃহৎ ক্ষতি মেনে নিতে বাধ্য করে, তারই অঙ্গুলি নির্দেশে চলছেন উচ্চশিক্ষার পদাধিকারীরা। যাঁরা উদ্ধত অধস্তনদের শাসন করতে ভয় পান, তাঁরাই পাচ্ছেন প্রশাসনের ভার। রাজ্যের কাছে এ এক চরম বিপর্যয়। উচ্চশিক্ষা, চিকিৎসা, সরকারি পরিষেবা, দরিদ্রের জীবিকা— সর্বত্র নিশ্চিন্তে নিরাপদে বিরাজ করছে ভীতিপ্রদর্শনের সংস্কৃতি।

আরও পড়ুন