বড়দিনের আগে ফের খবরের শিরোনামে ভারতের ধনকুবের শিল্পপতি গৌতম আদানি। দেশের অসামরিক বিমান পরিষেবা খাতে বিপুল লগ্নির পরিকল্পনা করছেন তিনি। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রটির বৃদ্ধির সূচক লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকায় সে দিকে নজর পড়েছে তাঁর। বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি সংবাদসংস্থা পিটিআইয়ের কাছে মুখ খোলেন গৌতম-পুত্র জিৎ আদানি। সেখানে তিনি বিনিয়োগের ইঙ্গিত দিতেই এই নিয়ে তুঙ্গে ওঠে জল্পনা। শুধু তা-ই নয়, এই ইস্যুতে ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছেন রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরাও।
চলতি বছরের ২৫ ডিসেম্বর থেকে যাত্রী পরিষেবা দেওয়া শুরু করবে নভি মুম্বই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ঠিক তার আগে দেশের অসামরিক উড়ান পরিষেবা নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের এক পদস্থ কর্তা। তাঁর দাবি, বছরে ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এই ক্ষেত্র। এর পরিপ্রেক্ষিতে পিটিআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে গৌতম-পুত্র জিৎ বলেন, ‘‘আগামী পাঁচ বছরে বিমানবন্দরের ব্যবসায় এক লক্ষ কোটি টাকা লগ্নির পরিকল্পনা রয়েছে আদানি গোষ্ঠীর।’’
ভারতের অসামরিক বিমান পরিবহণ ব্যবসায় গৌতম আদানি কোনও ভুইফোঁড় ব্যক্তি নন। বড়দিনে উদ্বোধন হতে চলা মহারাষ্ট্রের নতুন বিমানবন্দরটির নির্মাণকারী সংস্থা হল ‘নভি মুম্বই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট লিমিটেড’ বা এনএমআইএএল। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটির ৭৪ শতাংশ অংশীদারি রয়েছে গুজরাটের এই ধনকুবের শিল্পপতির হাতে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এ দেশের আরও কয়েকটি বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণ করছে আদানি গোষ্ঠী।
এনএমআইএএল জানিয়েছে, নভি মুম্বই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৈরির প্রাথমিক খরচ দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। বর্তমানে প্রায় দু’কোটি যাত্রী পরিবহণের সক্ষমতা রয়েছে এই বিমানবন্দরের। তবে, আগামী দিনে যাত্রীসংখ্যা বেড়ে ন’কোটিতে পৌঁছোবে বলে মনে করা হচ্ছে। তখন সংশ্লিষ্ট বিমানবন্দরে বিভিন্ন দেশের উড়োজাহাজ ওঠানামার সংখ্যা যে কয়েক গুণ বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য।
অতীতে জিভিকে গ্রুপের থেকে মুম্বই বিমানবন্দর অধিগ্রহণ করে আদানি গোষ্ঠী। এ ছাড়া অহমদাবাদ, লখনউ, গুয়াহাটি, তিরুঅনন্তপুরম, জয়পুর এবং মেঙ্গালুরুর বিমানবন্দরও পরিচালনা করছে তারা। তবে এগুলির সব ক’টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নয়। আগামী দিনে বিমানবন্দরের বেসরকারিকরণের নিলামে আদানি গোষ্ঠী যে আরও ‘আক্রমণাত্মক’ হবে, ইতিমধ্যেই তা জানিয়ে দিয়েছেন গৌতম-পুত্র।
পিটিআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জিৎ আদানি বলেন, ‘‘অসামরিক বিমান পরিষেবার সঙ্গে জড়িত বিষয়গুলির অন্যতম হল বিমানবন্দর। সেখানে আমরা গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করতে পেরেছি। আগামী দিনে আরও ১১টি বিমানবন্দরকে নিলামে চড়াবে কেন্দ্র। সেখান থেকে ওগুলি পেতে ১০০ শতাংশ আক্রমণাত্মক ভঙ্গি থাকবে আমাদের।’’
এর আগে বিমানের রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত ও পরিচালনা বা এমআরও (মেইনটেনেন্স, রিপেয়ার, অপারেশনস) এবং উড়োজাহাজ ওড়ানোর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (ফ্লাইট স্টিমুলেশন ট্রেনিং সেন্টার) বিনিয়োগের ইঙ্গিত দিয়েছিল আদানি গোষ্ঠী। সেই সংক্রান্ত একটি প্রশ্নের উত্তরে জিৎ বলেন, ‘‘ও ব্যাপারে এখনও কিছু বলব না। কারণ সেটা বেশি তাড়াতাড়ি প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়ে যাবে। এটুকু বলতে পারি দীর্ঘমেয়াদি কৌশল চূড়ান্ত করে আমরা মাঠে নামছি। অসামরিক বিমান পরিষেবা ব্যবসায় দক্ষতা এবং গভীরতা বৃদ্ধি করতে চাই।’’
আদানি গোষ্ঠী মনে করে, আগামী এক দশক ভারতের বিমান পরিবহণ ক্ষেত্র, বিশেষত বিমানবন্দর এবং বিমান সংস্থাগুলি মধ্যম বৃদ্ধির হার বজায় রাখবে। গৌতম-পুত্র জিতের কথায়, ‘‘এখানকার তরুণ প্রজন্মের মধ্যে উড়োজাহাজে চড়ার প্রবণতা বাড়ছে। ফলে এতে বৃদ্ধির হার ১৫ থেকে ১৬ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করবে বলে আমরা আশাবাদী।’’ এ ব্যাপারে অবশ্য চিনের উদাহরণ টেনেছেন তিনি।
জীত জানিয়েছে, বর্তমানে ড্রাগনভূমির নিরিখে মাথাপিছু বিমানভ্রমণের দিক থেকে অনেকটাই পিছিয়ে আছে ভারত। বৃদ্ধির সূচক এ দেশের শহরাঞ্চলগুলিতেও অনেকটাই কম। সেই অঙ্ক বাড়াতে আদানি গোষ্ঠী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে চলেছে বলে স্পষ্ট করেছেন তিনি। অসামরিক বিমান পরিবহণের চ্যালেঞ্জগুলির কথাও উদাহরণ দিয়ে বলতে শোনা গিয়েছে তাঁকে।
এ প্রসঙ্গে মুম্বইয়ের ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সীমাবদ্ধতার কথা বলেছেন জীত। তাঁর কথায়, ‘‘২০১৬ সাল থেকে এই বিমানবন্দরের পরিষেবা যথেষ্টই সীমাবদ্ধ ছিল। অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহণের চাহিদা কখনওই সে মেটাতে পারেনি। নভি মুম্বই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ক্ষেত্রে সেই সমস্যা নেই। এখানে পরিষেবা আগামী দিনে আরও বৃদ্ধি করা যাবে। সেই সুযোগ এবং পরিকাঠামো দুটোই রয়েছে।’’
বিশেষজ্ঞদের দাবি, আগামী দিনে আকারে অন্তত চার গুণ বড় হবে নভি মুম্বই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। আর তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে আদানি গোষ্ঠীর বিমানবন্দর শাখা ‘আদানি বিমানবন্দর হোল্ডিং লিমিটেড’ বা এএএইচএল। বর্তমানে এটি দেশের বৃহত্তম বিমানবন্দর পরিকাঠামো পরিচালনাকারী সংস্থা। এএএইচএল দেশের মোট উড়ান যাত্রী পরিবহণের ২৩ শতাংশ এবং পণ্য পরিবহণের ৩৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে বলে জানা গিয়েছে।
