ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে রেখেছে আমেরিকা। বহু আলোচনার পরেও ঝুলে আছে নয়াদিল্লি-ওয়াশিংটন বাণিজ্যচুক্তি। এই পরিস্থিতিতে আশার আলো দেখাল ওমান। এ দেশের পণ্যের জন্য দরজা খুলে দিয়েছে পশ্চিম এশিয়ার ওই দেশ। ফলে বিনা শুল্কে সেখানে কৃষিজাত পণ্য, বস্ত্র, ইঞ্জিনিয়ারিং ও বৈদ্যুতিন সামগ্রী, বিভিন্ন রাসায়নিক এবং গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশ বিক্রি করতে পারবে এখানকার যাবতীয় শিল্প সংস্থা। এ-হেন ভারত-ওমান শূন্য শুল্কের বাণিজ্যচুক্তিকে তাই নর্থ ব্লকের ‘মাস্টারস্ট্রোক’ বলে মনে করা হচ্ছে।
চলতি বছরের ১৮ ডিসেম্বর ওমান সফরে গিয়ে পশ্চিম এশিয়ার দেশটির সঙ্গে বাণিজ্যিক সমঝোতা করেন মোদী। সংশ্লিষ্ট চুক্তিটির পোশাকি নাম, ‘কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট’ বা সেপা। এর লক্ষ্য হল দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং পরিষেবা সহযোগিতা বৃদ্ধি। বিশেষজ্ঞদের দাবি, এর জেরে আগামী দুই থেকে তিন বছরে ওমানে ৫০ শতাংশ রফতানি বৃদ্ধির সুযোগ পাবে নয়াদিল্লি। গত আর্থিক বছরে (পড়ুন ২০২৪-’২৫) টাকার অঙ্কে এই পরিমাণ ছিল ৪০০ কোটি ডলার।
প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং ওমানের সুলতান হাইথাম বিন তারিকের উপস্থিতিতে সেপা সমঝোতায় সই করেন কেন্দ্রীয় শিল্প-বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়াল। উল্টো দিকে ছিলেন মাস্কাটের বাণিজ্য, শিল্প ও বিনিয়োগ প্রচারমন্ত্রী কাইস আল ইউসুফ। পরে এই ইস্যুতে দেওয়া যৌথ বিবৃতি থেকে জানা গিয়েছে, সেপায় ৯৮.০৮ শতাংশ শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের সুবিধা পাবে ভারত। ফলে ওমানে মোট রফতানির ৯৯.৩৮ শতাংশ পণ্যের ক্ষেত্রে নয়াদিল্লিকে দিতে হবে না কোনও কর। বিনিময়ে শুল্ক ছাড়া বাণিজ্যের সুবিধা পাবে মাস্কাটও।
বাণিজ্য মন্ত্রক জানিয়েছে, এ দেশের বাজারে ৭৭ শতাংশ শুল্কমুক্ত বাণিজ্য করতে পারবে ওমান। অর্থাৎ, ভারতের বাজারে মোট রফতানি সামগ্রীর ৯৪ শতাংশের উপর কোনও কর দিতে হবে তাদের। ফলে বেশির ভাগ পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক শূন্যে নেমে আসবে। তবে পেট্রোপণ্যকে এর আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। সেখানেও শুল্ক হ্রাস পাবে, তবে এক বারে নয়। পেট্রোপণ্যের ক্ষেত্রে ধাপে ধাপে শুল্ক কমানোর পরিকল্পনা করছে নয়াদিল্লি ও মাস্কাট।
গয়ালের দফতরের এক পদস্থ কর্তার কথায়, ‘‘শ্বেতপাথর বা মার্বেল, খেজুর এবং পেট্রোরাসায়নিক পণ্যের ক্ষেত্রে একটি কোটা ঠিক করছে ভারত সরকার। সেপার নিয়ম মেনে খেজুরের ক্ষেত্রে বার্ষিক কোটা হবে দু’হাজার টন। পলিথিলিন এবং পলিপ্রোপিলিনের ক্ষেত্রে কোটার পরিমাণ এক বছরের জন্য যথাক্রমে ১৫০ কেজি টন এবং ৭৫ কেজি টন ধার্য করা হয়েছে। এই কোটার মধ্যে সংশ্লিষ্ট পণ্যগুলি আমদানি করলে কোনও কর দিতে হবে না। এই সীমা অতিক্রম করলে স্বাভাবিক হারে শুল্ক নেবে প্রশাসন।’’
