Artificial Intelligence

রবীন্দ্রনাথের নতুন কবিতাও সম্ভব! যেমন চান তেমনই লিখবে এআই, বাঙালি কবিদের ভবিষ্যৎ কি সঙ্কটে?

কল্পবিজ্ঞানের কাহিনিতে দেখা যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষকে চ্যলেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। বাস্তবেও কি তা-ই ঘটতে চলেছে? কবিতা লেখা মকশো করছে এআই? কী বলছেন কবিতা ও তথ্যপ্রযুক্তি জগতের বাসিন্দারা?

Advertisement
অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০২৫ ০৮:৫৯
Can Artificial Intelligence write poetry like human poets of its own

সবার মুঠোতেই রবীন্দ্রনাথ, শুধু ‘ক্রিয়েট’ বোতাম টেপার অপেক্ষা। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ, সহায়তা: এআই।

কবিখ্যাতি বড় বিষম বস্তু। কিন্তু কবিতা লেখা কি ততখানিই বিষম? বিশেষ করে বাংলা ভাষায়? বাজারে একটা কহাবত প্রচলিতই রয়েছে, কৈশোরে বা যৌবনে কবিতা লেখেননি, এমন বঙ্গজ পাওয়া কঠিন। তার উপর কবিতা লেখা ব্যাপারটা যে ছোঁয়াছে রোগের মতো, সে কথা তো কবেই সুকুমার রায় তাঁর ‘আশ্চর্য কবিতা’ গল্পে লিখে গিয়েছেন। সে কালে তো বটেই, এ কালেও কবিতা লেখা বাঙালির পিছু ছাড়েনি। যত দিন বাংলা কবিতার আগে ‘আধুনিক’ তকমাটি লাগেনি, তত দিন ‘কবি’ সমাজে বেশ সম্মানজনক অবস্থাতেই বিরাজ করতেন। কিন্তু ‘আধুনিক’ তকমা লাগার পরে, বা বলা যায় কম-বেশি তিরিশের দশক থেকে বাংলা গদ্যকবিতার জন্ম রক্ষণশীল বাঙালির কাছে যে ‘কবি’ নামক জীবটিকে খানিক রসিকতার পাত্র করে তুলেছিল, তার প্রমাণ রয়েছে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মগ্নমৈনাক’ উপন্যাসে, পরশুরামের ‘দ্বান্দ্বিক কবিতা’ গল্পে এবং এমনকি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘একা এবং কয়েকজন’ উপন্যাসেও। খানিক দুর্বোধ্য শব্দকে পর পর সাজিয়ে ‘আধুনিক কবিতা’র প্যারোডি বলে উপস্থাপনার চলও বাংলা বাজারে শুরু হয় সেই সময় থেকেই। ছন্দ ও প্রকরণের বন্ধন থেকে কবিতার মুক্তি সমর সেন বা জীবনানন্দ দাশের মতো কবির কাছে বৃহত্তর জগৎকে খুলে দিলেও সজনীকান্ত দাস বা তাঁর ‘শনিবারের চিঠি’ তাঁদের নিয়ে কম ব্যঙ্গ করেনি। কোথাও একটা শঙ্কা কাজ করছিল রক্ষণশীলদের মনে। কবিতা রচনা কি তবে ‘জলভাত’ হয়ে যাবে? আপাত দুর্বোধ্যতা বা বলা ভাল দুরূহতার মোড়ক থেকে কবিতার ব্যঞ্জনাকে ছাড়িয়ে ‘আমূল দর্শন’-এ পৌঁছোনোর কাজটিকে এড়িয়ে তাকে ‘সহজসাধ্য’ এবং ‘যে কেউ পারে’-সুলভ তাচ্ছিল্য শিক্ষিত সমাজের লব্জ হয়ে ওঠে। বাংলা কবিতাকে সেই ‘সঙ্কট সময়’ পেরোতে আরও কয়েক দশক অপেক্ষা করতে হয়েছিল, সন্দেহ নেই।

Advertisement
মগজের সঙ্গে এআইয়ের লড়াই কোন ভবিষ্যতে গিয়ে ঠেকবে?