অসামরিক বিমান পরিষেবার পাশাপাশি শহরাঞ্চলের বিভিন্ন পরিকাঠামো উন্নয়নমূলক প্রকল্পের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে এএএইচএল। জীত আদানি বলেছেন, ‘‘আমরা দুটো ব্যবসাকে আলাদা করছি। একটা হল বিমানবন্দরের পরিকাঠামো এবং অন্যটা হল বিমান পরিষেবা।” ২০১৯ সালের বেসরকারিকরণের প্রথম পর্যায়ে অহমদাবাদ, লখনউ, গুয়াহাটি, তিরুঅনন্তপুরম, জয়পুর এবং মেঙ্গালুরু, এই ছ’টি বিমানবন্দরকে অধিগ্রহণ করে আদানি গোষ্ঠী। ২০২১ সালে জিভি গ্রুপের থেকে তাদের হাতে আসে নভি মুম্বই বিমানবন্দর।
কেন্দ্রীয় অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রক মোট ১১টি বিমানবন্দরকে ‘সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি’ বা পিপিপি (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) মডেলে চালানোর জন্য চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে ছ’টি ছোট বিমানবন্দর রয়েছে। অন্য দিকে ২০২৫ সালের মধ্যে ‘এয়ারপোর্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়া’র হাতে থাকা ২৫টি বিমানবন্দরকে ‘জাতীয় মুদ্রাকরণ পাইপলাইন’ প্রকল্পের আওতায় লিজ় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার।
সূত্রের খবর, ২২ মাইল এলাকা জুড়ে গড়ে ওঠা নভি মুম্বই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কম খরচে যাত্রী পরিবহণের সুবিধা চালু করার চেষ্টা চালাচ্ছে আদানি গোষ্ঠী। প্রাথমিক ভাবে ওই বিমানবন্দরে দুবাই, লন্ডন এবং সিঙ্গাপুরের যাত্রিবাহী উড়োজাহাজ ওঠানামা করবে বলে জানা গিয়েছে। এ ছাড়া পরবর্তী পর্যায়ে ওই বিমানবন্দর দিয়ে যাওয়া যাবে সৌদি আরব, ইজ়রায়েল, ফ্রান্স এবং জার্মানি।
গত বছর (পড়ুন ২০২৪ সাল) কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে জ়োমো কেনিয়াট্টা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চুক্তিভিত্তিক অধিগ্রহণের জন্য উদ্যোগী হয় গৌতম আদানির গোষ্ঠী। কিন্তু, সেই খবর জানাজানি হতেই প্রবল গণবিক্ষোভের মুখে পড়ে আফ্রিকার ওই দেশটির সরকার। শেষে তাতে হস্তক্ষেপ করে স্থানীয় আদালত। সংশ্লিষ্ট চুক্তির উপর জারি হয় স্থগিতাদেশ।
কেনিয়া সরকারের সঙ্গে হওয়া চুক্তি বাস্তবায়িত হলে জ়োমো কেনিয়াট্টা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংস্কার এবং একটি অতিরিক্ত রানওয়ে তৈরির কথা ছিল আদানি গোষ্ঠীর। পরিবর্তে আগামী ৩০ বছর এই বিমানবন্দরের মালিকানা থাকত শিল্পপতি গৌতম আদানির হাতে।
বিক্ষোভকারী কেনীয় বিমানকর্মীদের অভিযোগ ছিল, দেশের অন্যতম বড় ও গুরুত্বপূর্ণ এই বিমানবন্দরটিকে পুরোপুরি বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে সরকার। আদানির সঙ্গে চুক্তি বাস্তবায়িত হলে স্থানীয় কর্মীরা চাকরি হারাবেন বলে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল। যদিও তেমন কোনও আশঙ্কা নেই বলে বার বার বিবৃতি দিয়েছিল সেখানকার সরকার। তার পরেও বিক্ষোভ কমাতে ব্যর্থ হয় প্রশাসন।
দানি গোষ্ঠীর হাতে একের পর এক বিমানবন্দর তুলে দেওয়া নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই কেন্দ্রের প্রবল সমালোচনা করে আসছে দেশের শতাব্দীপ্রাচীন দল কংগ্রেস। লোকসভার বিরোধী দলনেতা তথা রায়বরেলীর সাংসদ রাহুল গান্ধী বলেছেন, ‘‘দেশের সম্পদ বিক্রি করে দিচ্ছে মোদী সরকার। আদানি গোষ্ঠীকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।’’
সব ছবি: সংগৃহীত।