Sandip Ray about Bansi Chandragupta

সবাই বলেছিল সূর্যের আলোয় ছবি করা যায় না, বাবার পাশে ছিলেন শুধু বংশীকাকু, তৈরি হল ‘পথের পাঁচালী’

‘পথের পাঁচালী’ থেকে ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’— সত্যজিৎ রায়ের তাবড় সৃষ্টির দোসর বংশী চন্দ্রগুপ্ত প্রয়াত হয়েছিলেন আমেরিকায়, সত্যজিতের রেট্রোস্পেক্টিভ-এ যোগ দিতে গিয়ে, ১৯৮১ সালের ২৭ জুন।

Advertisement
সন্দীপ রায়
শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০২৫ ০৯:০৩
Satyajit Ray\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\'s son Sandip Ray pens for legendary art director and production designer Bansi Chandragupta on his death anniversary

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম। ছবি: সংগৃহীত।

বংশীকাকু। বংশী চন্দ্রগুপ্ত। ‘পথের পাঁচালী’ থেকে ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’— বাবার অধিকাংশ ছবির শিল্প নির্দেশক। বাবা ঠিক করলেন ‘পথের পাঁচালী’ করবেন। শুনেই সুব্রত মিত্র আমাদের বাড়িতে। বংশীকাকু প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে বললেন, “এ বার একটা সিনেমা হোক। নতুন কিছু হোক। বেশির ভাগ থিয়েটার হয়ে যাচ্ছে।”

Advertisement

বাবা, সুব্রত মিত্র, বংশীকাকু তিন জনেই অঁরি কার্তিয়ে-ব্রেসেঁর ভক্ত। তিন জনেই চাইছেন প্রাকৃতিক আলোয় ‘পথের পাঁচালী’ শুট করা হোক। অন্য দিকে ‘পথের পাঁচালী’ প্রসঙ্গে অধিকাংশ প্রযোজকেরা প্রশ্ন তুলছেন, বলছেন, কোনও ভাবেই প্রাকৃতিক আলোয় এই ছবি শুটিং করা যাবে না। অপেশাদারদের নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রেও তাঁরা আপত্তি তুলছেন, কিন্তু বাবা তো সে সব কিছু না শুনে উল্টো পথেই হেঁটেছিলেন। কোথায় কী ভাবে ওই ছবি শুট হল, সেটা তো আজ অধিকাংশ মানুষের জানা।

কিন্তু বাবা যে উল্টো পথে যেতে পেরেছিলেন তার অনেকটাই বংশীকাকুর উপর নির্ভর করে। কাশ্মীর থেকে আসা এই শিল্পীর দেখার চোখ ছিল অসাধারণ। আর বিভূতিভূষণের লেখায় তো সেট তৈরিই হয়েছিল। আলাদা করে ভাবতে হয়নি বাবা অথবা বংশীকাকুকে। আমার মনে আছে ‘পথের পাঁচালী’ প্রসঙ্গে বাবা বলেছিলেন, শুধু সেট ডিজ়াইনিং নয়, ছবির সংলাপ লিখতেও তাঁকে সাহায্য করেছিলেন বিভূতিভূষণ। বাবা তখনও সংলাপ লেখায় সড়গড় হননি, ফলে পথের পাঁচালীর অধিকাংশ সংলাপ বিভূতিভূষণের লেখা থেকে ব্যবহৃত।

Satyajit Ray's son Sandip Ray pens for legendary art director and production designer Bansi Chandragupta on his death anniversary

