পৃথিবীতে ছড়িয়ে হাজারো রহস্যের আকর। মিশরের পিরামিডের প্রাচীন পাথর, আন্দিজ় পর্বতের মাথায় সুনিপুণ ভাবে তৈরি ইনকা শহর থেকে শুরু করে প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপে সমুদ্রের দিকে মুখ করে জেগে থাকা পেল্লায় পাথরের আবক্ষ মূর্তি। এই সমস্ত স্থাপত্যের আদি-অন্ত সম্পর্কে নিশ্চিত করে কেউই বলতে পারেননি। রহস্য আজও অধরা।
ভারতেও এমন কিছু কিছু জায়গা রয়েছে, যেখানে দু’দণ্ড দাঁড়ালে রহস্যময় ইতিহাসে ডুবে যায় মন। মানুষের তৈরি না প্রকৃতির জাদুবলে তৈরি, তার সঠিক উত্তর পেতে চায় অনুসন্ধিৎসু মন। তেমনই একটি রহস্যের খনি হল কর্নাটকের সহস্রলিঙ্গ।
ভারত অতুলনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ। এখানে অসংখ্য মনোমুগ্ধকর স্থান রয়েছে। সেই মুকুটের একটি রত্ন হল কর্নাটকের সিরসি শহরের এই বিখ্যাত তীর্থস্থানটি। এখানকার রহস্যের টানে প্রতি বছরই ছুটে আসেন অসংখ্য পর্যটক।
শ্রাবণ মাসে কর্নাটকের এই ঐতিহাসিক স্থানে পুণ্যার্থীদের ভিড় হয় চোখে পড়ার মতো। শয়ে শয়ে পুণ্যকামী মানুষ ও স্থানটির যোগসূত্র রয়েছে দেবাদিদেব মহাদেবের সঙ্গে।
সবুজে ঘেরা পশ্চিমঘাট পর্বতমালায় অবস্থিত উত্তর কন্নড়ের প্রাণকেন্দ্র সিরসি শহরটি। সিরসি থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে, সোন্দা গ্রামের কাছে, শান্ত ভাবে বয়ে চলেছে শালমালা নদী। বনভূমিতে ঘেরা এই নদীর খাতেই রয়েছে এক টুকরো ইতিহাস।
এই শালমালা নদীর তীরে পাথরে খোদাই করা প্রায় ১,০০০টি শিবলিঙ্গের দেখা মিলবে। কয়েকশো বছরের পুরনো সহস্রলিঙ্গ সারা দেশের ভক্তদের আকর্ষণ করে। প্রতি বছর মহা শিবরাত্রিতে এবং শ্রাবণ মাসে সারা বিশ্ব থেকে ভক্তেরা এখানে জড়ো হন।
গাঢ় ধূসর রঙের শিবলিঙ্গগুলি শক্ত গ্রানাইট পাথরের মতো। বড় এবং ছোট পাথরগুলিতে শিবলিঙ্গ খোদাই করা আছে। জনশ্রুতি আছে যে এখানে এক হাজারেরও বেশি লিঙ্গ রয়েছে। তাই এর নাম সহস্রলিঙ্গ। তাদের বেশির ভাগের উপর শিবের বাহন নন্দীর মূর্তি খোদাই করা আছে। আবার কিছু পাথরে একাধিক শিবলিঙ্গ খোদাই করা রয়েছে।
শালমালা নদীর নেত্রবতী ও কুমারধারা জলের মধ্যে রয়েছে এই অদ্ভুত শিবলিঙ্গগুলি। এগুলি কখনও দৃশ্যমান থাকে, আবার কখনও নদীর জলে ডুবে যায়। জলের স্তর কম থাকলে সহস্রলিঙ্গ ভাল ভাবে পরিদর্শন করা যায়। তখনই খোদাই করা মূর্তিগুলি পরিষ্কার ভাবে দৃশ্যমান হয়।
