মাদ্রাজ হাই কোর্টের বিচারপতি জিআর স্বামীনাথনকে অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু করার দাবি জানিয়ে লোকসভার স্পিকারের কাছে একটি নোটিস জমা দিয়েছেন বিরোধী সাংসদেরা। মঙ্গলবার ডিএমকে-র সংসদীয় দলনেত্রী কানিমোজি, দলের লোকসভার নেতা টিআর বালু, সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব, কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরা লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লার কাছে অপসারণের দাবিপত্রটি জমা দেন।
বিচারপতি জি আর স্বামীনাথনকে অপসারণের জন্য ভারতীয় সংবিধানের ২১৭ অনুচ্ছেদ এবং ১২৪ অনুচ্ছেদের অধীনে প্রস্তাবটি আনা হয়েছে। মাদ্রাজ হাই কোর্টের বিচারপতি জি আর স্বামীনাথনকে অপসারণের জন্য বিরোধী সাংসদদের প্রস্তাবের নিন্দা করেছেন সুপ্রিম কোর্ট এবং ১৪টি হাই কোর্টের ৫৬ জন প্রাক্তন বিচারপতি।
তাঁরা জানিয়েছেন, অপসারণের এই প্রস্তাবকে হাতিয়ার করে বিচারব্যবস্থাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা চলছে। স্বামীনাথনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিন ধরেই পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ করে আসছে ডিএমকে। তবে দীপম-জট নিয়ে রায়ের পর বিচারপতিকে সরাতে আরও তৎপর হয়েছে এমকে স্ট্যালিনের সরকার।
কিন্তু কী এই দীপম-জট? তামিলনাড়ুর মাদুরাই শহরের কাছে রয়েছে তিরুপারঙ্কুন্দ্রম শহর। শহরটি তৈরি হয়েছে তিরুপারঙ্কুন্দ্রম নামে একটি একশিলা পাহাড়কে কেন্দ্র করে। তিরুপারঙ্কুন্দ্রম পাহাড় এবং তদ্সংলগ্ন এলাকা তামিলনাড়ুর উল্লেখযোগ্য ধর্মীয় স্থান।
পাহাড়ের কাছে একটি বহু পুরোনো মুরুগান (কার্তিক) মন্দির এবং একটি শতাব্দীপ্রাচীন দরগা— উভয়ই রয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রতীক ছিল পাহাড়টি। কিন্তু তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে পাহাড়টি ধর্মীয় রীতিনীতি নিয়ে বার বার সংঘাতের সাক্ষী হয়ে এসেছে, যা তামিলনাড়ুতে বার বার রাজনৈতিক উত্তেজনারও জন্ম দিয়েছে।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই নিয়ে বিরোধের সূত্রপাত ১৯৯৪ সালে। পাহাড়ের মাথায় কার্তিগাই দীপম (প্রদীপ) জ্বালানো নিয়ে উত্তেজনার সময় এক জন নিহত হন। ২০১৪ সালে দরগা সংলগ্ন মন্দিরের জমিতে মাংস খাওয়ার অভিযোগের পর বিতর্ক আবার তীব্র হয়ে ওঠে। এর পর পবিত্র রমজান মাসে ডিএমকে-এর সহযোগী নাভাস কানি একটি ছাগল বলিদান করলে পরিস্থিতি আরও চরমে পৌঁছোয়।
২০২৩ সালে পাহাড়ের নাম পরিবর্তনের একটি পৃথক প্রচেষ্টা রাজ্য জুড়ে বিক্ষোভের সূত্রপাত করে, যার পরে আদালত আনুষ্ঠানিক ভাবে স্থানটির আসল নাম তিরুপারঙ্কুন্দ্রমকে পুনর্বহাল করার রায় দেয়।
তামিলনাড়ুতে কার্তিক মাসের কার্তিক পূর্ণিমায় ‘কার্তিগাই দীপম’ জ্বালানোর রীতি রয়েছে। এই রীতি বহু পুরোনো। তামিলনাড়ুতে দিনটিকে অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর বিজয়ের প্রতীক হিসাবে উদ্যাপন করা হয়।
তবে রবি কুমার নামে এক ব্যক্তি তিরুপারঙ্কুন্দ্রম পাহাড়ের ‘দীপাথুন’ স্তম্ভে (স্থানীয়দের মতে যা একটি প্রাচীন প্রদীপ স্তম্ভ) ‘কার্তিগাই দীপম’ (প্রদীপ) জ্বালানোর অনুমতি চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার পর সাম্প্রতিক এই বিরোধ শুরু হয়।
ভক্তদের দাবি, পাহাড়ের উপর ওই স্তম্ভে একসময় ১,৩০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রদীপের শিখা জ্বলত। কিন্তু প্রায় ৮০ বছর আগে এই রীতি বন্ধ হয়ে যায়। তার পর থেকে পাহাড়ের মাঝামাঝি একটি গণেশ মন্দিরে প্রদীপ জ্বালানো হচ্ছে। মূল রীতি পুনরুদ্ধারের দাবি নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন রবি।
