শীতজোড়া বিয়ের মরসুমকে কলকাতার মানুষ এ-যাবৎ পছন্দই করতেন। কিন্তু, লক্ষ করা যাচ্ছে, বিগত কয়েক বছর ধরেই বিয়ের উৎসব বিবিধ শিরঃপীড়ার উৎস হয়ে উঠছে। এর অন্যতম কারণ, কিছু অনুষ্ঠান নানা ভাবে ট্র্যাফিক বিধি ভঙ্গ করতে শুরু করেছে। কলকাতার বেশ কিছু রাস্তা এই নতুন উৎপাতে ভুক্তভোগী। উত্তর ও পূর্ব কলকাতাকে সচল ও সংযুক্ত রাখতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শোভাবাজার-গ্রে স্ট্রিট-হাতিবাগান এলাকার পথ আটকে সন্ধ্যায় বার হচ্ছে বিয়ের শোভাযাত্রা। সঙ্গে সাউন্ড বক্স, বাজির অত্যাচার। সারি সারি বাস, অটো ও অন্যান্য যান আটকে যাঁরা ভিড়ের মধ্যে নাচগান-হইহল্লায় আমোদে মেতেছেন, তাঁরা যে শুধুই নিত্যযাত্রী বা কাজফেরত শ্রান্ত মানুষকে শান্তির নীড়ে ফিরতে বাধা দিয়ে নাগরিক দুর্ভোগের কারণ হচ্ছেন তা-ই নয়, জরুরিকালীন পরিষেবার পথ আটকেও চূড়ান্ত বোধহীনতার পরিচয় দিচ্ছেন। এই যত্রতত্র ‘ভূতের নৃত্য’-এর কুশীলবদের দৃঢ় বিশ্বাস, অন্যের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। অতএব এই উপদ্রবকে এখনই বন্ধ করতে কড়া শাস্তি, জরিমানার আওতায় এনে প্রশাসনের এঁদের বার্তা দেওয়া উচিত যে ব্যক্তিগত কারণে গণপরিসর ব্যবহার, তা দখল করা ও সহনাগরিকের শান্তি ভঙ্গ করা অন্যায়।
প্রসঙ্গত মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, রাস্তার উপরে শোভাযাত্রা, বাদ্যযন্ত্র, লাউডস্পিকারের ব্যবহার দুর্গাপুজো, ইদ, বড়দিন প্রভৃতি ধর্মীয় বা নববর্ষের প্রভাতফেরির মতো সাংস্কৃতিক উৎসবে দেখা গেলেও তা কত দূর সঙ্গত, এই নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু এগুলি তো সর্বতোভাবে জনগণেরই অনুষ্ঠান। তাই, সব দিক খতিয়ে দেখে কিছু নিয়মবিধি মোতাবেক গণপরিসর ব্যবহারের অনুমতি ও প্রচলন রয়েছে। কিন্তু বিয়ে একান্তই দু’টি পরিবারের ব্যক্তিগত পরিসরের উদ্যাপন। তার জন্য কোনও ভাবে সাধারণের ব্যবহার্য রাস্তা রোধ করে যান চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করা যায় না। তার সঙ্গে আগুন বা বাজি নিয়ে খেলা, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির অবাধ ব্যবহার, ডিজে-র বাজনা মানুষের স্বাস্থ্য, এমনকি প্রাণহানিরও আশঙ্কা বাড়ায়। পরিবেশের ক্ষতি করে। দেশের যে শহরেই এই ধরনের বিয়ের শোভাযাত্রার রেওয়াজ রয়েছে সেখানে প্রশাসন ও পুলিশের থেকে অনুমতি নেওয়ার ও কিছু নিয়মের বাধ্যবাধ্যকতা রয়েছে। এ শহরের পুলিশ ও প্রশাসনের থেকেও অনুরূপ কঠোরতা কাম্য, নাগরিক অসংবেদনশীল হলে পুলিশকে তাঁদের নিরস্ত করতেই হবে।
শব্দবাজি শুধু দীপাবলির সময়ই নয়, সারা বছর জুড়েই নিষিদ্ধ, বেআইনি কাজ। অতএব, দীপাবলির সময় পুলিশ যে ভাবে শব্দবাজি নিয়ন্ত্রণ করে, মরসুমি যে তৎপরতা দেখা যায়, সেই সক্রিয়তাই বা বিয়েবাড়ির ক্ষেত্রে থাকবে না কেন? এ ধরনের উৎসব-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও ১৯৮৬-র পরিবেশ (সুরক্ষা) আইন মোতাবেক শব্দদূষণের নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত বিধি অনুযায়ী শব্দ অনুমোদিত সীমার মধ্যে থাকার ও এ বিষয়ে পুলিশকে অবগত করে রাখার কথা। তা মানা হয়েছে কি না তা পুলিশ নজর রাখবে এবং আইন ভঙ্গ করলেই অকুস্থলে গিয়ে গ্রেফতারি সুনিশ্চিত করতে হবে। সভ্য আধুনিক শহরে ব্যক্তিগত আনন্দানুষ্ঠান কখনওই অন্যের নিরানন্দের কারণ হতে পারে না, তা যাতে না হয় তার জন্য সামাজিক দায়বদ্ধতা ও প্রশাসনের স্পষ্ট নির্দেশিকা দুই-ই জরুরি।