১৩ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার উঁচু একটি পোড়ামাটির পাত্র। তার ভিতরে তামার একটি সিলিন্ডার এবং তার মধ্যে একটি লোহার রড ঢোকানো। ভাবছেন তো এটা আবার কী!
এটি একটি ব্যাটারি। ১৯৩৬ সালে এমনই একটি ব্যাটারি খুঁজে বার করেছিলেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা। পরীক্ষানিরীক্ষার পর এর নাম দিয়েছিলেন ‘বাগদাদ ব্যাটারি’। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই ব্যাটারি তৈরি হয়েছিল খোঁজ মেলার দু’হাজার বছর আগে।
আধুনিক ইরাকের টেসিফোনের ধ্বংসাবশেষের কাছ থেকে অদ্ভুত এই ব্যাটারির খোঁজ মেলে। কিছু গবেষকের দাবি, ওই বস্তুটি দিয়ে নাকি বিদ্যুৎ তৈরির চেষ্টাও হয়েছিল! যদিও ‘বাগদাদ ব্যাটারি’ তৈরির মূল উদ্দেশ্য আজও অস্পষ্ট।
অনেকেই মনে করেন, জল নয়, কোনও রাসায়নিক তরল পদার্থ রাখা হত তামার সিলিন্ডারটিতে। যদিও ‘বাগদাদ ব্যাটারি’ যখন খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল, তখন সেটি অনেকটাই ক্ষয়ে গিয়েছিল।
ধারণা করা হয়, এই পাত্রের ভিতরে তামা ও লোহার রডের সঙ্গে কোনও অ্যাসিডিক বা ক্ষারীয় দ্রবণ মিশিয়ে রাখা হত, যা তড়িৎ-রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারত।
বিজ্ঞানীদের কথায়, যদি পাত্রের ভিতরে সঠিক রাসায়নিক দ্রবণ মেশানো হয়, তা হলে এটি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হতে পারে। তবে, এই নিয়ে বেশ কিছু মতবাদ রয়েছে।
অনেকে বিশ্বাস করেন, এটি কোনও ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক কাজের জন্য ব্যবহার করা হত, যেখানে রাসায়নিক বিক্রিয়ার তেমন কোনও ব্যাপারই ছিল না।
বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে বাগদাদ ব্যাটারি নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন। সেখান থেকে বেশ কিছু তথ্য উঠে এসেছে। ২০০২ সালে ‘প্লেটিং অ্যান্ড সারফেস ফিনিশিং জার্নাল’-এ একটি রিপোর্ট প্রকাশ হয়।
রিপোর্টে দাবি করা হয়, এই ব্যাটারি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তৈরি হয়নি। কারণ, সার্কিট বানানোর জন্য লোহা এবং তামার দু’টি অংশের সংযোগ প্রয়োজন। এই পাত্রের গঠন অনুযায়ী তা সম্ভব ছিল না।
শোনা যায়, ‘বাগদাদ ব্যাটারি’ খননকাজের সময় আরও অদ্ভুত কিছু মাটির পাত্রের খোঁজ পেয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। পাত্রগুলি দেখে প্রথমে একেবারেই সাধারণ মনে হয়েছিল বিজ্ঞানীদের। তবে এগুলি যে কোনও সাধারণ পাত্র নয়, তা অনেক পরে বুঝেছিলেন তাঁরা।
পাত্রগুলি প্রায় হাতের তালুর আকারের, লম্বায় মাত্র ১৫ থেকে ২০ সেন্টিমিটার। এই ধরনের গোটা চারেক পাত্র খনন করে পান বিজ্ঞানীরা।
পরে পরীক্ষা করে দেখা যায়, প্রতিটি পাত্রের মধ্যে লুকোনো রয়েছে ব্রোঞ্জের সিলিন্ডার— ছোট্ট, কিন্তু বেশ নিখুঁত ভাবে বানানো সেগুলি। ব্যাস মাত্র ৩ সেন্টিমিটার, দৈর্ঘ্য ৭.৫ সেন্টিমিটার।
কোনও সিলিন্ডারের ভিতরে পাওয়া গিয়েছিল শুকনো গাছপালার গুঁড়ো। আরও একটি পাত্র থেকে একেবারে ভিন্ন কিছু পেয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা— গোল করে পাকানো পাতলা কাগজের মতো একটি বস্তু, যার প্রান্ত দু’টি সুন্দর ভাবে ভাঁজ করা ছিল।
‘বাগদাদ ব্যাটারি’ তৈরির উদ্দেশ্য যেমন স্পষ্ট হয়নি, তেমনই এই পাত্রগুলিও কী কাজে ব্যবহার করা হত তার কোনও সঠিক কারণ বুঝতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। তবে তাঁদের ধারণা, এই পাত্রগুলিতেও যদি রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হত, তা হলে সেগুলি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব ছিল।
শেরিফ ইউসিফ ও জাওয়াদ আল-সফরের নেতৃত্বে ১৯৩৬ সালে ‘বাগদাদ ব্যাটারি’র খোঁজ মিলেছিল। তার পর সেটি বাগদাদ মিউজ়িয়ামে রাখা হয়। পরে ভিলহেল্ম কোনিক নামক জার্মান বিজ্ঞানী ‘বাগদাদ ব্যাটারি’ নিয়ে অনেক পরীক্ষা চালান।
তিনিই ১৯৩৮ সালে প্রথম এই পাত্রটিকে একটি প্রাচীন গ্যালভানিক সেল বা ব্যাটারি হিসেবে চিহ্নিত করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। পরে আরও বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে তাঁর প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছিলেন।
পাত্রটি বাগদাদ মিউজ়িয়ামেই রাখা ছিল। ২০০৩ সালে ইরাকে যুদ্ধ হয়। সে যুদ্ধে বিপুল ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইরাক। তখনই জাদুঘর থেকে হারিয়ে যায় ‘বাগদাদ ব্যাটারি’, যা আর কোনও দিন খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সব ছবি: সংগৃহীত।