মগজের সঙ্গে এআইয়ের লড়াই কোন ভবিষ্যতে গিয়ে ঠেকবে? ছবি: সংগৃহীত।

এই মুহূর্তে বাংলা কবিতা (শুধু বাংলা কবিতা নয়, সব ভাষার কবিতাই) এক অন্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। বিষয়টি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, সংক্ষেপে এআই। কিছু দিন আগে এক নাতিতরুণ কবি সমাজমাধ্যমে এআই-লিখিত একটি ‘কবিতা’ তাঁর সমাজমাধ্যমের পাতায় পোস্ট করেন। সেই কবিতার উপজীব্য ছিল ‘এপ্রিল ফুল’। কিন্তু সেখানে এআই যা করে দেখায়, তাতে কবি টিএস এলিয়টের পঙ্‌ক্তি ধার করেই বলা যায়, এমন ‘নিষ্ঠুরতম এপ্রিল’-ফুল কাব্যজগৎ খুব বেশি দেখেনি। সে কবিতার আদ্য এবং উপান্তে ছিল আনতাবড়ি কিছু লাইন আর মাঝখানে এই সময়ের এক খ্যাতনামী কবির অতি বিখ্যাত কবিতার প্রথম দুই পঙ্‌ক্তি উদ্ধার করে তার প্যারোডি। সমাজমাধ্যমে পোস্টদাতার পরিচিতেরা এ নিয়ে সারা দিন রঙ্গ-তামাশা করেন এবং ব্যাপারটা সেখানেই মিটে গিয়েছে বলে মনে হয়। কিন্তু সত্যিই কি তাই?

এই ঘটনার পরে অনেকেই মেটা-র নিজস্ব এআই, জেমিনি ইত্যাদিতে পরীক্ষা করতে নামেন, বাংলা কবিতা লেখা কদ্দূর সম্ভব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পক্ষে, সে বিষয়ে। এআই-কে নিছক বাংলা কবিতা লিখতে দিয়ে নয়, তাঁরা কবিতার বিভিন্ন আঙ্গিক অনুসরণ করতে নির্দেশ দেন। সনেট, ভিলানেল ও পান্তুম— এই তিন ধরনের কবিতা বাংলায় লিখতে বলায় এআই যা লেখে, তা ভাষা ও ভাবগত ভাবে গোলমেলে ঠিকই, কিন্তু আঙ্গিকগত ভাবে তিনটি জ্যঁরের খুব কাছাকাছি। গদ্যকবিতা লিখতে গেলে এআই কিঞ্চিৎ গড়বড় করে ফেলছে বটে, কিন্তু আঙ্গিকগত দিক থেকে তার ‘আসল’-এর খুব কাছাকাছি হওয়ার ব্যপারটা অনেকের কাছেই ভাল ঠেকছে না। এআই এমনই এক ‘যন্ত্র’, তাকে যত ডেটা ‘ফিড’ করানো যাবে, ততই তার ‘দক্ষতা’ বৃদ্ধি পাবে। সনেট, ভিলানেল বা পান্তুম সংক্রান্ত ডেটা তাকে ‘খাওয়ানো’ হয়েছে বলেই সে তার কাছাকাছি কিছু একটা উৎপাদন করতে সমর্থ হয়েছে। বাংলা ভাষাগত ডেটাবেস তেমন পোক্ত নয় বলেই কবিতার চিন্তন পারম্পর্য সে আপাতত রক্ষা করতে পারছে না বটে, কিন্তু ইংরেজিতে তাকে শেক্সপিয়রীয় সনেট লিখতে বললে সে বেমালুম তা লিখে দিতে পারে। তা হলে কি সেই দিন আর আসতে বেশি দেরি নেই, যেখানে এআই লহমায় লিখে দিতে পারবে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে কিংবা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ধাঁচায় কবিতা? যদি লিখে ফেলে এবং সমাজমাধ্যমের বিপুল প্রবাহে তা মুহুর্মুহু আন্তর্জাল সমুদ্রে ভাসতে শুরু করে, তবে ‘আসল’ কবিতার কী হবে? অথবা অনুশীলন আর অভিনিবেশ ছাড়াই কিবোর্ডের কয়েকটি টকাটকেই কি লিখিত হয়ে যাবে কবিতা? এই সব প্রশ্নই রাখা হয়েছিল কবি এবং তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কর্মরত মানুষদের কাছে।

