এক বার দিল্লিতে অতিথি হয়ে এসেছেন বড়ে গুলাম আলি খাঁ। স্নান সেরে কুর্তা-পাজামা পরে খেতে বসলেন খাঁ সাহেব। রসুই থেকে বাটির পর বাটিতে খাবার আসছে টেবিলে— খাঁ সাহেব দেখছেন, এবং ক্রমে তাঁর মুখ বেজার হচ্ছে। শেষ অবধি যখন বুঝলেন, তাঁর থালার চার পাশে সাজিয়ে দেওয়া গোটা সাত-আটেক বাটির একটিতেও কোনও আমিষ পদ নেই, তখন হতাশ হয়ে থালাটা খানিক দূরে ঠেলে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ইয়ে খানা, অউর য়ো গানা!”— এই খাবার খেয়ে কি আর আমার গলা দিয়ে ওই গান বেরোবে? শীলা ধর তাঁর রাগ-এন-জোশ বইয়ে এই ঘটনার এক অকল্পনীয় বর্ণনা দিয়ে জানিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত সেই নিরামিষাশী গৃহকর্তার বাড়ির বাগানে ইটের উনুন তৈরি করে খাঁ সাহেব নিজেই মাংস রান্না করেছিলেন। গল্পটি যাঁরা জানেন, দিল্লির আর এক নৈশভোজের আসর দেখে তাঁদের মুখে মুচকি হাসি আসাই স্বাভাবিক। ভ্লাদিমির পুতিন সম্ভবত খাঁ সাহেবের মতো সরল মনের মানুষ নন, তা ছাড়া রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে তাঁকে কূটনৈতিক সৌজন্য বজায় রেখে চলতেই হয়— ফলে দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসের লনে আলাদা করে উনুন পাতার প্রয়োজন পড়েনি। কিন্তু, তাঁর সম্মানে আয়োজিত নৈশভোজের খাদ্যতালিকা দেখে বিস্মিত হওয়া স্বাভাবিক। ছোলার কাবাব, মেথি আর পালংশাক দিয়ে কড়াইশুঁটির ঝোল, তন্দুরি আলু, আচার দিয়ে রান্না করা বেগুন— এমন পনেরোটি পদ দিয়ে পুতিনকে খাওয়াল ভারত। রুশ মুখে এই খাবার কেমন ঠেকল, কে বা জানে— তবে, কোনও গড়পড়তা বঙ্গসন্তান নেমন্তন্নবাড়িতে গিয়ে এমন খাবার পেলে সম্ভবত বাড়ি ফিরে আবার খেতেন, এবং আর কোনও দিন ওই বাড়িতে নেমন্তন্ন না খেতে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করতেন।
তবে, এই ঘটনাটিকে হেসে উড়িয়ে দিলে তার গূঢ় তাৎপর্য বুঝতে ভুল হবে। ভারত দেশটি কেমন, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সে বিষয়ে একটি অপরিবর্তনীয় ধারণা রয়েছে। ধারণাটি আমূল ভ্রান্ত, কারণ তা ভারতের চরিত্রগত বহুত্বকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে চায়। শাসক তাঁর রাষ্ট্রক্ষমতার জোরে সেই ভ্রান্ত ধারণটিকেই ‘ভারত’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া। তাঁদের হিসাবে, ভারত নিরামিষাশীর দেশ। এই বিশ্বাসটি আদৌ ধোপে টিকবে না— ভারতের তিন-চতুর্থাংশ মানুষ আমিষাশী, এবং একাধিক রাজ্যে কার্যত সব মানুষই আমিষ খান। সংখ্যার হিসাবই বলছে, এই আমিষাশী জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। ফলে, গৈরিক জাতীয়তাবাদীরা তাঁদের হিন্দুরাষ্ট্রের যে কল্পনা করেন, দেশের হিন্দু জনসংখ্যারও একটি বড় অংশ তার শরিক নন। তার চেয়েও বড় কথা, নিরামিষ ভক্ষণের প্রবণতা বেশি উচ্চবর্ণের মানুষদের মধ্যে— মনুবাদী ভাবনায় শুধু তাঁরাই ‘প্রকৃত’ হিন্দু হিসাবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য। বিদেশি অতিথির সামনে ভারতীয় সংস্কৃতির নামে কেন্দ্রীয় সরকার যা সাজিয়ে দিল, তা আসলে এই সাবর্ণ হিন্দু সমাজের সংস্কৃতি— ভারতের সাংস্কৃতিক বহুত্বের একটি ক্ষুদ্র অংশমাত্র, কোনও মতেই তার সামগ্রিক প্রতিফলন নয়। ভ্লাদিমির পুতিনের ভোজসভার খাদ্যতালিকা নিয়ে রসিকতা করেই কাজ সেরে দিলে এই কথাটি চোখের আড়ালে থেকে যায়। বহুত্বকে বাদ দিলে যে ভারতীয়ত্বও থাকে না, এই কথাটি বারে বারে মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।