১ ডিসেম্বর মাদ্রাজ হাই কোর্টের বিচারপতি স্বামীনাথন ৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টার আগে পাহাড়ের উপরে প্রদীপ জ্বালানোর অনুমতি দিয়ে একটি আদেশ জারি করেন। রাজ্য সরকার এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করে যুক্তি দেয়, আট দশক ধরে ওই প্রথাটি পালন করা হয়নি। তাই নতুন করে প্রথাটি পালন করা হলে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উদ্বেগের কথাও উল্লেখ করে সরকার পক্ষ।
এর পর আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও ৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টার আগে প্রদীপটি জ্বালানো হয়নি। আদালতের নির্দেশ কেন পালন হল না, তা নিয়ে ভিডিয়ো কনফারেন্সের মাধ্যমে মাদুরাইয়ের জেলাশাসক এবং পুলিশ কমিশনারের কাছ থেকে উত্তর চান বিচারপতি স্বামীনাথন।
বিচারপতি এর পর আবেদনকারীদের সিআইএসএফ-এর সুরক্ষা নিয়ে পাহাড়ের উপরে যেতে এবং নিজেদেরই প্রদীপ জ্বালানোর অনুমতি দেন। কিন্তু তিরুপারঙ্কুন্দ্রম পাহাড় সংলগ্ন এলাকায় আগে থেকেই ১৪৪ ধারা বলবৎ ছিল। ফলে রাজ্যের পুলিশ প্রবেশপথ বন্ধ করে দেয়। সিআইএসএফ এসে রাজ্যে নিরাপত্তা মোতায়েনের বিষয়ে নাক গলাতে পারে না বলেও জানানো হয়।
এর পরেই অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে। জায়গায় জায়গায় ব্যারিকেড দেওয়া হলেও পাথর ছোড়াছুড়ি শুরু হয়। বিশৃঙ্খলা ছড়ায়। আহত হন বেশ কয়েক জন। কেন আদালতের আদেশ কার্যকর করা যায়নি এবং কেন নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশ জারি করা হয়েছিল সে সম্পর্কে সিআইএসএফ কমান্ড্যান্টের কাছ থেকে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদনও চেয়ে পাঠান বিচারপতি স্বামীনাথন।
৪ ডিসেম্বর হাই কোর্ট আবার অবমাননার অভিযোগের শুনানি করে এবং জেলাশাসককে ব্যক্তিগত ভাবে প্রস্তুতি তদারকি করার নির্দেশ দেয় এবং পুলিশ কমিশনারকেও অনুষ্ঠানটি নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
ইতিমধ্যে, রাজ্য সরকার মামলাটি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়। ভারতের প্রধান বিচারপতি নির্দেশ দিয়েছেন, রাজ্যের সমস্ত নথি জমা দেওয়ার পরেই মামলাটি তালিকাভুক্ত করা হবে।
বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক উত্তেজনাও ছ়ড়িয়েছে। বিজেপির অভিযোগ, ডিএমকে সরকার হাই কোর্টের নির্দেশ অমান্য করার এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা উস্কে দেওয়ার জন্য যা খুশি করছে। চেন্নাইয়ের ডিএমকে সদর দফতরের বাইরেও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
অন্য দিকে, বিজেপির অভিযোগের ভিত্তিতে ডিএমকে নেতাদের পাল্টা দাবি, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলি অশান্তি উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করছে। বিচার বিভাগের রাজনৈতিক চাপের কাছে নতিস্বীকার করার অভিযোগও এনেছে ডিএমকে।
পাশাপাশি, বিচারপতি স্বামীনাথনকে অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু করার দাবি জানিয়ে লোকসভার স্পিকারের কাছে একটি নোটিস জমা দিয়েছেন বিরোধী সাংসদেরা।
বিষয়টি ঘিরে আইনি জটিলতা, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং সাম্প্রদায়িক উদ্বেগ তীব্রতর হচ্ছে। তবে তিরুপারঙ্কুন্দ্রম পাহাড়ের ‘দীপাথুনে’ প্রদীপ এখনও জ্বলেনি। প্রদীপের ভবিষ্যত কী, আপাতত তা জানতে সুপ্রিম কোর্টের দিকেই তাকিয়ে সব পক্ষ।
সব ছবি: সংগৃহীত।