ঘন ধোঁয়াশায় ঢাকা চার পাশ, কাশি, শ্বাসকষ্ট, চোখের সমস্যা— গত কয়েক দিনে দিল্লির নাভিশ্বাস উঠেছে। অথচ, এই অবস্থাতেও সংসদের শীতকালীন অধিবেশনের আলোচনায় ব্রাত্য থেকে গেল দিল্লির বায়ুদূষণ। অধিবেশনের শেষ দিকের কার্যসূচিতে দিল্লির দূষণ নিয়ে আলোচনা জায়গা করে নিয়েছিল। বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধীর দাবি মেনে আলোচনায় সায় দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকারও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। ‘বিকশিত ভারত জি-রাম জি’ বিল নিয়ে বিরোধীদের বিক্ষোভ, অতঃপর সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবাদে সরকারের বিল পাশ এবং অচিরেই গোটা দিনের জন্য অধিবেশন মুলতুবি। শেষ দিনের পরিস্থিতিও কিছু আলাদা ছিল না। উল্টে সংসদে সরকার দাবি করল, বায়ুদূষণের কারণে ফুসফুস বা শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা তৈরি হচ্ছে, এমন তথ্য সরকারের কাছে নেই।
ইতিপূর্বেও বিভিন্ন সমীক্ষায় বিশ্বের দূষণ তালিকায় ভারতের ক্রম অবনমনের প্রমাণ মিলেছে, এই সরকার আগাগোড়া তাকে অস্বীকার করেছে। এই অধিবেশনেও সংসদে দূষণ বিষয়ক আলোচনাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল একেবারে শেষ পর্যায়ে— হয়তো ‘অনির্দিষ্ট কালের জন্য মুলতুবি’ করার সম্ভাবনার কথা ভেবেই। সরকারপক্ষ বলল, বিরোধীদের হল্লার কারণেই অধিবেশন মুলতুবি করে দিতে হয়েছে। বাদ পড়েছে দূষণ বিষয়ক আলোচনা। অবশ্য এই কুযুক্তি প্রদান ভিন্ন কেন্দ্রের অন্য পথ নেই। দিল্লিতে এখন তাদেরই সরকার। বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে যে দলের অন্যতম প্রচার হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল দিল্লির ধারাবাহিক বায়ুদূষণ। অথচ, রেখা গুপ্তের সরকারের বর্ষপূর্তির পথে চমকটুকুই সার— কখনও কৃত্রিম ভাবে বৃষ্টি নামানোর প্রচেষ্টা, কখনও দশ হাজার সরকারি স্কুলের ক্লাসরুমে বাতাস পরিশোধক যন্ত্র বসানোর কথা ঘোষণা। কিন্তু যে সমস্যা দীর্ঘকালীন, তার মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি, বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনা কোথায়? কেন নির্মল শ্বাস নেওয়ার দাবিতে মানুষকে পথে নেমে বিক্ষোভ দেখাতে হবে? সংসদে দূষণের প্রসঙ্গ উঠলে এই চূড়ান্ত ব্যর্থতার খতিয়ানও প্রকাশ্যে আসত। শাসক দল সচেতন ভাবেই বিরোধীদের ‘হল্লা’কে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেছে।
দূষণের সমস্যা দিল্লিতে সর্বাধিক হলেও অন্য শহরগুলিতে কিছু কম নয়। সেখানে দূষণ সংক্রান্ত নীতি তবে কী হবে? ভারত এমনই এক দেশ, যেখানে বিভিন্ন সময়ে পরিবেশ সংক্রান্ত ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা সতর্কবার্তা, পরামর্শ দিলেও তাকে গ্রাহ্য করা হয় না সঙ্কীর্ণ রাজনীতির প্রয়োজনে। বিরোধীরাও হামেশাই নীরব দর্শক হয়ে থাকেন। বিরোধীদের ভূমিকা শুধুমাত্র দূষণ বিষয়ে সংসদে আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, পরিবেশ নিয়ে এ দেশে সরকার যা করছে, যা করছে না, এবং যা করা উচিত— সামগ্রিক ভাবে তার পর্যালোচনাটিও তাঁদেরই দায়িত্ব, বছরভর। প্রয়োজনে পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়গুলি নিয়ে পথে নেমে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধিও তাঁদের দায়িত্ব। অথচ, ২০২২-২৪ সালের মধ্যে দিল্লির ছ’টি সরকারি হাসপাতালে দু’লক্ষের বেশি মানুষ শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ে ভর্তি হয়েছেন, এমন তথ্য হাতে থাকা সত্ত্বেও, তাঁরা মূলত নিন্দা-কটাক্ষেই নিজেদের আবদ্ধ রেখেছেন। বিষবাষ্প রাজনীতির গণ্ডি মানে না, শাসক-বিরোধী বিভেদও করে না— ভারতের বিরোধী রাজনীতি তা জানে কি?