বংশী চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়। ছবি: সংগৃহীত।

ছবি তৈরির সময় বাইরে শুটিং শুরু হলেও বাড়ির ভিতরের দৃশ্য তৈরি করার ক্ষেত্রে প্রচুর সেটের কাজ থাকত। সেটে দিন, রাত সব দেখানো যায়, সেটাও একটা বাড়তি সুবিধে ছিল। বংশীকাকু এমন ভাবে সেট তৈরি করতে শুরু করলেন, মানুষ বুঝতে পারত না কোনটা আসল, কোনটা নকল। ‘পথের পাঁচালী’র কুঁড়ে ঘরও করছেন আবার শতরঞ্জ কে খিলাড়ির রাজদরবারও করছেন, আবার শুন্ডি রাজা বা হাল্লা রাজার দরবারও করছেন। এই যে বিভিন্ন ধারা, সব কিন্তু নিখুঁত ভাবে হত। বাবা প্রাথমিক কাঠামো এঁকে দিতেন। বাবা নিজেও তো শিল্পী ছিলেন। বাকিটা বংশীকাকুর দায়িত্ব। ফিল্মে কোনও কিছু যে ফাঁকি দিয়ে বা প্রতারণা করে কিছু দেখানো যেতে পারে— তা বিশ্বাসই করতেন না বংশীকাকু।

বংশীকাকু বাবার সঙ্গে একের পর এক ছবির কাজ করতে শুরু করলেন। এমন সেট তৈরি করলেন যে, মানুষ শুধু বংশীকাকুর সেট দেখতেই আসতেন। তখন স্টুডিয়োর নিরাপত্তা পেরিয়ে সাধারণ মানুষের ঢুকে পড়া সহজ ছিল না। কিন্তু কিছু মানুষ ছিলেন, যাঁদের স্টুডিয়োয় যাতায়াত ছিল। তাঁরা বাইরে থেকে আরও লোক নিয়ে আসতেন বংশীকাকুর তৈরি সেট দেখার জন্য। সে সময় শুন্ডি রাজার সেট দেখার জন্য মানুষের কী ভিড়! ভীষণ খুঁতখুঁতে ছিলেন। নিজে হাতে অনেক জিনিস করতেন যেটা সচরাচর শিল্প নির্দেশকেরা করেন না। ওঁকে দেওয়ালে ঠোকাঠুকি করতেও দেখেছি। আবার প্রয়োজনে রিফ্লেক্টর নিয়ে দাঁড়াতে দেখেছি। নিজের কাজের জন্য অহঙ্কার করতে কোনও দিন দেখিনি।

বাবার সঙ্গে অদ্ভুত ভাবে মিশে গিয়েছিলেন। বাবার সঙ্গে কাজ করা তো সহজ নয়। বাবা কী চাইছেন সেটা বুঝে কাজ করা, সফল হওয়া সহজ কথা নয়। দেখেছি, ওঁর খুঁটিনাটির জিনিসের প্রতি খুব লক্ষ ছিল, ‘নায়ক’-এর ট্রেনের সেটের কথাই ধরা যাক। কেউ বুঝতে পারবে কোনটা সত্যি ভেস্টেব্‌ল আর কোনটা স্টুডিয়ো?

Satyajit Ray's son Sandip Ray pens for legendary art director and production designer Bansi Chandragupta on his death anniversary

‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’র সেট। ছবি: সংগৃহীত।

ওই ইউনিটে বংশীকাকুর প্রথম স্টিল ক্যামেরা এল। ওই ক্যামেরা দিয়ে কত ছবি যে তুলেছেন, তার হিসাব নেই। তখন তো ইউনিটে আলাদা করে চিত্রগ্রাহক ছিল না। ‘পথের পাঁচালী’ শুটিং-এর যা স্থিরচিত্র আমরা দেখতে পাই তাঁর অধিকাংশ বংশীকাকুর তোলা। আর যে ছবিতে বংশীকাকুকে দেখি, ধরে নিই সেগুলি হয় সৌমেন্দু রায় অথবা, দীনেন গুপ্তর বা সুব্রত মিত্রের তোলা।

ছবির লোকেশন যে মুহূর্তে ঠিক হত, সেই মুহূর্তে দেখতাম বংশীকাকু একনাগাড়ে লোকেশনের ছবি তুলছেন। সেখানকার জানলা-দরজা কিছুই বাদ দিতেন না। সারা ক্ষণ হাতে ফিতে, এটা মাপছেন, ওটা মাপছেন, লোকেরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠত। আমি জানি না, বংশীকাকুর মতো শিল্প নির্দেশক আর তৈরি হয়েছে কি না!

