Pahalgam Terrorist Attack

জম্মু-কাশ্মীরে ঢুকতে চাইছে চিন, ইতিহাস বলছে বাড়াতে চাইছে সীমানাও, শিমলা চুক্তি অগ্রাহ‍্য করার পাক হুমকি সেই লক্ষ্যেই

প্রবল পরাক্রম দেখিয়ে ভারতীয় বাহিনী পুনর্দখল করেছিল নিজেদের এলাকা। কিন্তু এক দিকে যখন কার্গিলে যুদ্ধ চলছে, তখন সেখান থেকে মাত্র সাড়ে ৪০০ কিলোমিটার দূরেই চিন কুকীর্তি করছিল।

Advertisement
সুব্রত সাহা, অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল
শেষ আপডেট: ০১ মে ২০২৫ ০৯:০১
China wants to be an important player in Jammu-Kashmir dynamics, Pak trying to pave the way by scrapping Shimla agreement

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

চিনা বিদেশমন্ত্রীর বিবৃতি দেখে আমার নিজের সৈনিক জীবনের অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ছিল। চিন বরাবরই এমন সুযোগের অপেক্ষায় ওত পেতে থাকে। ভারত-পাকিস্তান সংঘাতকে চিন নিজেদের জন্য সীমা সম্প্রসারণের অবকাশ হিসেবেই দেখে।

Advertisement

১৯৯৯ সাল। কার্গিলের সুউচ্চ পর্বত আর দুর্গম প্রকৃতির মাঝে ভারত-পাকিস্তানের রক্তক্ষয়ী লড়াই। মে থেকে শুরু। জুলাই মাসে শেষ। পাহাড়ের উপরে সুবিধাজনক অবস্থানে বসে থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান সে যুদ্ধে জিততে পারেনি। প্রবল পরাক্রম দেখিয়ে ভারতীয় বাহিনী পুনর্দখল করেছিল নিজেদের এলাকা। কিন্তু এক দিকে যখন সেই যুদ্ধ চলছে, তখন সেখান থেকে মাত্র সাড়ে ৪০০ কিলোমিটার দূরেই চিন নিজেদের সীমানা সম্প্রসারণে মন দিয়েছিল।

এ বারও চিন চাইছে ভারতকে একটা যুদ্ধের মধ্যে ঠেলে দিতে। চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং য়ি পাকিস্তানকে চিনের ‘কট্টর মিত্র’ এবং ‘সব ঋতুর সহযোগী’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘পাকিস্তানের যুক্তিযুক্ত নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ চিন বোঝে এবং তাদের সার্বভৌমত্ব ও সুরক্ষা সংক্রান্ত স্বার্থকে চিন সমর্থন করে।’’ চিনা বিদেশমন্ত্রীর বিবৃতি আসলে পাকিস্তানের মনোবল বাড়ানোর প্রয়াস। সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, পাকিস্তানে চিন প্রচুর অস্ত্রও পাঠাচ্ছে। চিনের এই ভূমিকার নেপথ্যে সেই ১৯৯৯ সালের মতো সীমানা ঠেলাঠেলির ইচ্ছা তো রয়েছেই। তবে শুধু সেই একটা কারণ নয়। আরও অনেকগুলো বড় কারণ রয়েছে, যা মাথায় রেখে চিন চাইছে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ‘পুরোদস্তুর যুদ্ধ’ শুরু হোক।

অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তি হিসেবে ভারতের প্রভাব গোটা বিশ্বে বাড়ছে। চিন কিছুতেই তা হতে দিতে চায় না। ভারত আগে শুধু দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। চিন চায়, ভারত দক্ষিণ এশিয়াতেই সীমাবদ্ধ থাক। তাই ভারতকে যুদ্ধে জড়াতে বাধ্য করাটা চিনের লক্ষ‍্য। গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক শক্তি হয়ে ওঠার দিকে ভারতের যে অগ্রগতি, তাকে রোখার জন‍্য ভারতকে একটা বড় যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার কৌশল নিয়েছে চিন।

