মুহাম্মদ ইউনূস। —ফাইল চিত্র।
বাংলাদেশে যত গোলমাল হচ্ছে তার দায় আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনা উপরে চাপিয়ে, পরোক্ষে ভারতকেও কাঠগড়ায় তুলেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তিকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। ব্রিটেনে সফররত ইউনূস বুধবার কিছুটা অভিযোগের সুরেই দাবি করেছেন, ভারতে বসে শেখ হাসিনা যে সব বিবৃতি দিচ্ছেন, তার জেরেই বাংলাদেশে উত্তেজনা বাড়ছে। তাঁর দাবি, আওয়ামী লীগের নেত্রীকে নিরস্ত করা তো দূরের কথা, নরেন্দ্র মোদী সরকার হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে। এ দিন সাংবাদিক বৈঠকে শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত ‘৩২’ নম্বর ভেঙে ফেলার নিয়ে প্রশ্ন করা হলে, ইউনূস তেমন যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর দিতে পারেননি। প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বলছেন, “উনি যে দুঃশাসন কায়েম করেছেন, তার বিরুদ্ধে একমাত্র সরব কণ্ঠের নাম শেখ হাসিনা। ইউনূস ভয় পেয়ে এই সব অভিযোগ করছেন।”
গত অগস্টে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে ভারতে রয়েছেন বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা। গত কয়েক মাস ধরে লাগাতার তিনি সমাজমাধ্যমকে ব্যবহার করে দেশে দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের বার্তা দিয়ে চলেছেন। রাজনৈতিক লড়াইয়ে নামার পরামর্শ এবং কৌশলও বাতলে দিচ্ছেন। হাসিনার এই তৎপরতার জন্যই বাংলাদেশে উত্তেজনা এবং অশান্তি তৈরি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ইউনূস। একই সঙ্গে, তাঁর অভিযোগ, হাসিনাকে এই ধরনের কাজ থেকে বিরত করতে ভারত সরকারও কোনও পদক্ষেপ করছে না। এ নিয়ে লন্ডনের চ্যাথাম হাউসের রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সে একটি প্রশ্নোত্তর পর্বে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তিকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। তখন বলেছিলাম, আপনি তাঁকে (শেখ হাসিনা) ওখানে থাকতে দিয়েছেন। আমি তো আপনাকে নীতি পরিবর্তনে বাধ্য করতে পারি না। দয়া করে এটা নিশ্চিত করুন যাতে, উনি বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ না করেন। উনি বিভিন্ন কর্মসূচির দিনক্ষণ বলেছেন, তাতে বাংলাদেশে উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে। কেন আমাদের দেশে উনি (শেখ হাসিনা) উত্তেজনা তৈরি করেছেন! তাতে মোদী বললেন, ‘সমাজমাধ্যমে এ সব হচ্ছে। সমাজমাধ্যমকে তো আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না’। আমাদের দেশে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, আর আপনি (নরেন্দ্র মোদী) সমাজমাধ্যম বলে বিষয়টি এড়িয়ে যেতেপারেন না।’’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, বাংলাদেশে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির জন্য মোদী সরকারের ভূমিকা কথা বলে ভারতের উপরে কৌশলে চাপ বাড়াতে চাইলেন ইউনূস। চলতি মাসের ৬ তারিখ মোদীকে চিঠি দিয়েছিলেন ইউনূস। তাতে লিখেছিলেন, ‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দু’দেশের জনগণের কল্যাণের জন্য পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বোঝাপড়ার মনোভাব আমাদের ভবিষ্যতেও একত্রে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করবে’।
হাসিনাকে নিশানা করায় ইউনূসকে আক্রমণ করেছেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আনন্দবাজার পত্রিকাকে বলেছেন, ‘‘সুদখোর ইউনূস এবং তাঁর গ্যাং বাংলাদেশে দুঃশাসন কায়েম করেছে। মানুষ এই কয়েক মাসে তিতিবিরক্ত। তাঁরা বুঝতে পারছেন, এর চেয়ে শেখ হাসিনার আমল শত গুণে ভাল ছিল। আমাদের নেত্রীর বার্তা দেশবাসী মনেপ্রাণে গ্রহণ করছেন। সেটা ইউনূস বুঝতে পারছেন এবং ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছেন।’’
প্রশ্নোত্তর পর্বে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন করা হয়েছিল বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে। তিনি বলেছেন, ‘‘আপাতত দেশের নিরাপত্তা ও রাজনীতির সুরক্ষায় আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিচার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম আপাতত স্থগিত থাকবে। আমরা দলটিকে নিষিদ্ধ করিনি, কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে।’’ ইউনূসের এই বক্তব্যকে ‘হাস্যকর’ বলে উল্লেখ করে ওবায়দুলের প্রতিক্রিয়া, ‘‘উনি কি ভাবেন, সবাই মূর্খের স্বর্গে বাস করে! একটা দলের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা মানে তো দলটাকেই নিষিদ্ধ করা। প্রতিদিন আমাদের নেতা-কর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছেন, মিথ্যা মামলা জেলে ভরা হচ্ছে, জুলুমের শিকার হচ্ছেন।’’
শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি জাদুঘরটি ‘সিটি কর্পোরেশনের বুলডোজ়ার দিয়ে ভেঙে ফেলা’ এবং ‘প্রশাসনের নীরবতা’ ও কিছু দল বা ব্যক্তির জমায়েত নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ইউনূস বলেন, ‘‘অনেক বিষয় ও প্রশ্ন একসঙ্গে এসেছে এবং তাঁরা সব কিছু সঠিক ভাবে পরিচালনা করতে পারেননি। এটা এমন এক সময় ছিল—যা আমরা অতিবাহিত করেছি। পরিস্থিতি ক্রমে খারাপ হচ্ছিল এবং এখন বিষয়গুলো শৃঙ্খলায় এসেছে...। দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা আমাদের জন্য একটি বড় কাজ ছিল।’’
ইউনূসের বক্তব্যে বার বার ঘুরেফিরে এসেছে হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতাদের বিচারের প্রসঙ্গ। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, নির্বাচিত সরকারে হাতে বিচারের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে না কেন? প্রধান উপদেষ্টার যুক্তি, ‘‘এটা আমি নির্ধারণ করিনি, আমাদের এই কাজ দেওয়া হয়েছে। যাঁরা আমাকে এই দায়িত্ব নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন, তাঁরা মূলত তিনটি দায়িত্ব আমাদের অর্পণ করেন। আমরা সে লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছি।’’ পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের অংশ হওয়ার কোনও আগ্রহ নেই বলে জানিয়েছেন ইউনূস। তাঁর কথায়, ‘‘কোনও ভাবেই না। আমার মনে হয়, আমাদের উপদেষ্টা পরিষদের (মন্ত্রিসভা) কোনও সদস্যই পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের অংশ হতে চাইবেন না।’’