Can Artificial Intelligence write poetry like human poets of its own

এআই শুধু কবিতা নয়, গ্রাস করছে শিল্পের অন্য মাধ্যমগুলিকে। ছবি: সংগৃহীত।

সত্তর দশকের কবি রণজিৎ দাশ ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘নির্বাচিত কবিতা’র উৎসর্গপত্রে লিখেছিলেন— “ভবিষ্যতে যারা শহরপ্রান্তে ফেলে-রাখা অতিকায়, ভাঙা টেলিভিশনের বাক্সের ভিতর ব’সে মাফিয়া, মগজ ব্যাঙ্ক এবং রোবট পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে কবিতা পড়বে— তাদের জন্য”। তবে কি ধরে নিতে হবে ‘মগজ ব্যাঙ্ক’ (পড়ুন, এআই) এবং রোবট পুলিশের আন্তর্জাল মাফিয়া শাসিত সেই দুঃস্বপ্নের যুগ সমাগত? কবিতা লিখন আর পাঠ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হবে আবিশ্ব ছড়িয়ে থাকা ‘ডেটা’ আর যন্ত্রমস্তিষ্কের দ্বারা নির্ধারিত চিন্তন প্রক্রিয়ায়? পিছু হটবে কি মানুষের ভাবজগতের সমুদ্র-মন্থন? কিছু দিন আগে রণজিৎ এক সাক্ষাৎকারে সংবাদমাধ্যমে উল্লিখিত তথ্য উদ্ধার করে জানিয়েছিলেন, ডিজিটাল প্রগতির এই যুগে কবিতার ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি চিন্তিত। খবরে প্রকাশ, চ্যাটজিপিটি ৩.৫ শেক্সপিয়র বা এলিয়টের সমকক্ষ কবিতা লিখে ফেলতে সমর্থ বলে আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। উল্লেখ্য সে সব কবিতা সংশ্লিষ্ট কবিদের লিখনধারা বা ধাঁচাকে অনুকরণ করেই নির্মিত। সে দিন আসতে আর বেশি দেরি নেই, যখন রোবট লিখিত কবিতা আর জৈব প্রক্রিয়ায় লিখিত কাব্যের মধ্যে ফারাক করা দুরূহ হয়ে পড়বে। সম্প্রতি তাঁর ‘ডিজিটালের শয়তান ও কবিতা’ নামের প্রবন্ধগ্রন্থের নাম-নিবন্ধটিতেও উঠে এসেছে সেই দুর্ভাবনা।

