ছবি : সংগৃহীত।
আপনার লক্ষ্য কী? আগামী এক বছরে কিংবা আজ থেকে পাঁচ বছর পরে নিজেকে কোথায় দেখতে চান? হয়তো কেরিয়ারের সিঁড়িতে আরও কয়েক ধাপ উপরে ওঠাই আপনার স্বপ্ন। বা হয়তো চান একটি গাড়ি কিনতে বা নিজের বাড়ি বানাতে। সঞ্চয় করা, পেশাদার হিসাবে নিজের দক্ষতা বৃদ্ধিও লক্ষ্য হতে পারে কারও। আবার কেউ ভাল সরকারি চাকরি পেতে চান, আত্মোন্নতি, এমনকি, বিদেশ ভ্রমণের স্বপ্নও দেখতে পারেন কেউ কেউ। মুশকিল হল, লক্ষ্য স্থির করা এবং তা পূরণ করার মধ্যে যে দীর্ঘ পথ, সেটি মসৃণ হয় না সব সময়। কখনও প্রতিকূলতা আসে, কখনও ঘটে মনকে বিপথে চালিত করার মতো ঘটনা। সেই সব বাধা বিপত্তি পেরিয়েও শেষ পর্যন্ত যাঁরা লক্ষ্যে অবিচল থেকে স্বপ্নপূরণ করতে পারেন আর যাঁরা পারেন না, তাঁদের মধ্যে একটি মূলগত পার্থক্য দেখা গিয়েছে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায়। দেখা গিয়েছে, যাঁরা সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের মধ্যেই একটি বিষয়ে মিল রয়েছে। প্রত্যেকেই তাঁদের কাজ, লক্ষ্য লিখে লিখে এগিয়েছেন! মনোবিদেরা বলছেন, এই অভ্যাসই হল ‘স্ক্রিপ্টিং’।
স্ক্রিপ্টিং কী?
স্ক্রিপ্টিং কোনও নতুন বিষয় নয়। বরং অল্পবিস্তর প্রত্যেকেই কখনও না কখনও করেছেন। হয়তো কোনও এক দিন অনেক কাজ করার আছে। হয়তো কারও জন্মদিনের পার্টির পরিকল্পনা করছেন বা পুজোর শপিং করতে যাবেন, তার আগে খাতা-কলম টেনে নিয়ে নিশ্চয়ই লিখে নেন, কী কী কিনতে হবে বা কাকে কী বলতে হবে, যাতে কাজটি গুছিয়ে করতে পারেন। যে লক্ষ্য স্থির করছেন, তার জন্য যা যা করতে হবে বলে ভাবছেন, তা আগে থেকে খাতায় কলমে লিখে রাখার ওই অভ্যাসকেই বলা হয় ‘স্ক্রিপ্টিং’। গবেষণা বলছে, স্ক্রিপ্টিং নিয়মিত করলে তা জীবনের লক্ষ্যপূরণের প্রক্রিয়াকেও অনেকখানি গুছিয়ে দিতে পারে।
স্ক্রিপ্টিং কি কার্যকরী?
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বলছে স্ক্রিপ্টিং করে সাফল্য এসেছে। গবেষণাটি চালানো হয়েছিল, হার্ভার্ডের এমবিএ শিক্ষার্থীদের উপরে। কারণ একটি হিসাবে দেখা গিয়েছিল, হার্ভার্ডে শিক্ষাপর্ব শেষ করার পরে এমবিএ-র শিক্ষার্থীদের তিন শতাংশ যা উপার্জন করেন, তা বাকি ৯৭ শতাংশের মিলিত উপার্জনের থেকেও বেশি। কেন এতটা পার্থক্য? তা খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, ওই তিন শতাংশ তাঁদের লক্ষ্য কাগজে কলমে লিখেছেন। বাকিরা তা লেখেননি।
স্ক্রিপ্টিংয়ের অভ্যাস কতটা কার্যকরী হতে পারে, এক সাক্ষাৎকারে সেই কাহিনি জানিয়েছেন, একটি প্রকাশনা এবং প্রচার সংক্রান্ত সংস্থার প্রধান নম্রতা। তিনি জানাচ্ছেন, ২০২১ সালে একটি স্ট্রোক হয় তাঁর। তার পর থেকে কথা বলতে অসুবিধা হত। টানা কথা বলতে পারতেন না। অথচ ব্যবসা এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে কথা বলতে হবে। তাই তিনি যে কোনও ফোন করার আগে ফোনের সম্ভাব্য কথোপকথন লিখে রাখতেন। নম্রতা বলছেন, ‘‘তাতে দারুণ সুবিধা হত, আমি গ্রাহকের কাছে আমার বক্তব্যকে আরও বেশি যুক্তিনির্ভর এবং বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারতাম।’’ পরবর্তী কালে তিনি আগে থেকে লিখে পরিকল্পনা করার ওই পদ্ধতি অন্যান্য ক্ষেত্রেও কাজে লাগান। আর আজ তিনি তাঁর ব্যবসাকে সফল ভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছেন।
স্ক্রিপ্টিং যে কার্যকরী, তা আরও একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে। ডোমিনিক্যান বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা বলছে, যাঁরা নিজেদের লক্ষ্য লিখে নিয়ে কাজ করেছেন, তাঁদের লক্ষ্যপূরণের সম্ভাবনা বাকিদের থেকে ৪২ শতাংশ বেশি। গবেষকদের প্রধান চিকিৎসক গেইল ম্যাথ্যুজ়ের কথায়, ‘‘যে কোনও জিনিস লেখার সময় আমাদের মস্তিষ্কে তা অনেক বেশি গেঁথে যায়। তাতে লক্ষ্যে স্থির থাকতে সুবিধা হয়।’’
কেন স্ক্রিপ্টিং কাজ করে?
