আর্থিক তছরুপের অভিযোগ ওঠায় বিপাকে শিল্পপতি অনিল অম্বানী। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি তলব করেছে তাঁকে। চলতি বছরের ৫ অগস্টের মধ্যে তাদের নয়াদিল্লির দফতরে হাজিরা দিতে হবে রিলায়্যান্স ক্যাপিট্যালের কর্ণধারকে। তাঁর বিরুদ্ধে ১০ হাজার কোটি টাকার ‘ঋণখেলাপি’ মামলার তদন্ত চালাচ্ছে ইডি।
সংবাদসংস্থা পিটিআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বছর ৬৬-র ধনকুবের শিল্পপতি অনিলের বয়ান রেকর্ডের প্রস্তুতি নিচ্ছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। কিছু দিন আগে ভুয়ো ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি চক্রের পর্দাফাঁস করতে ওড়িশার ভুবনেশ্বর এবং এ রাজ্যের কলকাতায় তল্লাশি অভিযান চালায় ইডি। সূত্রের খবর, সেখানেই উঠে আসে রিলায়্যান্স ক্যাপিট্যালের কর্ণধারের নাম। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে আর্থিক তছরুপ প্রতিরোধ আইনে (মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন অ্যাক্ট) দায়ের হয় মামলা।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক ইডির এক পদস্থ কর্তা জানিয়েছেন, গত বছরের ১১ নভেম্বর অনিল অম্বানীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে দিল্লি পুলিশের আর্থিক অপরাধ দমন শাখা। এর কয়েক দিন আগেই বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালিয়ে অনিলের একাধিক সংস্থার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম এবং যৌথ ঋণে বিচ্যুতির সন্ধান মেলে বলে দাবি করেছেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা, যার অঙ্ক ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি বলে জানা গিয়েছে।
ইডি সূত্রে খবর, ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ইয়েস ব্যাঙ্কের দেওয়া প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার অবৈধ ঋণ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ছিল অম্বানীর একগুচ্ছ সংস্থা। বর্তমান মামলাটি সেই অভিযোগের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ফলে এতে রিলায়্যান্স ক্যাপিটালের কর্ণধারের গ্রেফতারির আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না কেউই। শেষ পর্যন্ত ইডি সেই সিদ্ধান্ত নিলে সেটা যে সাবেক রাজ্যসভার সাংসদের জন্য বড় ধাক্কা হবে, তা বলাই বাহুল্য।
শিল্পপতি অনিলের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমে ইতিমধ্যেই দেশের আর্থিক রাজধানী মুম্বইয়ের ৩৫টির বেশি জায়গায় তল্লাশি চালিয়েছে ইডি। মোট ৫০টি সংস্থা এবং ২৫ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে আর্থিক তছরুপ প্রতিরোধ আইনে মামলা রুজু করা হয়েছে। এঁরা প্রত্যেকেই রিলায়্যান্স ক্যাপিটাল কর্ণধারের মতোই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের রেডারে রয়েছেন। সংশ্লিষ্ট তদন্তের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইডির দিল্লি দফতরের অফিসারেরা।
ইডি সূত্রে খবর, ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ইয়েস ব্যাঙ্ক থেকে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয় অনিলের একাধিক সংস্থা। পরবর্তী কালে ওই ঋণ নিয়ম-বহির্ভূত ভাবে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। ফলে রিলায়্যান্স পাওয়ার এবং রিলায়্যান্স ইনফ্রাস্ট্রাকচারের দফতরে তল্লাশি চালায় কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা। যদিও অনিলের এই দুই কোম্পানি এর ব্যাখ্যা লিখিত ভাবে জানিয়েছে শেয়ার বাজার ও সেবিকে।
ইয়েস ব্যাঙ্কের ঋণ সংক্রান্ত এই ‘কারচুপি’র খবর প্রকাশ্যে আসতেই একই রকমের অভিযোগ অন্যান্য সংস্থার থেকেও পেতে শুরু করে ইডি। সেই তালিকায় রয়েছে ন্যাশনাল হাউসিং ব্যাঙ্ক, সিকিউরিটিজ় অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া (সেবি), ন্যাশনাল ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অথরিটি (এনএফআরএ) এবং ব্যাঙ্ক অফ বরোদা। কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের একাধিক তথ্যও সরবরাহ করেছে তারা।
