ভারত এবং পাকিস্তানের সমর্থক। ফাইল চিত্র।
লোকব্যবহারের অঙ্গ অনেক কিছুরই রয়েছে বৃহত্তর অর্থ। যেমন করমর্দন— রাজনীতি-কূটনীতি আর খেলায় তার সবিশেষ প্রয়োগ দেখা যায়— দুই ‘চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী’ দেশের নেতা বা খেলোয়াড়রাও বৈঠক বা ম্যাচ শেষে হাত মেলান। তা এই বার্তা দিতেই যে, মতান্তর যতই থাক, মনান্তর যেন না থাকে; রাজনৈতিক বা সামরিক দ্বন্দ্ব ও খেলার জয়-পরাজয় পিছনে ফেলে মানবিক শিষ্টতা ও সৌজন্য যেন অক্ষুণ্ণ থাকে। কিন্তু এশিয়া কাপে ভারত-পাকিস্তানের দু’টি ম্যাচে সেই ভব্যতা প্রশ্নের মুখে পড়ল। গ্রুপ পর্বে ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে টসের পর ভারতীয় দলের অধিনাক পাক অধিনায়কের সঙ্গে হাত মেলাননি, এমনকি ম্যাচে জয়ের পর যে দলবদ্ধ করমর্দনের প্রথাটি প্রচলিত, তা-ও হয়নি। ম্যাচের পর ভারতীয় দলের সাজঘরের দরজাও ছিল বন্ধ, খাঁটি ক্রিকেটপ্রেমীদের তার অর্থটি বিলক্ষণ জানা। ক্রিকেটমহলে এই নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় হলেও ছবিটা যে পাল্টায়নি, বোঝা গেল রবিবার সুপার ফোর পর্বেও: টসের পরে বা ম্যাচ শেষেও ভারতীয় অধিনায়ক ও তাঁর দল বিপক্ষের সঙ্গে হাত মেলালেন না।
খেলা আর শুধু খেলা নেই, হয়ে উঠেছে রাজনীতির শিকার— এ-ই কি তবে সত্য? দুই দেশের রাজনীতির বিভাজন কি ক্রিকেটকেও চালিত করবে? আগের ম্যাচের জয় ভারতীয় অধিনায়ক উৎসর্গ করেছিলেন ‘পহেলগামের শিকার’ মানুষকে, সঙ্গে ভারতীয় সেনাকেও। উৎসর্গে দোষ নেই, খেলার মাঠের বাইরে বৃহত্তর জীবনের প্রতি তা শ্রদ্ধা প্রদর্শন। সেই শ্রদ্ধা আরও আন্তরিক হত, প্রকৃত খেলোয়াড়সুলভ মনোভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের সঙ্গে করমর্দনের শ্রদ্ধাও দেখানো গেলে। তাতে এই স্পষ্ট বার্তা দেওয়া যেত: আমরা ক্রিকেটের ‘স্পিরিট’ বজায় রেখে, বিপক্ষের ক্রীড়াদক্ষতাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে করমর্দন করলাম, তেমনই পহেলগাম মনে রেখে দেশের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রমাণ রাখলাম। হাত না মেলানো যদি প্রতিপক্ষ দেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়, তা হলে তাদের সঙ্গে ক্রিকেট না খেলাই তো হতে পারত সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ। মাঠে নামা গেল, অথচ হাত মেলানোর ভদ্রতাটুকু দেখানো গেল না— এ কি এক ধরনের সুবিধাবাদ, দ্বিচারিতা নয়?
ক্রিকেটকে একদা বলা হত ‘জেন্টলম্যান’স গেম’। এই অভিধার মধ্যে পশ্চিমি সাহেবি শ্রেণিগন্ধ আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু এই সত্যটিও রয়েছে: খেলা শুধুই খেলা নয়; জীবনচর্যা, লোকব্যবহারেরও কষ্টিপাথর। দুর্ভাগ্যের কথা, আজকের সময়ে ক্রীড়াক্ষেত্রও হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভেদের ভূমি। ক্রিকেটাররাও খেলার মাঠে সেই বিভেদ টেনে আনছেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে— রবিবারের ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি করে এক পাক ক্রিকেটার ‘গানশট সেলিব্রেশন’ করেছেন, ফিল্ডিংরত এক পাক ক্রিকেটার দর্শক-গ্যালারির উদ্দেশে হাতের মুদ্রায় দেখিয়েছেন ভারতের সামরিক বিমান ধ্বংসের ভঙ্গিমা। অর্থাৎ রাজনীতিকরা বছরভর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে যে বিদ্বেষ-বিভাজনের বয়ান চারিয়ে দেন, সমাজে ও সমাজমাধ্যমে সাধারণ নাগরিকেরা যে বিষকুম্ভ রোজ চালাচালি করেন, ক্রিকেটাররাও সে কাজ করে যাচ্ছেন খেলার মাঠে। করমর্দন বয়কটেও তারই প্রতিচ্ছবি। উপমহাদেশের জনপ্রিয়তম খেলাটি এ ভাবেই বর্তমানের অনুদার রাজনীতির সঙ্গে হাত মেলাল— জেনেবুঝেই।