সেপায় পেট্রোরাসায়নিক-সহ বেশ কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্কছাড় পাঁচ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত পাওয়া যাবে বলে আপাতত ঠিক করেছে ভারত ও ওমান। বর্তমানে পশ্চিম এশিয়ার ওই দেশটিতে মাত্র ১৫.৩৩ শতাংশ পণ্য বিনাশুল্কে বিক্রি করতে পারে নয়াদিল্লি। এ দেশের অধিকাংশ সামগ্রীকে পাঁচ শতাংশ করের আওতায় রেখেছে মাস্কাট। অর্থাৎ, ৩৬৪ কোটি ডলার মূল্যের ভারতীয় পণ্য শুল্ক নিচ্ছে ওমানের সরকার।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, সেপা সমঝোতায় সর্বাধিক লাভবান হবে কৃষিপণ্য। বর্তমানে তার উপর ১০০ শতাংশ শুল্ক দিতে হয় নয়াদিল্লিকে। সেটা একলাফে শূন্যে নেমে আসবে। বিনা শুল্কে বাণিজ্যের তালিকায় আছে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য, মাছ, মাংস, মধু, শাকসব্জি, প্রক্রিয়াজাত খাবার, পশু ও উদ্ভিজ্জ চর্বি এবং তেলের মতো প্রাণিজ সামগ্রী। ওমান থেকে গড়ে ১৬ কোটি ৫০ লক্ষ ডলারের পণ্য আমদানি করছে ভারত। শুল্কের অঙ্ক শূন্যে নেমে এলে সেটা বেড়ে ১২০ কোটি ডলার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, আশাবাদী নর্থ ব্লক।
উচ্চ শুল্কের কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে করের মাত্রা কমিয়ে পাঁচ শতাংশে নামিয়ে আনার ব্যাপারে রাজি হয়েছে ভারত ও ওমান। সেই তালিকার একেবারে শুরুতেই আছে বস্ত্র বা কাপড়ের নাম। বাণিজ্য মন্ত্রকের কর্তাব্যক্তিরা জানিয়েছেন, বর্তমানে ১০ কোটি ৯০ লক্ষ ডলার মূল্যের কাপড় মাস্কাটে পাঠাচ্ছে দিল্লি। শুল্ক কমলে সেটাই বেড়ে ৪৩ কোটি ৮০ লক্ষ ডলারে পৌঁছোবে বলে মনে করা হচ্ছে। এ ছাড়া যন্ত্রপাতি, প্লাস্টিক ও রাবার, গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশ এবং বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের রফতানির সূচকও ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রকের অনুমান, যন্ত্রপাতি রফতানির পরিমাণ ২৬ কোটি ২০ লক্ষ ডলার থেকে বেড়ে ৩৬০ কোটি ডলারে গিয়ে পৌঁছোবে। প্লাস্টিক ও রাবারের ক্ষেত্রে ১১৯ কোটি ডলার এবং গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশের ক্ষেত্রে ১৯০ কোটি ডলার পর্যন্ত বাড়তে পারে রফতানি বাণিজ্য। বর্তমানে ৮.৫ কোটি ডলারের প্লাস্টিক ও রাবার এবং ৫.৭ কোটি ডলারের গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশ পশ্চিম এশিয়ার ওই দেশটিতে পাঠাচ্ছে এ দেশের বিভিন্ন সংস্থা।
সূত্রের খবর, বছরে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার মূল্যের বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম আমদানি করে থাকে ওমান। এর মধ্যে মাত্র ১২.৩ কোটি ডলারের বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম পশ্চিম এশিয়ার দেশটিতে পাঠায় ভারত। বিনা শুল্কে বাণিজ্যচুক্তির জেরে এই সূচকেরও উল্লেখ্যযোগ্য দৌড় দেখা যাবে বলে আশাবাদী দিল্লি। তবে এ ব্যাপারে কেন্দ্রের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হল চিন।
সেপা সমঝোতায় কম্পিউটার, ব্যবসা ও পেশাদার ক্ষেত্রে, অডিয়ো-ভিস্যুয়াল পরিষেবা, গবেষণা ও উন্নয়ন (রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট), শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা-সহ একাধিক ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে যৌথ ভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ওমান। এই চুক্তিটির আর একটি আকর্ষণ হল এ দেশের পেশাদারদের জন্য উন্নত গতিশীল কাঠামো নির্মাণ। এর জেরে পশ্চিম এশিয়ার দেশটিতে কর্মরত নয়াদিল্লির সংস্থাগুলি ২০ শতাংশের বদলে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ভারতীয় কর্মী রাখতে পারবে।