বাবার সঙ্গে কাজ করতে করতেই বোম্বে থেকে ডাক এল বংশীকাকুর। বাবাও ওঁকে নির্দ্বিধায় যেতেই বললেন। বাবা জানতেন ওখানে তিনি যা পারিশ্রমিক পাবেন, তা কলকাতায় কোনও ভাবেই দেওয়া সম্ভব নয়। আমার মনে আছে, বংশীকাকু বলেছিলেন, “মানিক তোমার সঙ্গে কি আমার টাকার সম্পর্ক?” সত্যজিৎ রায়ের ইউনিটে বংশীকাকুই একমাত্র যিনি বাবাকে ‘মানিক’ বলে ডাকতেন। শুধু ইউনিটের লোক নয়। আমাদের পরিবারের একজন হয়ে উঠেছিলেন বংশীকাকু, তাঁর সহজ-সরল মনোভাবে।

Satyajit Ray's son Sandip Ray pens for legendary art director and production designer Bansi Chandragupta on his death anniversary

‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতে শুন্ডি রাজার দরবার। ছবি: সংগৃহীত।

‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবির সেট, শুন্ডি রাজার দরবার তৈরি হয়েছে। আমিও সেট দেখতে গিয়েছি। নিউ থিয়েটার্সের ফ্লোরে ঢুকছি, দেখি উত্তমবাবুও ঢুকছেন। তার আগে ‘চিড়িয়াখানা’ হয়ে গিয়েছে। আমাকে দেখেই বললেন, “এই যে বাবু কী ব্যাপার?” আমি জিগ্যেস করলাম , “আপনি এখানে!” বললেন “দেখি, বংশীদা কী সেট বানিয়েছে। ওর সেট নিয়ে খুব শুনছি।”

বংশীকাকুর সেট নিয়ে যেমন চারিদিকে কথা হত তেমনি ওঁর সেটে সবাই তটস্থ থাকত। বোম্বের পরিচালকেরা ওঁর সঙ্গে কাজ করার সময় খুব বুঝেশুনে শট নিতেন। এমন চমৎকার সেট, তা যেন ছবিতে ঠিকমতো প্রকাশ পায় সে দিকে তাঁদের বিশেষ নজর ছিল।

গুপী বাঘার ঘর তৈরি হয়েছে, শুন্ডি রাজ্যে ফোয়ারা চলছে। আমি শুটিং দেখছি। আচমকা দেখি আমার পাশেই খিল খিল করে হাসছেন তনুজা। পাশের ফ্লোরে কাজ করছিলেন, বংশীদার সেটের কথা শুনে দেখতে এসেছেন। তখন এক ইউনিট থেকে আর এক ইউনিটে চলে যাওয়া যেত, অন্যের কাজে মুগ্ধ হয়ে প্রশংসা করা যেত। এখন এ সব কিচ্ছু নেই!

‘নায়ক’-এর কথা বার বার লিখছি। ছবির ট্রেনের দৃশ্যে ভেস্টেব্‌লের ব্যবহার থাকবে জেনেই বংশীকাকু যেখানে ভেস্টেব্‌ল তৈরি হয়, সেই কারখানায় চলে গিয়ে ভেস্টেব্‌ল তৈরির সব জিনিস, এমনকি সেখানকার ব্যবহৃত অ্যাশট্রে অবধি নিয়ে এসেছিলেন। আমার পরিষ্কার মনে আছে বংশীকাকু বাবাকে বলেছিলেন, “আমি সেট এমন ভাবে তৈরি করব যেই তার নীচে ট্রাকের টায়ার রাখতে পারি, যাতে ট্রেনকে তুমি দোলাতে পারো। কয়েক জন লোককে নিয়ে সেট নাড়ালে সেট ট্রেনের মতোই নড়বে।”