স্ক্রিপ্টিং লক্ষ্যপূরণে সাহায্য করে, তার প্রথম কারণ হল, লিখলে লক্ষ্য অনেক বেশি পরিষ্কার থাকে। তা নিয়ে অযথা বিভ্রান্তি থাকে না। এমনটাই মনে করেন মনোবিদ রিম্পা সরকার। তাঁর কথায়, ‘‘লক্ষ্য লিখে রাখলে বরং তা আপনার অবচেতনে থেকে যায়। অবচেতনে এই বার্তা থাকে যে, ওই লক্ষ্যটি গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া মস্তিষ্কের রেটিকুলার অ্যাক্টিভেটিং সিস্টেমও সক্রিয় হয়ে যায়। ফলে মস্তিষ্ক যথাযথ সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। সুযোগ এলে তা ব্যবহার করতে ভুল হয় না।’’
মনস্তত্ত্ব বিষয়ে পরামর্শদাতা অশ্বিনী শাহ আবার মনে করেন, লক্ষ্যের কথা লিখে রাখা অনেকটা নিজের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার মতো। সেই চুক্তি পূরণ করার একটা দায় আপনা থেকেই অনুভূত হতে থাকে। অশ্বিনী বলছেন, ‘‘লক্ষ্য লিখে রাখার সময় আরও একটি বিষয় কাজ করে। আমরা আমাদের লক্ষ্যপূরণের বাস্তবতাও বিচার করি। স্বপ্ন অনেক রকমই থাকে। কিন্তু লক্ষ্য হিসাবে যখন আমরা কাগজে কলমে কিছু লিখছি, তখন আমরা তা পূরণ করার পন্থাও ভাবি। সেই ভাবনা থেকে লক্ষ্য অনেক বেশি বাস্তববানুগ হয়ে ওঠে। অর্থাৎ এমন লক্ষ্য, যা পূরণ করা অসম্ভব নয়।’’
লিখলে ভাল হবে জেনেও লেখেন না অনেকে
তার কারণ যে কোনও বিষয়ই লেখা হলে তার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার একটা দায়বদ্ধতা আসে। সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ না করতে পারার ভয় থেকে অনেকে লিখতে চান না। আবার কেউ ভাবেন, তাঁদের স্বপ্ন বা লক্ষ্য বাস্তবসম্মত নয়। তাই তাঁরা লেখেন না।
কী ভাবে স্ক্রিপ্টিংয়ের অভ্যাস করবেন?
১। নির্দিষ্ট সময় ঠিক করুন। প্রতিদিন ৫-১০ মিনিট সময় দিন স্ক্রিপ্টিংয়ের জন্য। সেটা রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময়ে হতে পারে। সকালে চা খেতে খেতেও লিখতে পারেন।
২। ইতিবাচক কোনও কথা দিয়ে লেখা শুরু করতে পারেন। ধরুন লিখলেন, ‘‘স্বনির্ভর হওয়ার জন্য সঞ্চয় করতে হবে। তার জন্য যা যা দরকার...।’’
৩। বড় লক্ষ্য স্থির করার পরে সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য ছোট ছোট লক্ষ্য ঠিক করুন। প্রতিদিনের লক্ষ্য ঠিক করুন। এবং তা পূরণ হচ্ছে কি না, তা-ও লিখুন।
৪। প্রতি সপ্তাহে দেখুন, কতটা উন্নতি হয়েছে। তার উপর ভিত্তি করে পরবর্তী লক্ষ্য স্থির করুন।
৫। প্রতিদিন স্ক্রিপ্টিংয়ের পরে নিজের লক্ষ্য এবং সাফল্যের কথা ভাবুন।