এত ছলচাতুরির কী আছে, সেটুকুই শুধু বিস্ময়। গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনার শিরোনাম থেকে মহাত্মা গান্ধীকে ছেঁটে ‘রাম জি’-কে প্রতিষ্ঠা করার বাসনা হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রপ্রধানদের হতেই পারে— তাঁরা একেবারে সাভারকর বা দীনদয়াল উপাধ্যায়ের নাম বসিয়ে দেননি, এতেই ভারতবাসীর কৃতজ্ঞ থাকার কথা। ঘটনা হল, আইনসভায় সদস্যসংখ্যার জোরে তাঁদের ইচ্ছাই ইচ্ছা— দুর্জনে বলবে, দেশের যাবতীয় সাংবিধানিক, তথাকথিত স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের শীর্ষেও তাঁরা যে পরিমাণ নিজেদের লোক বসিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন, তাতে কোনও ক্ষমতাকেন্দ্র থেকেই তাঁদের দৌরাত্ম্যে কেউ বাধা দেবেন না। তা হলে, নামের সংক্ষিপ্ত রূপটিতে ‘রাম জি’-কে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এত ঘোরপ্যাঁচ, এত দাঁড়ি-কমা-ড্যাশ-সেমিকোলনের প্রয়োজন হল কেন? এই প্রশ্নের উত্তর নিছক রাজনৈতিক নয়, মনস্তাত্ত্বিকও বটে। ইতিহাস সাক্ষী, একাধিপত্যকামী শাসক যত দিন অন্তত আপাত-গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে থাকেন, তত দিন অবধি তাঁকে জনগণের কাছে নিয়মিত একটি বার্তা দিয়ে যেতে হয়— এই বার্তা যে, তিনি গণতান্ত্রিক রীতি, নিয়মকানুন এবং সৌজন্যকে দুমড়ে-মুচড়ে নিজের ইচ্ছায় পথ চলার কৌশলটি জানেন। সরাসরি যে নাম চাপিয়ে দেওয়া যেত, কষ্টসাধ্য ‘অ্যাক্রোনিম’ তৈরি করে ঘুরপথে সে নামটি চালু করার মধ্যে যে ‘কেমন দিলাম’ ভাবটি আছে, সেটি গণতন্ত্রের দর্শক-শ্রোতাদের উদ্দেশে নিবেদিত। আরও একটি কারণ বিলক্ষণ আছে— বিরোধীরা এই নাম সম্বন্ধে আপত্তি করলেই বলা যাবে যে, রামের নামে যাদের আপত্তি, তারা পাকিস্তানে চলে গেলেই পারে। অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে, গৈরিক জাতীয়তাবাদী কল্পনার হিন্দুরাষ্ট্রের পথে এটি একটি অতি তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ— ভক্তদের ভাষায়, ‘মাস্টারস্ট্রোক’। যে প্রকল্পটি দেশের বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষের জীবনধারণের অন্যতম সহায়ক, তারই এমন রাজনৈতিক ব্যবহার নৈতিকতার কোনও মাপকাঠিতেই উতরোবে না, কিন্তু ‘মাস্টারস্ট্রোক’ আর কবেই বা নৈতিকতার তোয়াক্কা করেছে!
রাম হোক বা গোলওয়ালকর, প্রকল্পে যাঁর নামই থাকুক না কেন, প্রকল্পের চরিত্রটি যদি অপরিবর্তিত থাকত, তবে বিতর্কটি থাকত শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্তরে। কিন্তু, নাম বদলের অন্তরালে কেন্দ্রীয় সরকার পাল্টে দিল প্রকল্পটির চরিত্রই— ফলে, বিতর্কটি এখন উন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতির অভিমুখ, বা অভিমুখহীনতা নিয়ে। একশো দিনের কাজ প্রকল্পের প্রধান চরিত্র ছিল, প্রকল্পটি চাহিদা-নির্ভর। অর্থাৎ, স্থানীয় ভাবে যত কাজের চাহিদা থাকবে, রাজ্য স্তরে সেই কাজ দেওয়ার অধিকার ছিল। কেন্দ্রীয় সরকার সে অনুসারে রাজ্যকে টাকা দিত। এখন নিয়ম পাল্টে রাজ্যওয়ারি অর্থ বরাদ্দের রাশটি কেন্দ্রীয় সরকার নিজের হাতে রাখল— কোন রাজ্যে কত মানুষ কাজ চাইছেন, সেই প্রশ্নটি গুরুত্বহীন হয়ে গেল। আইনটির একেবারে গোড়ায় যে অধিকারের প্রশ্ন ছিল, অর্থাৎ মানুষ কাজ চাইলে রাষ্ট্র সে কাজের ব্যবস্থা করতে আইনত বাধ্য— বর্তমান সংশোধনে কেন্দ্রীয় সরকার মানুষের সেই অধিকারটি প্রত্যাহার করে নিল। ইউপিএ আমলে এই প্রকল্প রূপায়ণের ক্ষেত্রে যাঁরা ভূমিকা নিয়েছিলেন, তাঁদের এক জন, অধ্যাপক জঁ দ্রেজ় বলেছেন, এটি এমন একটি গ্যারান্টি আইনে পরিণত হল, যেখানে সরকার তার গ্যারান্টি রক্ষা করবে কি না, তার কোনও গ্যারান্টি নেই! ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নরেন্দ্র মোদীর চক্ষুশূল ছিল এই প্রকল্প— এত দিনে তার কোমরটি সম্পূর্ণ ভেঙে দেওয়া গেল। নতুন আইন বলছে, একশো দিনের বদলে সর্বাধিক ১২৫ দিনের কাজ দেওয়া হবে। তার গ্যারান্টির কথাটি যদি ছেড়েও দেওয়া হয়, তবুও প্রশ্ন— রাজ্যের ঘাড়ে প্রকল্পের ৪০% খরচ চাপিয়ে দেওয়া হল কোন বিবেচনায়? যেখানে রাজ্যগুলির নিজস্ব রাজস্ব আদায়ের পথ কার্যত বন্ধ, সেখানে একের পর এক কেন্দ্রীয় প্রকল্পের আংশিক দায় রাজ্যের উপরে চাপিয়ে ঠিক কোন উন্নয়ননীতির পথে হাঁটছে কেন্দ্রীয় সরকার?