আলোচনা তো হল। বাবা পরে ফ্লোরে গিয়ে দেখলেন সেট এত ভারী হয়ে গিয়েছে যে টায়ার দেওয়া যায়নি। ট্রেন তো নড়বে না! এই ভেবে বংশীকাকু সারা রাত ঘুমোতে পারেননি। বাবা বলেছিলেন, “আমি এমন ভাবে ক্যামেরায় শুট করব যে ট্রেন নড়ল কি না কেউ বুঝবে না।” হলও তাই। ‘নায়ক’ দেখার সময় ট্রেন নড়ছে কি না, আমরা কেউ মাথা ঘামাইনি।

বাবা প্রায়ই গোপালপুরে যেতেন। একবার ওখান থেকেই বংশীবাবুকে লম্বা চিঠি লিখলেন। বাবা তখন ‘চারুলতা’ চিত্রনাট্য লিখছেন। সেই চিঠিতে চারুলতার সেট নিয়ে অনেক কিছু লিখেছিলেন বাবা। বংশীকাকু ‘পিরিয়ড’ ফিল্মের কাজ শুনলে আরও বেশি উথসাহী হয়ে উঠতেন। পর্দার কাপড় থেকে আসবাব সব নিজে কিনতে যেতেন। বংশীকাকুর একটা বিষয় নিয়ে কিন্তু বাবা বেশ অখুশি ছিলেন। সব নিজে হাতে করতে গিয়ে, সব নিখুঁত করতে গিয়ে, বংশীকাকু নির্দিষ্ট সময় সেট তৈরি করে উঠতে পারতেন না। দেরিতে সেট পেতেন বাবা, বলতেন, “বংশী তো কাজ করছে, দেখি যে দিন শুটিং ফেলেছি তার দু’দিন বাদে যদি শুটিং শুরু করা যায়।” আমরা জানতাম যে দিন শুটিং বলা হবে সে দিন হবে না।

বোম্বে গেলেন বংশীকাকু। ‘জলসাঘর’-এর সময় থেকে অশোক বসু বাবার সেট তৈরি করতে আরম্ভ করলেন। যোগাযোগে কোথাও ভাটা পড়েনি। শুধু সহকর্মী নয়। বাবার বন্ধু ছিলেন বংশীকাকু। আমেরিকায় বাবার রেট্রোস্পেক্টিভ হবে। চিদানন্দ দাশগুপ্ত আমন্ত্রিত, বংশীকাকুকেও নিমন্ত্রণ জানানো হল। তিনি তো যাবেন না। কিন্তু প্রথম বিদেশের আমন্ত্রণ, বাবার সঙ্গে গেলেন বংশীকাকু। ওর কাজ খুবই সমাদৃত হল। খুব খুশি হয়েছিলেন। এই পূর্ণতার মুহূর্তে ওয়াশিংটন যাওয়ার সময় ওঁর মৃত্যু হয়। ট্রেনে উঠতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। আর ফিরলেন না। সেটা ১৯৮১ সালের ২৭ জুন। বাবা তখন নিউ ইয়র্কে। আরও কয়েকটি শহরে ছবি নিয়ে ঘোরার কথা। বাবা এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে সব অনুষ্ঠান বাতিল করে দেশে ফিরে আসেন।

আর বংশীকাকু? দেশে আপনজন বলতে কেউ ছিল না ওঁর। বিদেশের মাটিতেই বংশীকাকুর জীবনের ক্যানভাস স্থির হয়ে যায়।

মনে পড়ল আজ ওঁর মৃত্যুদিন।

অনুলিখন: স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement
আরও পড়ুন