Satyajit Ray

‘শোনো ছোট মেয়ে, সন্ধের পর আমার ঘরের দিকে যাবে না’, অলকনন্দাকে বলেছিলেন ছবি বিশ্বাস

‘‘নিজের মেয়ের প্রতি বাবাদের যে পিতৃসুলভ আচরণ, সেটাই ওঁর মধ্যে দেখেছিলাম। আমায় ছুঁয়ে গিয়েছিল।’’

Advertisement
অলকনন্দা রায়
শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০২৫ ০৯:০৭
‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিতে অলকনন্দা রায়, ছবি বিশ্বাস।

‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিতে অলকনন্দা রায়, ছবি বিশ্বাস। ছবি: সংগৃহীত।

ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে মাত্র একটাই কাজ আমার। সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’। ছবিতে আমি ওঁর ছোট মেয়ে। আমি তখন ১৭, ছবিবাবু ৬০। ভীষণ অভিজাত চেহারা। তার উপরে ব্যক্তিত্বের ছটা। হাঁটাচলা ভীষণ ঝকঝকে, স্মার্ট।

Advertisement

সত্যজিৎবাবুর সঙ্গে পুরো টিম শৈলশহর দার্জিলিঙে। পাহাড়ি অঞ্চলের হোটেলের লম্বা করিডরে সারি দেওয়া ঘর। আমরা সেখানে উঠেছি। ছবিবাবু যে দিন এলেন সে দিন আমার শুটিং নেই। আমি তখনও শুটিং কী— সেটা জানতাম না। তাই পরিচালক দু’দিন আগে আমায় নিয়ে এসেছিলেন, যাতে আমি ধাতস্থ হতে পারি।

ছবিবাবু এসেছেন শুনে সকলের সঙ্গে আমিও বেরিয়ে এলাম। তার পর পায়ে হাত দিয়ে ঢিপ করে প্রণাম করলাম। উনি আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘‘তুমি কে?’’ সে সময়ের ছেলেপুলেরা তো একটু ডেঁপো হত। একটু কায়দা করে বলেছিলাম, ‘‘আপনার ছোট মেয়ে।’’ মানে, ওঁর ছোট মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করব। নিজের নাম না বলে ঘুরিয়ে সেটাই বলেছিলাম। উনি বললেন, ‘‘অ।’’ একটু থেমে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘ছোট মেয়ে, তুমি কোন ঘরে থাকো? ’’ নিজের ঘরটা দেখিয়ে বললাম, ‘‘এই ঘরটা।’’ ছবিবাবু অল্প ঘাড় ঘুরিয়ে সঙ্গের লোকেদের বললেন, ‘‘আমি কোথায় থাকব? ’’ ওঁরা ঘর দেখিয়ে দিয়ে জানালেন, সামনের দিকে দুটো ঘরের পরে।

 ‘জলসাঘর’ ছবিতে ছবি বিশ্বাস।

‘জলসাঘর’ ছবিতে ছবি বিশ্বাস। ছবি: সংগৃহীত।

ছবিবাবু আবার আমার দিকে ফিরলেন, ‘‘শোনো ছোট মেয়ে, সন্ধের পর আমার ঘরের দিকে যাবে না। কেমন? ’’ আমার হাতে বই। সামনে স্নাতক পরীক্ষা। সময় পেলেই পড়ছি। ‘‘যাও, পড়াশোনা করো’’, হাতে বই দেখে বললেন। বলতে বলতে চলে গেলেন নিজের ঘরে। আমি তখন ওঁর নিষেধের মানে বুঝিনি। পরে দেখলাম, সন্ধেবেলায় বোতল-গ্লাস সাজিয়ে ওঁর ঘরে আড্ডার আসর বসে। অনেকে সেখানে যোগ দেন। সেই জন্যই নিষেধ। এই পিতৃসুলভ আচরণ আমার খুব মিষ্টি লেগেছিল। মনে হল, আমায় প্রথম আলাপে এটা না বলতেই পারতেন। অন্য আরও অনেক কথা বলতে পারতেন। ছবিবাবু কিন্তু সেটা করেননি।

আর একটা দিনের ঘটনা বলি। ছবিতে আমার নায়ক অরুণ মুখোপাধ্যায়। শাড়ির উপরে লম্বা একটা কোট পরে শুট করছি। শট শেষ হলেই খুলে রাখছি। এ রকমই এক বার পাশে খুলে রাখা কোট পরে শট দিতে যাব। পাশে অরুণ আর ছবিবাবু দাঁড়িয়ে। আমি নিজেই কোট পরতে গিয়েছি। ছবিবাবু বাধা দিয়ে অরুণকে বললেন, ‘‘ওহে ইয়ং ম্যান, এ দিকে এসো। তুমি বাংলা ছবির নায়ক হতে এসেছ তো? মহিলারা তোমার সামনে কোট পরবেন নিজে নিজে আর তুমি বসে থাকবে— সেটা তো হবে না। দেখো কী করতে হয়।’’ বলে উনি আমায় নিজের হাতে কোটটা পরিয়ে দিলেন। অরুণ বেচারা মধ্যবিত্ত ঘরের শিক্ষিত। অত জানতেন না। আমাদের সাহেব বাড়ি। কিন্তু এই আদবকায়দা আমিও জানতাম না। সেটা শেখাতে গিয়ে ছবি বিশ্বাস নিজের হাতে আমায় কোট পরিয়ে দিলেন, এটাই আমার সারা জীবনের পাওনা।

আমাদের বাড়িতে সাহেবি কায়দার চল ছিল বলেই বাংলা ছবি দেখার অনুমতি ছিল না। ফলে ছবিবাবুর কোনও ছবি দেখিনি। কেবল সত্যজিৎ রায়ের ‘দেবী’ আর ‘জলসাঘর’ ছাড়া। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’য় অভিনয়ের আগে ওই ছবি দুটো দেখেছিলাম। আজও আমায় দ্বিতীয় ছবিটি টানে। ছবির গল্প ছবিবাবুকে ঘিরে। ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বংশের শেষ প্রতিনিধি। আভিজাত্য ধরে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা। ওই চরিত্রে কেবল ওঁকেই মানায়। ওই অভিনয় ছবি বিশ্বাস ছাড়া আর কারও ফুটিয়ে তোলার সাধ্য ছিল না।

Advertisement
আরও পড়ুন