আলাপ হওয়ার সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই রাহুল যখন বলল “তোমায় ছাড়া আমি বাঁচব না,” তখন কিছুটা অবাক হলেও নীলাঞ্জনার ভালই লেগেছিল। সেই শুরু। তার পরে রোজ অসংখ্য মেসেজ, একাধিক বার ফোন, ঘন ঘন দেখা করা, মাঝেমধ্যেই ফুল-উপহার পেয়ে নীলাঞ্জনার মনে হয়েছিল, যেন কোনও রোম্যান্টিক সিনেমার মধ্যে রয়েছে। কিন্তু রোমাঞ্চ কয়েক মাসের মধ্যেই বদলে যেতে থাকল অস্বস্তিতে। সে ব্যস্ত থাকলে রাহুলের বিরক্তি, ফোন ধরতে দেরি হলে রাগ, অন্য বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও গেলে সন্দেহ। নীলাঞ্জনার মনে হতে থাকল, ভালবাসার এমন প্রকাশ কি আদৌ স্বাভাবিক?
মনোবিদেরা জানাচ্ছেন, নীলাঞ্জনার এমন অভিজ্ঞতার পোশাকি নাম ‘লাভ বম্বিং’। পপুলার কালচার ও সাইকোলজির ক্ষেত্রে সম্প্রতি এই শব্দবন্ধটির ব্যবহার বেড়েছে। এটি এমন আচরণ, যেখানে কাউকে অতিরিক্ত ভালবাসা, মনোযোগ এবং উপহারে ভরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্ত তার আসল উদ্দেশ্য হল, অন্য মানুষটিকে নিজের ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করা। অন্যদের কাছ থেকে তাকে সরিয়ে এনে নিজের কাছে কুক্ষিগত করে রাখার চেষ্টা, যা অনেক ক্ষেত্রেই অ্যাবিউজ়ের প্রাথমিক লক্ষণ।
লাভ বম্বিং কী?
লাভ বম্বিং-এর অর্থ হল মাত্রাতিরিক্ত মনোযোগ। সম্পর্কের স্বাভাবিক গতি উপেক্ষা করে একেবারে শুরুতেই এমন ভাবে ভালবাসা, যত্ন আর মনোযোগ দেওয়া হয় যে এক জন মানুষ মনে করেন, তিনি অন্য জনের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
মনস্তত্ত্ববিদ শতভিষা চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “আমরা সবাই স্বাভাবিক ভাবে প্রশংসা আর মনোযোগের প্রতি আকৃষ্ট হই। কিন্তু একটা মাত্রার বেশি কিছুই ভাল নয়। অতিরিক্ত কিছু হলেই তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।”
প্রধানত প্রেমের সম্পর্কেই এই আচরণ বেশি দেখা যায়। তবে বন্ধুত্ব, পারিবারিক সম্পর্ক, এমনকি কর্মক্ষেত্রেও লাভ বম্বিং হতে পারে। যেখানে নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাব বিস্তারের সুযোগ আছে, সেখানেই এই প্রবণতা তৈরি হতে পারে বলে জানাচ্ছেন মনোবিদেরা।
কেন ঘটে লাভ বম্বিং?
সব গভীর আবেগ বা দ্রুত ভালেবেসে ফেলাই যে খারাপ, তা নয়। তবে লাভ বম্বিংয়ের ক্ষেত্রে এমন আচরণের নেপথ্যে কিছু কারণ থাকে। যেমন,
সম্পর্কের উপরে প্রভাব
শুরুতে এমন আচরণ স্বপ্নের মতো লাগে। কিন্তু ধীরে ধীরে বোঝা যায় যে এর জটিল প্রভাব পড়ছে সম্পর্কের উপরে। কী সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়?
অন্য সম্পর্কে লাভ বম্বিং
প্রেমের সম্পর্ক ছাড়াও লাভ বম্বিং ঘটতে পারে। কী ভাবে চেনা যাবে তেমন আচরণ?
তবে যে ধরনের সম্পর্কই হোক না কেন, লাভ বম্বিংয়ের ধরনটা সব ক্ষেত্রেই এক। প্রথমে বেশি মনোযোগ, সাহায্য দিয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি করা যাতে পরে অন্য জনের উপরে অনৈতিক প্রভাব খাটানো যায়।
চেনার উপায়
কোনও সম্পর্কের শুরুতেই দামি উপহার দেওয়া, নিরন্তর ফোন, মেসেজ, মনোযোগ দাবি, দ্রুত প্রেম বা বিয়ের প্রতিশ্রুতি, নিজের জন্য সময় চাইলে অপরাধী বোধ করানো— এগুলি হল লাভ বম্বিং চেনার সোজা উপায়।
শতভিষা চট্টোপাধ্যায় বলেন, “সুস্থ সম্পর্কে একটা ভারসাম্য থাকে। কোনও এক জনের মতো করেই অন্য জনকে বাঁচতে হয় না। সেখানে দু’জনেরই স্পেস থাকে, একে-অপরের প্রতি সম্মান থাকে, নিজের পছন্দ-অপছন্দ অনুযায়ী চলার সুযোগ থাকে। দু’জনেই নিজের ব্যক্তিসত্তাকে প্রকাশ করতে পারেন।” কিন্তু লাভ বম্বিংয়ের ক্ষেত্রে এক জনের পছন্দই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। সুস্থ সম্পর্ক একে-উপরকে চেনার সময় দেয়, ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় দেয়, লাভ বম্বিং সেখানে তাড়াহুড়ো করতে বাধ্য করে।
কী ভাবে সামলাবেন?
শেষ কথা
লাভ বম্বিং হয়েছে মানেই যে সম্পর্ক শেষ, তা না-ও হতে পারে। নিরাপত্তার অভাব বোধ, হীনম্মন্যতা থেকেও এমন আচরণ করতে পারেন কেউ। কিন্তু ব্যক্তিগত সীমারেখা স্পষ্ট ভাবে বলে দেওয়া এবং সময় নিয়ে এগোনো জরুরি। নাটকীয় জেশ্চার বা উপহারের চেয়ে ছোট ছোট মুহূর্তেই তৈরি হয় টেকসই সম্পর্ক। নিজের আবেগকে বাঁচিয়ে স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক গড়ে তোলার পথে তাই লাভ বম্বিং চিনে নেওয়া জরুরি।