এই মুহূর্তে গোটা বিশ্ব জুড়ে বাণিজ্যযুদ্ধের আবহ। চিন আর আমেরিকার মধ্যে ‘শুল্কযুদ্ধ’ তো বেনজির মাত্রা ছুঁয়েছেই। তার পাশাপাশি আমেরিকা-সহ পশ্চিমি বিশ্ব চিন থেকে শিল্পোৎপাদন পরিকাঠামোও ধীরে ধীরে সরাতে চাইছে। সস্তার শ্রমে শিল্পোৎপাদন বহাল রাখতে হলে চিন থেকে সরিয়ে অন্য কোনও এশীয় দেশেই সেই পরিকাঠামো গড়তে হবে পশ্চিমি বিশ্বকে। তার জন্য ভারত এই মুহূর্তে আমেরিকা-সহ গোটা পশ্চিমি বিশ্বের কাছে সবচেয়ে পছন্দের ঠিকানা। ধীরে ধীরে শিল্পোৎপাদন পরিকাঠামো চিন থেকে ভারতে সরতেও শুরু করেছে। বেজিং সেই প্রবণতাকে এখানেই রুখে দিতে চায়। ভারতকে কোনও বড়সড় যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিতে পারলেই সেটা সহজে সম্ভব হয়ে যাবে। কারণ, যুদ্ধরত কোনও দেশে কেউ এখন শিল্পোৎপাদন পরিকাঠামো সরিয়ে আনতে চাইবে না।

পাকিস্তানের ‘স্বার্থরক্ষা’র কথা চিন বলছে বটে, কিন্তু চিন আসলে নিজের স্বার্থরক্ষার কথা ভাবছে। চিনের মাথায় ঘুরছে সিপিইসি (চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর) রক্ষা করার ভাবনা। এই মুহূর্তে বিশ্ব অর্থনীতির খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ নির্ভরশীল সমুদ্র বাণিজ্যের উপরে। এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় (এশিয়া প্যাসিফিক) অঞ্চল এবং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সামুদ্রিক বাণিজ্যপথের উপরে চিন একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে চায়। কিন্তু সেই চেষ্টা করতে গিয়ে চিন পাল্টা প্রতিরোধের মুখে পড়েছে।

এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া সক্রিয় চিনা আধিপত্য রুখতে। আর ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারতই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। দক্ষিণ চিন সাগরের যে কোনও বন্দর থেকে বেরিয়ে আফ্রিকা, মধ্য এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া বা ইউরোপের দিকে যেতে হলে চিনা জাহাজকে মালাক্কা প্রণালী পেরিয়ে আসতে হয়। সুমাত্রা এবং মালয়েশিয়ার মাঝে সেই সঙ্কীর্ণ প্রণালী পেরিয়েই যে কোনও জাহাজকে ভারতীয় জলসীমার কিনারায় এসে উপস্থিত হতে হয়। বলতে গেলে ভারতের দক্ষিণতম স্থলভাগ ইন্দিরা পয়েন্টের সামনে দিয়েই যায় ওই সমুদ্রপথ। এগুলো চিনের মাথাব্যথার কারণ। তাই বেজিঙের কর্তারা অনেক দিন ধরেই আরব সাগরে পৌঁছোনোর নতুন পথ খুঁজছিলেন। চিনের শিনচিয়াং প্রদেশ থেকে পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমে গ্বাদর বন্দর পর্যন্ত সেই পথ বানানো হয়েছে। আফ্রিকা, ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়া বা মধ্য এশিয়ার সঙ্গে চিন ওই পথেই বাণিজ‍্য করতে চায়। চিন থেকে সড়কপথে আরব সাগরের গ্বাদর বন্দর। সেখান থেকে জাহাজে বাকি পথ। কিন্তু গ্বাদর পড়ছে বালোচিস্তানের মধ্যে। যে বালোচিস্তানের বাসিন্দারা এখন পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চেয়ে বিদ্রোহ করেছেন। পাক বাহিনীকে সেখানে রোজ রক্তক্ষয়ী লড়াই লড়তে হচ্ছে। বালোচিস্তানের পরিস্থিতি পুরোপুরি পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে এখন নেই। পাকিস্তান আরও দুর্বল হলে বালোচিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের আরও বাইরে যাবে। সে ক্ষেত্রে বিপুল বিনিয়োগে তৈরি করা সিপিইসি তথা চিনের নতুন বাণিজ্যপথের ভবিষ্যৎও অন্ধকার হবে। বেজিঙের কর্তারা তাই পাকিস্তানকে সবল রাখতে চাইছেন। যাতে চিনের বাণিজ্যিক তথা অর্থনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে।