‘ডিজিটালের শয়তান: কবিতার শত্রু’ শীর্ষক সেই নিবন্ধে রণজিৎ জানিয়েছেন, আন্তর্জাল ও ডিজিটাল দুনিয়ার সাম্প্রতিক অবস্থা ও মানব সৃজনশীলতার সংঘাত বিষয়ে। প্রাথমিক ভাবেই তিনি ডিজিটাল প্রযুক্তির ‘চিন্তন প্রণালী’র সঙ্গে মানুষের ভাবনা প্রক্রিয়ার পার্থক্যের কথা বলেছেন। কম্পিউটার প্রযুক্তির বাইনারি লজিক এবং সিঙ্গল ভিশন আর মানব মস্তিষ্কের ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স, ইনটুইটিভ ইনসাইট আর মাল্টিপল ভিশনের সংঘাতে চিন্তনের জৈব প্রক্রিয়ার আহত হওয়ার আশঙ্কাকেই ব্যক্ত করেছেন। এই নিবন্ধেই তিনি এনেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার নোবেলজয়ী সাহিত্যিক জেএম কোয়েৎজ়ির প্রসঙ্গ। কোয়েৎজ়ি ‘প্রকৃত বাস্তবতা’ (জৈব তথা মানবিক ভাবনা প্রসূত)-র সপক্ষে অনেক দিন ধরেই সক্রিয়। কিন্তু এক সময়ে তিনি আইবিএম সংস্থায় কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসাবে কাজ করতেন। সেই সময় তিনি কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে কবিতা লিখতে চেয়েছিলেন। রণজিতের সঙ্গে কোয়েৎজ়ির পত্রালাপ আগে থেকেই ছিল। এই তথ্য জানার পর তিনি কোয়েৎজ়ির কাছে এ ব্যাপারে বিশদ জানতে চান। প্রত্যুত্তরে কোয়েৎজ়ি তাঁকে নিবন্ধাকারে একটি রচনা পাঠান। যার মূল কথা, ডিজিটাল দুনিয়ার বাইনারি লজিকের খপ্পরে মানবিক চিন্তন পড়ে গেলে তা সামূহিক বিপদের ইঙ্গিতই বটে। রণজিৎ এই ভাবনাকে খানিক এগিয়ে রেখেই প্রশ্ন করেছেন, স্বয়ং কবিরাই যদি ‘ডিজিটাল শয়তান’-এর মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে পড়েন, তা হলে মানব মনীষার বাঁচার আশা কি আদৌ রয়েছে?

Can Artificial Intelligence write poetry like human poets of its own

শেক্সপিয়রের ধাঁচে মূলের চাইতেও ভাল কবিতা লিখছে নাকি চ্যটজিপিটি। ছবি: সংগৃহীত।

এই প্রশ্নটি রণজিতের কাছে পুনর্বার রাখায় কবি দ্বিধাহীন ভাবেই জানালেন, এআই মানবিক ভাবনার সঙ্গে পেরে উঠবে বলে তিনি মনে করেন না। এআই-কে ব্যবহার করে হয়তো কিছু ভেজাল কবিতা রচিত হবে, নকল ছবি আঁকা হবে, কিন্তু তা মানবিক সৃজনশীলতার বিকল্প হয়ে উঠতে পারবে না। এর মূলে সেই মানুষের মাল্টিপল ভিশন, ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্সের বিষয়টিই কাজ করবে। তবে তাঁর মতে, একটা লড়াই বোধ হয় শুরু হয়ে গিয়েছে, মানব রচিত টেক্সটের সঙ্গে এআই-প্রসূত লেখালিখির পার্থক্য নির্ণয়ের লড়াই। এআই-প্রসূত লেখালিখিকে চিহ্নিত করার কাজটাই এই মুহূর্তে জরুরি।

একই রকম প্রত্যয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক অভীক মজুমদারেরও। উল্লেখ্য, অভীক নিজেও এক জন কবি ও প্রাবন্ধিক। তাঁর কথায়, “এর মধ্যে আমি দুর্ভাবনার কিছু দেখতে পাচ্ছি না। এআই রচিত কবিতা হয়তো কিশোরকণ্ঠী, লতাকণ্ঠী গায়কদের মতো হবে। তার বেশি কিছু নয়।” অভীক সেই সঙ্গে জানালেন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ডিজিটাল হিউম্যানিটিজ়’ নামে এক নতুন বিষয় পড়ানো হচ্ছে। যার উদ্দেশ্য ডিজিটাল প্রযুক্তিকে মানববিদ্যা চর্চার কোন কোন ক্ষেত্রে কী কী কাজে লাগানো যায়, তার অনুসন্ধান। কিন্তু তাঁর কাছে এআই-কে কাজে লাগিয়ে কবিতা লেখার প্রস্তাব নিতান্তই হাস্যকর। তাঁর প্রশ্ন, কবি কি সর্বদাই নিজের কবিখ্যাতির জন্য কবিতা লেখেন? লিখনক্রিয়ার মধ্যে যে সুখ নিহিত রয়েছে, অর্থাৎ, কবি একটি কবিতা লিখে বা লিখতে লিখতে যে সুখানুভূতি লাভ করেন, তা থেকে কে তাঁকে বঞ্চিত করবে? কোনও যান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দ্বারা তা সম্ভব নয়। এখন পাঠক যদি পড়তে চান, তাঁরা এআই-এর লেখা কবিতা পড়তেই পারেন। তাতে কবির মৌলিক কবিতা লেখার কাজটি কখনওই বিঘ্নিত হবে না। কেউ কেউ এআই-কে দিয়ে কবিতা লিখিয়ে কবিখ্যাতি চাইতেই পারেন, কিন্তু সকলে একই কাজ করবেন না। কবির কাছে কবিতা রচনা একটা ‘পারফরম্যান্স’, যা নৃত্য বা সঙ্গীতের মতোই। সেখানে কেউ আপস করতে চাইলেও পারবেন না।

