প্রবীণের সঙ্গেই নবীনের শিল্পভাবনার মিশেল সিমা আর্ট গ্যালারিতে। —নিজস্ব চিত্র।
রিয়্যালিস্টিক বা মূর্ত ছবির পথ পেরিয়ে কোনও শিল্পী যখন ক্যানভাসে অচেনা ছন্দে তুলির টান দিতে শুরু করেন, তখনই শুরু হয় এক অন্য ম্যাজিক। সাধারণ মনস্তত্ত্বে যা ঘটে অবচেতনে, শিল্পীমনে তা উঠে আসে চেতনে। বিমূর্ত শিল্প একটি দৃশ্যমান অভিজ্ঞতার চেয়েও আরও অনেক বেশি কিছু ধারণ করে। তবে বছরের পর বছর ধরে সারা বিশ্বে বিমূর্ত চিত্রকলা নিয়ে যে কাজ হয়ে চলেছে, তার উৎসবিন্দু কিন্তু লুকিয়ে ভারতেই, সে কথাই মনে করাল সিমা গ্যালারির শিল্প প্রদর্শনী ‘লেস ইজ় মোর; মিনিমালিজ়ম টু অ্যাবস্ট্রাকশন ইন ইন্ডিয়ান আর্ট’।
প্রায় ১২৫টি নানা মাপের বিমূর্ত ছবি নিয়ে আয়োজিত এই প্রদর্শনী, বিমূর্ত চিত্রণ ও তার ইতিহাস বিষয়ে কিছু আলোচনার অবকাশ রাখল। ১৯ ডিসেম্বর, শুক্রবার বিমূর্ত চিত্রকলা বিষয়ক প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রবীণ ও নবীন প্রজন্মের বিমূর্ত শিল্পভাবনা মিলে গেল এক নতুন ছন্দে। তাঁদের কল্পনা, বাস্তব, বিস্ময়, বিশ্বাস, আশা— সব মিলেমিশে তৈরি হল এক অন্য জগৎ। সিমা গ্যালারির অধিকর্তা রাখী সরকার জানান, ইউরোপে প্রথম বিমূর্ত চিত্রের প্রকাশ ঘটে বিংশ শতকের গোড়ায়। গল্প ও বর্ণনামূলক চিত্রণের বিরুদ্ধে গিয়ে, শুধুমাত্র রং ও আকারের যথাযথ বিন্যাস বা নকশা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে, পাশ্চাত্যের শিল্পীরা তখন নানাবিধ পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেন। আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকেই উঠে আসে আধুনিক শিল্পভাবনা। তবে ভারতে কিন্তু তার অনেক আগেই উপজাতি ও লোকশিল্পের মাধ্যমে বিমূর্ত শিল্পকলার চর্চা শুরু হয়েছিল। এই প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য বিভিন্ন ধরনের বিমূর্ত চিত্রণ তুলে ধরা শিল্পে উৎসাহী এবং শিক্ষানবিশ শিল্পীদের জন্য। অধিকর্তা বলেন, ‘‘এই প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য কোনও মতাদর্শ তুলে ধরা নয়। বরং শিল্পীর সৃষ্টিকে সম্মান জানানো ও সকলের সামনে তাঁর কাজকে উপস্থাপনা করা। সমকালীন শিল্পীদের কাজ দেখবেন একে-অপরে, এবং অন্যেরা। ভাবনার আদানপ্রদান ঘটবে।”
সিমা আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শনীটি চলবে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। —নিজস্ব চিত্র।
রঙিন পোস্টারের কাগজের টুকরোগুলি নখ দিয়ে চিরে পিচবোর্ডের ক্যানভাসে এমন ভাবে জোড়া হচ্ছে যে, দেখে বোঝার উপায় নেই তা কাগজখণ্ডের কোলাজ, না কি এক অপরূপ তৈলচিত্র! কোলাজশিল্পী শাকিলা শেখের এমনই শিল্পভাবনা প্রদর্শিত হয়েছে এই শিল্প প্রদর্শনীতে। কোনও স্টুডিয়ো নেই, কর্মশালা নেই, মাটির বাড়ির ছোট্ট ঘরে বা কখনও উঠোনেই নিজের শিল্পকে জীবন্ত করে তুলছেন তিনি। দামি রং বা তুলির ব্যবহার নেই, কেবল রঙিন কাগজ কেটে তা এত সূক্ষ্ম ভাবে মিলিয়ে দিচ্ছেন যে, তাকে 'খণ্ডচিত্র' বলে বোঝার অবকাশই নেই। ক্যানভাস ও কাগজ মিলে জীবনের ভাঙাগড়াকে বাস্তব রূপ দিচ্ছে শাকিলার শিল্পভাবনা।
শিল্প প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সমীর আইচ, শ্রেয়সী চট্টোপাধ্যায়, শাকিলা শেখ, রত্নাবলী কান্ত, বিমল কুন্ডু, অশোক মল্লিক, ঈশিতা অধিকারী, প্রদীপ রক্ষিতের মতো শিল্পীরা। তাঁদের সকলেরই শিল্পভাবনা শোভা পেয়েছে এই শিল্প প্রদর্শনীতে। শিল্পী সমীর আইচ বলেন, ‘‘কেবলমাত্র বিমূর্ত চিত্রণ নিয়ে শিল্প প্রদর্শনী এখন খুবই কম হয়। সিমা বিমূর্ত শিল্পকলা নিয়ে এমন শিল্প প্রদর্শনী আয়োজন করেছে, তাতে আমরা অভিভূত। দীর্ঘ দিন ধরে সিমা-র সঙ্গে আমি যুক্ত রয়েছি। এটা আমার কাছে আমার ঘরের মতো। সিমা শিল্পীদের যে স্বাধীনতা দেয়, সেই স্বাধীনতা অন্য কোথাও সত্যিই পাই না।"
বিমূর্ত শিল্পকলা নিয়ে শিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন সিমা আর্ট গ্যলারিতে। —নিজস্ব চিত্র।
সিমা আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শনীটি চলবে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। সোমবার বিকেল ৩টে থেকে ৭টা আর মঙ্গল থেকে শনিবার সকাল ১১টা থেকে ৭টা পর্যন্ত শিল্প প্রদর্শনীর জন্য খোলা থাকবে সিমা আর্ট গ্যালারি।