১৭১৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সিরসির তৎকালীন রাজা আরসাপ্পা নায়কের পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁর বংশধরদের জন্য খোদাই করা হয়েছিল এই মূর্তিগুলি। কিংবদন্তি অনুসারে রাজা অপুত্রক ছিলেন। এক সন্ন্যাসী সন্তানলাভের জন্য রাজাকে ১০০৮টি শিবলিঙ্গ তৈরি করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাই, রাজা শালমালা নদীর তলদেশে থাকা প্রতিটি পাথরকে শিবলিঙ্গে রূপান্তরিত করেছিলেন।
অন্য একটি জনশ্রুতিও রয়েছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর পাণ্ডবদের পুষ্পমৃগ খোঁজার পরামর্শ দেন কৃষ্ণ। মধ্যম পাণ্ডব ভীম তা খোঁজার জন্য মহেন্দ্রগিরি অঞ্চলে রওনা দেন। যাত্রাপথে ছদ্মবেশী পবনপুত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় ভীমের। বিশ্রামরত হনুমানকে লেজ সরানোর অনুরোধ করেন ভীম। ভীমকে সে কাজ করে নিতে বলেন মারুতি, কিন্তু ভীম হনুমানের লেজ সরাতে ব্যর্থ হন।
পরে হনুমান ভীমের যাত্রার উদ্দেশ্য জানতে পেরে তার সুরক্ষার জন্য নিজের লেজের একগোছা চুল নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন৷ ভীম মহেন্দ্রগিরি পৌঁছে পুষ্পমৃগের সন্ধান পান। তবে একটি শর্তেই পুষ্পমৃগ সঙ্গে যেতে রাজি হয়। সে জানায়, বায়ুর বেগে ভীম যেতে পারলে তবেই সে তাঁর সঙ্গে যাবে। পুষ্পমৃগের গতির সঙ্গে সমতা বজায় রাখতে ভীম হনুমানের লেজের একটি করে কেশ মাটিতে ফেলতে থাকেন।
প্রতিটি কেশ মাটিতে পড়তেই তা থেকে একটি শিবলিঙ্গ উত্থিত হতে থাকে। ফলে পুষ্পমৃগকে আরাধ্য দেবতা শিবের পুজো করে তবেই এগোতে হয়। ফলে ভীমের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে পথে পিছিয়ে পড়ে সে। উপ্পিনঙ্গাড়ির কাছে এসে ভীম প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েন। তখন তিনি সেখানে এক সহস্র চুল ঝরিয়ে দেন। ফলে সেখানে সহস্র শিবলিঙ্গ উত্থিত হয়ে যায়। পুষ্পমৃগ প্রতিটি শিবলিঙ্গের পুজো করতে শুরু করে। এতে ভীম অনেকটা সময় পেয়ে যান।
কর্নাটকের এই স্থানটি কম্বোডিয়ার ক্বাল স্পেন বা হেড ব্রিজের সঙ্গে প্রচুর সাদৃশ্যপূর্ণ। উভয় স্থানেই নদীর ভিতরে প্রায় এক হাজার জটিল গঠনশৈলীর শিবলিঙ্গ রয়েছে। কম্বোডিয়ার এই স্থানটি পরিদর্শন করা কঠিন। সে দেশে ওই স্থানকে পবিত্র বলে মনে করা হয় না।
সিরসিতে সহস্রলিঙ্গ মূর্তি ছাড়াও একটি মন্দির রয়েছে। এ ছাড়াও শিবের বাহন নন্দীর ভাস্কর্যটি এখানে সবচেয়ে বড়। প্রায় ৬ ফুট লম্বা, ১২ ফুট লম্বা এবং ৫ ফুট পুরু। সম্ভবত কয়েক টন ওজনের। এখানকার সমস্ত ভাস্কর্য নদীর তলদেশে অবস্থিত পাথরের উপর খোদাই করা ছিল।
স্থানীয় বিশ্বাস অনুসারে, লিঙ্গগুলি সৃজনশীল শক্তির প্রতীক। তাদের উপর দিয়ে যে জল প্রবাহিত হয় তা কাছাকাছি ধানখেতের উর্বরতা বাড়িয়ে দেয় বলে স্থানীয়দের বিশ্বাস।
সব ছবি: সংগৃহীত।