ময়ূর বন্দ্যোপাধ্যায় এক বহুজাতিক সংস্থায় তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী হিসাবে কর্মরত। এই পেশায় তিনি দু’দশক কাটিয়ে ফেলেছেন। প্রসঙ্গ তোলায় তিনি কিছু জরুরি বিষয়ের দিকে আলো ফেললেন। তাঁর মতে, কবি এক জন ‘দ্রষ্টা’। যন্ত্রের সেই দৃষ্টি নেই। ফলে তার লেখা কবির চাইতে আলাদা হতে বাধ্য। এআই তার নিজস্ব লজিক মেনে কিছু ‘র‌্যান্ডম’ শব্দ বসাতে পারে। তাতে কি মানবিক চিন্তনের ছাপ থাকবে? এআই লিখিত কবিতায় যদি পাঠক অন্য রকমের নন্দন খুঁজে পান, তবে কিছু করার নেই। তিনি মনে করেন, এআই লিখিত কবিতায় একঘেয়েমি আসতে বাধ্য। তবে যে প্রজন্ম এআই-এর মধ্যে বেড়ে উঠছে, তারা একে কী ভাবে ব্যবহার করবে, তা ভবিষ্যৎ বলবে।

একসঙ্গেই ময়ূর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ তুললেন। সেটা কপিরাইট সংক্রান্ত। এআই লিখিত ‘শিল্পকর্ম’ বিষয়টি কপিরাইট সংক্রান্ত এক ত্রিস্তরীয় জটিলতা তৈরি করেছে ইতিমধ্যেই। এআই রচিত লিখন বা অন্য শিল্পের কপিরাইটের দাবিদার কে হবেন— যিনি এআই-কে কাজে লাগিয়ে শিল্পটি তৈরি করেছেন, তিনি? না কি যিনি এআই-কে সেই শিল্প সংক্রান্ত ডেটা ফিড করেছেন, তিনি? অথবা তিনি, যাঁর রচনা থেকে ডেটা তৈরি করা হয়েছে, সেই আদি লেখক বা শিল্পী? সম্প্রতি জাপানি শিল্পী মিয়াজ়াকির স্টুডিয়ো জিবলির অ্যানিমেশন অনুকরণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে যে কার্টুন বানানোর ঢল নেমেছে, সেখানে যদি এই প্রসঙ্গ তোলা যায়, তা হলে সে সব কার্টুনের কপিরাইট কার? যিনি কার্টুনটি তৈরি করে পোস্ট করছেন, তাঁর? না কি যিনি মিয়াজ়াকির অ্যানিমেশনের আঙ্গিককে ডেটা হিসাবে এআই-কে ‘খাইয়েছিলেন’, তাঁর? না কি স্বয়ং মিয়াজ়াকি এবং তাঁর স্টুডিয়ো জিবলি-ই এর প্রকৃত স্বত্বাধিকারী? এই জট ছাড়াতে না পারলে এআই-এর শিল্পসৃষ্টি মেধাস্বত্ব আইনের বেড়াজালে আটকে থাকবে।