আফগানিস্তানের তালিবান শাসকদের সঙ্গে আমেরিকার ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা চিনের মাথাব্যথার আরও এক কারণ। তালিবান যখন আফগানিস্তানে কয়েক বছর আগে ক্ষমতা দখল করল, তখন আমেরিকার বাহিনী আফগানিস্তান ছেড়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি আবার তারা আফগানিস্তানের বিষয়ে উৎসাহী হয়েছে। কারণ, আফগানিস্তানের মাটির নীচে থাকা খনিজ সম্পদ। তালিবানের সঙ্গে খনিজ উত্তোলন বা তার ব‍্যবসা নিয়ে আমেরিকার কথা এগোচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। চিনের পক্ষে তা মেনে নেওয়া কঠিন। আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদের নাগাল চিনও পেতে চায়। আর সব দিক দিয়ে স্থলবেষ্টিত আফগানিস্তানে পৌঁছোতে পাকিস্তানই চিনের কাছে ‘সেতু’। তাই পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখতে বা অখণ্ড রাখতে চিন তৎপর। পাকিস্তানের স্বার্থের কথা ভেবে নয়, নিজের স্বার্থে চিনের এই পাকিস্তানপ্রেম।

চিনের আরও এক বাসনা দীর্ঘ দিনের। জম্মু-কাশ্মীরের পরিস্থিতিতে চিন নাক গলাতে চায়। জম্মু-কাশ্মীরের ঘটনাপ্রবাহে চিন প্রত‍্যক্ষ অংশীদার হতে চায়। সকলেরই হয়তো মনে আছে, ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহার করে জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখকে ভারত দু’টি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করার পরে চিন কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছিল। আসলে জম্মু-কাশ্মীরে নাক গলানোর সুযোগ আরও কমে যাবে বলেই চিন অতটা অসন্তুষ্ট হয়েছিল। পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসবাদী হামলার পরে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে টেনে নিয়ে গিয়ে চিন আবার নাক গলানোর সুযোগ পেতে চাইছে। আর পরিস্থিতির মোকাবিলা নিজেরা করতে পারবে না বুঝে চিনকে সেই সুযোগ করে দিতে চাইছে পাকিস্তান।

এখানে চিন এবং পাকিস্তানের সম্মিলিত-কৌশলটা খেয়াল করতে হবে। জঙ্গি হামলার সঙ্গে নিজেদের সংযোগ অস্বীকার করে পাকিস্তান এখন বার বার বলছে, নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তদন্ত হোক। চিন সেই দাবিকে সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দিচ্ছে। আর চিন যাতে বিনা বাধায় নাক গলাতে পারে, তা নিশ্চিত করতে পাকিস্তান বলছে যে তারা শিমলা চুক্তি থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। শিমলা চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে জম্মু-কাশ্মীর সংক্রান্ত যাবতীয় মতভেদ বা বিবাদের নিষ্পত্তি দ্বিপাক্ষিক স্তরেই করতে হবে। কোনও তৃতীয় পক্ষ এর মধ্যে ঢুকতে পারবে না। সুতরাং পাকিস্তান এখন শিমলা চুক্তি ভেঙে বেরোনোর কথা কেন বলছে, বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তারা আসলে চিনকে জম্মু-কাশ্মীরের ঘটনাপ্রবাহের প্রত‍্যক্ষ অংশীদার হওয়ার পথ করে দিতে চাইছে।

(লেখক দেশের প্রাক্তন উপ-সেনাপ্রধান। ২০১৪-’১৫ সালে কাশ্মীরে সেনাবাহিনীর ১৫ কোরের কমান্ডার ছিলেন। নিবন্ধটি তাঁর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত)

Advertisement
আরও পড়ুন