সুনামি আছড়ে পড়ার পরে। বুধবার রাশিয়ার কুরিল দ্বীপের উপকূলে। ছবি: পিটিআই।
বুধবার কম্পনের অভিঘাতে ফিরে এল ৭৩ বছর আগের স্মৃতি!
পাঁচ বছর আগে কেঁপেও উঠেছিল কামচাটকা। সে বার রিখটার স্কেলে তীব্রতা ছিল ৭.৮। বুধবারের ভূমিকম্প ছাপিয়ে গিয়েছে সেই তীব্রতাকে। এ দিন রিখটার স্কেলে তীব্রতার মাত্রা ছিল ৮.৮। ভূবিজ্ঞানের তথ্য বলছে, ১৯৫২ সালের ৪ নভেম্বর কামচাটকায় ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল ৯। তার পর থেকে এত জোরালো ভূমিকম্প ওই এলাকায় হয়নি।
কামচাটকায় ভূমিকম্প ‘স্বাভাবিক’ ঘটনা। বিপর্যয়কে কেন স্বাভাবিক বলছি, তা বুঝতে হলে ওই এলাকার ভূতাত্ত্বিক গঠন বোঝা জরুরি। কামচাটকা অবস্থিত কুরিল-কামচাটকা খাতের (ট্রেঞ্চ) উপরে। এর তলায় আছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় পাত এবং সেই পাত বছরে ৮৬ মিলিমিটার ।
বেগে ওখোটস্ক মাইক্রোপাতের (যা আদতে ইউরেশীয় পাতের অংশ) তলায় ঢুকছে। এই পাত সঞ্চালনের ফলেই কামচাটকা ভূমিকম্পপ্রবণ। প্রায়ই এখানে মাটি কেঁপে ওঠে। শুধু কামচাটকা উপসাগরীয় এলাকা নয়, গোটা প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকাই ভূমিকম্পপ্রবণ। এই এলাকায় অনেক সুপ্ত আগ্নেয়গিরি আছে যা ভূস্তরের নীচে এই পাত নড়াচড়ার ফলেই জেগে ওঠে। তাই এই অঞ্চলের পোশাকি নাম, ‘প্রশান্ত মহাসাগরীয় আগ্নেয় বলয়’ (রিং অব ফায়ার)। কামচাটকাও এই বলয়ের অংশ। তাই যুগ-যুগ ধরে বারবারই ভূমিকম্পের কবলে পড়েছে এই এলাকা।
ভূবিজ্ঞানের পুরনো তথ্য ঘাঁটতে দেখা যায়, ১৭৩৭ সালে প্রবল ভূমিকম্পের মুখে পড়েছিল কামচাটকা। তারপর ১৮৪১, ১৯২৩, ১৯৫২, ১৯৫৯, ২০০৬, ২০২০ সালেও প্রবল ভূমিকম্প হয়েছে। বারবারই ভূমিকম্পের জেরে জন্ম নিয়েছে সুনামি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জনজীবন। এ দিনও ইন্টারনেটে দেখলাম, কামচাটকা প্রশাসন জানিয়েছে যে এ বারের ক্ষয়ক্ষতি আগের সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে। স্বাভাবিক, কোনও স্থানের পরিকাঠামোগত উন্নতি হলে বিপর্যয়ে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাও বেশি হয়। সুনামির ধাক্কা শুধু কামচাটকাতেই আটকে থাকেনি। বরং প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় অবস্থিত আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া এবং জাপানে আছড়ে পড়েছে। এমনকি, ইকুয়েডরও ছুঁয়ে ফেলেছে সুনামির ঢেউ।
তবে কামচাটকায় এ বার প্রাণহানি অনেকই কম। তার কারণ, সুনামি পূর্বাভাস ব্যবস্থা। প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে রোখা অসম্ভব। তাই বাঁচার ক্ষেত্রে উন্নত আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা জরুরি। কামচাটকা এবং অন্যান্য় জায়গায় সেই সতর্কতা ব্যবস্থা আছে বলেই দ্রুত মানুষজনকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া গিয়েছে। ভারতেও সুুনামি সতর্কতার ব্যবস্থা আছে। ৭.৫ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হলেই সেই সতর্কতা জারি করা হয়। ধস এবং ভূমিকম্পের সতর্কতা ব্যবস্থাও গড়ে উঠছে। ৫.৫ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হলেই এ দেশের ভূকম্পপ্রবণ এলাকাগুলিকে সতর্ক করা হয়।
অনেকেই প্রশ্ন করেন, এই ভূমিকম্পের ফলে কী ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে? কী বদল ঘটতে পারে? প্রথমেই বলি, মাটির প্রবল ঝাঁকুনি এবং বিরাট ঢেউয়ের ধাক্কায় এমন জোরালো ভূকম্পের জেরে কোথাও উপকূল বসে যেতে পারে, কোথাও গজিয়ে উঠতে পারে নতুন উপকূল। সমুদ্রের তলদেশে ভূপ্রাকৃতিক বদল আসতে পারে। ভূস্তরের গড়নেও কোথাও কোথাও পরিবর্তন দেখা যায়। ২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরের ভূমিকম্পের পরেও কিছু পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল। তবে এ কথাও ঠিক, অনেক সময়েই ছোট-ছোট ভূমিকম্প হয়। সেই হিসেবে রোজই পৃথিবীর কোথাও না-কোথাও ভূমিকম্প হচ্ছে। পাত সঞ্চালনের ফলে ভূস্তরের অভ্যন্তরের বিভিন্ন ফল্ট বা চ্যুতিতে প্রচুর শক্তি জমা হয়। বহু গভীরে যখন সেই প্রবল শক্তি নির্গত হয় তখনই প্রলয়ের মতো ভূমিকম্প হয়। কিন্তু কম পরিমাণে শক্তি নির্গত হলে কম্পনের মাত্রা কম হয়। এক দিক থেকে, ছোট-ছোট ভূমিকম্প প্রলয়কে কিছুটা পিছিয়েই দেয়।