এর পরেও দুর্ভাবনার কিছু বিষয় থেকেই যায়, জানালেন নব্বইয়ের দশকের কবি শিবাশিস মুখোপাধ্যায়। তাঁর মতে, কবিতার নির্দিষ্ট কোনও সংজ্ঞা হয় না। সমাজমাধ্যমের আধিপত্যের যুগে লিখনের যথেচ্ছাচারিতার দুয়ার খুলে গিয়েছে। ব্যাকরণই যেখানে ব্রাত্য, সেখানে কবিতার কী হবে? কোনটা কবিতা আর কোনটা কবিতা নয়, তার মাপকাঠি কে নির্ধারণ করবে? আপলোড হওয়া লক্ষ লক্ষ ডেটা থেকে যদি এআই-কে ব্যবহার করে কেউ দাবি করেন, সেটাই কবিতা, কে আপত্তি তুলতে আসবেন? এবং কিসের ভিত্তিতেই বা আসবেন? এআই-কে যখন আরও বেশি ডেটা ফিড করানো হবে, সঙ্কট তখনই দেখা দেবে। শব্দের পারমুটেশন-কম্বিনেশনের খেলায় এআই কিছু একটা দাঁড় করিয়ে দিতেই পারে। শিবাশিসের কথায়, “এ ব্যাপারে কোনও মৌলবাদ চলে না।” ফলে কবিতার ভবিষ্যৎ তাঁর কাছে ধোঁয়াটেই।

কল্পবিজ্ঞান লেখক আইজ়্যাক অ্যাসিমভ তাঁর রোবট কাহিনিমালায় তিনটি রোবটিক আইনের প্রসঙ্গ এনেছিলেন। আজ বিজ্ঞানের বিশ্বও সেই তিন আইনকে মান্যতা দেয়। এগুলি হল— ১) রোবট মানুষের কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। ২) রোবট সর্বদা মানুষের আদেশ মানতে বাধ্য। এবং ৩) আগের দুই আইনের সঙ্গে যত ক্ষণ না সংঘাত বাধছে, রোবট নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে সচেষ্ট থাকবে। সে দিক থেকে দেখলে কবিতা রচনা মানবিক ক্রিয়া। তার কোনও ক্ষতিসাধন করা রোবটের (পড়ুন, এআই) সম্ভব নয়। কিন্তু এর পরেও কিছু ‘কিন্তু’ থেকে যায়। কল্পবিজ্ঞান কাহিনিতে রোবট বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বার বার এই তিন আইনের সীমা লঙ্ঘন করে এবং মানুষকে তাদের কাণ্ডে নাজেহাল হতে হয়। পোল্যান্ডের কল্পবিজ্ঞান লেখক স্তানিসোয়াভ লেম থেকে শুরু করে বাংলার সত্যজিৎ রায় রোবটদের এই আইন না মানা নিয়ে আখ্যান লিখে গিয়েছেন। স্বয়ং অ্যাসিমভও তা-ই লিখেছেন। এখন যদি শঙ্কু কাহিনির বিধুশেখর বা রোবু-র মতো বিগড়ে গিয়ে এআই মানুষের ‘কম্যান্ড’ অগ্রাহ্য করে তার বাইনারি যুক্তির জগৎসীমা টপকে ফেলে, যদি মহাকম্পিউটার কম্পু-র মতো মৃত্যুর ও পাশে কী রয়েছে, তা জানতে উদ্‌গ্রীব হয়ে ওঠে, তবে তা ভয়ের কথা। কিছু দিন আগে এআই বিগড়ে গিয়ে ভারতেরই এক প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার্থীকে মরতে বলেছিল বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। লক্ষণ যে খুব ভাল, তা বলা যায় কি? আপাতত সুবোধ বালক সেজে মানুষের সঙ্গে চ্যাট করা বা অন্য কবির ‘ডেটা’ থেকে বানিয়ে কবিতা লিখে চলা এআই তলে তলে কোনও ফন্দি আঁটছে না তো?

Advertisement
আরও পড়ুন