প্রাথমিক তদন্তে ইডির অনুমান, অনিলের সংস্থাগুলিকে ঋণের অনুমোদন দিতে ব্যাপক অনিয়ম করেছে ইয়েস ব্যাঙ্ক। ঋণ আবেদনের আগের তারিখে সেই অর্থ দেওয়া হয়েছে তাদের। এ ছাড়া যে নিয়ম মেনে ব্যাঙ্কের শাখাগুলি ঋণ দিয়ে থাকে সেটাও ভাঙা হয়েছে।
তদন্তকারীদের আরও অভিযোগ, ইয়েস ব্যাঙ্কের অনুমোদিত ঋণের টাকা অনিল অম্বানীর একাধিক সংস্থার পাশাপাশি হস্তগত করে বেশ কিছু ভুয়ো কোম্পানি। নথি ছাড়া ঋণ দেওয়া, ভুয়ো ঠিকানা, এমনকি সংস্থার অধিকর্তাদের ব্যাপারেও ভুয়ো তথ্যের উপরে ভিত্তি করে সংশ্লিষ্ট ঋণ অনুমোদন করে ওই বেসরকারি ব্যাঙ্ক।
ইডি জানিয়েছে, সংশ্লিষ্ট তদন্তে বহু তথ্য দিয়ে তাদের সাহায্য করেছে সেবি। ইয়েস ব্যাঙ্কের সঙ্গে অনিল অম্বানীর একাধিক সংস্থার সম্পর্ক খতিয়ে দেখছে তারা। ঘুষের বিনিময়ে ওই ঋণ মঞ্জুর হয়েছিল বলে অনুমান কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের। সেই সংক্রান্ত প্রমাণ জোগাড় করতে কোমর বেঁধে লেগে পড়েছে তারা।
গোয়েন্দাদের সন্দেহ, বিদেশি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে এ দেশের থেকে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে থাকতে পারে শিল্পপতি অনিল বা তাঁর বিভিন্ন সংস্থা। এর প্রভাব আমজনতার উপরে পড়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। সম্পূর্ণ তছরুপের অঙ্ক ২০ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তাঁরা।
ইয়েস ব্যাঙ্ক থেকে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণের আবেদনকারী সংস্থাটি ছিল অনিলের ‘রাগা কোম্পানিজ়’। ইডির অভিযোগ, ঋণ মঞ্জুরের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাটির আর্থিক অবস্থা পর্যন্ত যাচাই করেনি ওই বেসরকারি ব্যাঙ্ক। ট্র্যাকরেকর্ড ভাল না হওয়া সত্ত্বেও তাদের ঋণ দেওয়া হয়।
রাগা কোম্পানিজ়ের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভিযোগ হল, আগের ঋণ পরিশোধ না করা সত্ত্বেও নতুন ঋণ মঞ্জুর করে ইয়েস ব্যাঙ্ক। এ ছাড়া অনিলের একাধিক সংস্থার ডিরেক্টর হিসাবে এক জনকেই তুলে ধরা হয়েছিল। একই ঠিকানায় একাধিক সংস্থার অবস্থান দেখানোর প্রমাণও পেয়েছেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা, খবর সূত্রের।
এই পরিস্থিতিতে রিলায়্যান্স হোম ফিন্যান্স লিমিটেডের বিরুদ্ধে একাধিক অনিয়মের অভিযোগ এনেছে সেবি। বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাটির দাবি, ২০১৭-’১৮ আর্থিক বছরে সংশ্লিষ্ট সংস্থাটির ঋণগ্রহণের ক্ষমতা ছিল ৩,৭৪২ কোটি টাকা। সেটাই হঠাৎ বেড়ে রহস্যজনক ভাবে ৮,৬৭০ কোটি টাকা হয়ে যায়।
এ ছাড়া শিল্পপতি অনিল এবং তাঁর সংস্থা রিলায়্যান্স কমিউনিকেশন্স সম্পর্কে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া বা এসবিআইয়ের দেওয়া রিপোর্ট মোটেই ইতিবাচক নয়। সেখানে এদের ‘জালিয়াত’ বলে উল্লেখ করে দেশের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক।
তবে এ বারই প্রথম নয়। ২০২০ সালের নভেম্বরে অনিল অম্বানী এবং রিলায়্যান্স কমিউনিকেশন্সের বিরুদ্ধে একই রকমের রিপোর্ট দিয়েছিল এসবিআই। ২০২১ সালের ৫ জানুয়ারি তাদের বিরুদ্ধে আর এক কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইয়ে (সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন) দায়ের হয় অভিযোগ। কিন্তু এক দিন পরেই দিল্লি হাই কোর্টের নির্দেশে সেই অভিযোগ তুলে নিতে বাধ্য হয় এসবিআই।
এ বারের তদন্তে রহস্যজনক একটি ‘সি কোম্পানি’-র হদিস পেয়েছে ইডি। এর ব্যাপারে খোঁজখবর শুরু করেছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। অনিলের সংস্থার ‘কারচুপি’র জন্য এসবিআই, ব্যাঙ্ক অফ বরোদা এবং মিউচুয়াল ফান্ডের আর্থিক লোকসানের আশঙ্কা রয়েছে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
তবে ৫ অগস্ট অনিল অম্বানী ইডি দফতরে আদৌ হাজিরা দেবেন কি না, তা অবশ্য জানা যায়নি। হাজিরার আগে তাঁর সামনে অবশ্য আদালতে যাওয়ার রাস্তা খোলা রয়েছে। সেখান থেকে রক্ষাকবচ পেতে পারেন দেশের অন্যতম ধনকুবের এই শিল্পপতি। শেষ পর্যন্ত তিনি কী করেন, সেটাই এখন দেখার।
সব ছবি: সংগৃহীত।