এ ছাড়া চুক্তিভিত্তিক পরিষেবা সরবরাহকারীদের থাকার সময়কাল দু’বছর পর্যন্ত বাড়ানোর বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছে ওমান। বর্তমানে সেটা রয়েছে ৯০ দিন। সেপা চুক্তিতে হিসাবরক্ষক, কর, স্থাপত্য প্রকৌশলী, চিকিৎসকের মতো দক্ষ পেশাদারদের জন্য দরজা খুলে দেওয়ার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে ওমান। যদিও সেখানে কিছু শর্ত রেখেছে মাস্কাট।
সেপায় আরও বলা হয়েছে, ওমানের প্রধান পরিষেবা খাতগুলিতে ভারতীয় সংস্থাগুলি বাণিজ্যিক উপস্থিতির মাধ্যমে ১০০ শতাংশ সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ পাবে। ফলে পশ্চিম এশিয়ার দেশটিতে পরিষেবা শিল্পের কাজ সম্প্রসারণের পথ যে নয়াদিল্লির সামনে খুলছে, তা বলাই বাহুল্য। আগামী দিনে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলি নিয়েও আলোচনায় বসার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে এই দুই দেশ।
এর আগে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির সঙ্গে ‘কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট’ বা সিইপিএ নামের একটি সমঝোতা করে ভারত। তাতে অবশ্য সোনা ও রুপোর অলঙ্কারকে বাদ রেখেছিল নয়াদিল্লি। ওমানের ক্ষেত্রেও দুগ্ধজাত পণ্য, চা, কফি, রাবার, তামাক, চর্মজাত পণ্য, খেলাধুলোর সরঞ্জাম এবং বেস ধাতুর স্ক্র্যাপের মতো সংবেদনশীল সামগ্রী এ দেশের বাজারে বিক্রি করার ক্ষেত্রে শুল্কছাড়ের আওতার বাইরে রেখেছে কেন্দ্রের মোদী সরকার।
এ-হেন সেপাকে ‘ঐতিহাসিক’ আখ্যা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন, ‘‘এটা আমাদের ভবিষ্যতের নীলনকশা, যা বাণিজ্য বাড়াবে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগের দরজা খুলে দেবে। মান্ডভি থেকে মাস্কাট পর্যন্ত আরব সাগর আমাদের সংযোগের শক্তিশালী সেতু। সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই আমাদের পূর্বপুরুষেরা সামুদ্রিক বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ঢেউ ও ঋতু বদলালেও ভারত-ওমান বন্ধুত্ব প্রতিটা বসন্তে আরও শক্তিশালী হয়েছে।’’
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে অবদানের জন্য ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী মোদীকে মাস্কাটের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘অর্ডার অফ ওমান’-এ ভূষিত করেন সে দেশের সুলতান হাইথাম বিন তারিক। পরে বাণিজ্যমন্ত্রী গয়াল বলেন, ‘‘এই চুক্তি পরস্পরের বাজারে একে অপরের প্রবেশাধিকার বাড়াবে, বিনিয়োগে গতি আনবে এবং গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিতে সহযোগিতা আরও গভীর করবে।’’
সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে গণমাধ্যমে মুখ খুলেছে ভারতের রফতানি সংগঠন ‘ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট অর্গানাইজ়েশন’। তাদের দাবি, সেপা ভারতীয় বাণিজ্যে বড় বদল আনবে। ওমানের ক্ষেত্রে এটি কোনও একক দেশের সঙ্গে দ্বিতীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এবং প্রায় দু’দশকের মধ্যে যা প্রথম।
ওমানের পাশাপাশি পশ্চিম এশিয়ার আর একটি দেশ জর্ডনেও সফর করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লাহের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীর করার আহ্বান জানান তিনি। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য দ্বিগুণ করে ৫০০ কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে নয়াদিল্লি।
সব ছবি: সংগৃহীত।