কিশোর বয়স থেকে উপার্জনের সূত্রে পড়াশোনা থেকে দূরত্ব ক্রমে বাড়ছিল। পড়াশোনা ছেড়ে খেতখামারের কাজ সামলানো, পাহারাদারের কাজ থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে দেশের জনপ্রিয় কুস্তিগিরের আসনে স্থান করেছিলেন দারা সিংহ। বলিউডেও এক সময় রমরমিয়ে অভিনয় করেছিলেন তিনি। কিন্তু এই আলোর রোশনাই দারাকে খ্যাতি দিলেও ভালবাসাটুকু কেড়ে নিয়েছিল বলে ক্ষোভ অভিনেতার।
১৯২৮ সালের নভেম্বর মাসে তৎকালীন পঞ্জাবের গুরদাসপুর জেলায় জন্ম দারার। তাঁর সম্পূর্ণ নাম দিদার সিংহ রান্ধওয়া। ভারতীয় চলচ্চিত্রজগতে ‘আয়রনম্যান’ হিসাবেও অধিক পরিচিত দারা। খেতখামারের কাজ সামলানোর জন্য দারাকে কম বয়সেই স্কুল থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁর বাবা-মা। কুস্তি শেখার প্রতি আগ্রহ জন্মেছিল দারার।
১৯৪৭ সালে কর্মসূত্রে সিঙ্গাপুরে চলে গিয়েছিলেন দারা। সেখানে গিয়ে বাজনা উৎপাদনকারী কারখানায় কাজ করতে শুরু করেছিলেন তিনি। পাহারাদারির কাজও সামলেছিলেন দারা। তবে হরনম সিংহের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর জীবন বদলে গিয়েছিল দারার। তাঁকে কুস্তির প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেছিলেন হরনম।
পাঁচ থেকে ছ’য়ের দশকে কুস্তিগির হিসাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন দারা। সেখান থেকেই বলিপা়ড়ায় অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। ১৯৫২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সংদিল’ ছবিতে দিলীপ কুমার এবং মধুবালার সঙ্গে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেছিলেন দারা। ছ’য়ের দশকে ‘অ্যাকশন হিরো’ হিসাবে জাঁকিয়ে বসেছিলেন তিনি।
বলিপাড়ায় নিজের জায়গা তৈরি করে ফেললেও দারার বিপরীতে জুটি বেঁধে অভিনয় করার জন্য কোনও নায়িকা পাচ্ছিলেন না তিনি। দারা অভিনীত প্রতিটি ছবি বক্স অফিসে দুর্দান্ত ব্যবসা করলেও বলিউডের প্রথম সারির অভিনেত্রীরা দারার সঙ্গে অভিনয় করতে রাজি হচ্ছিলেন না।
একাংশের দাবি, ‘ফওলাদ’ ছবিতে দারার বিপরীতে নায়িকা খোঁজার জন্য অডিশন চলছিল। সেই সময় শুটিং ফ্লোরে বোনকে নিয়ে ঢুকেছিলেন মুমতাজ়। তখন অবশ্য বলিপাড়ায় এত নামডাক ছিল না তাঁর। দারার বিপরীতে অভিনয় করতে চেয়েছিলেন তিনি।
মুমতাজ়কে দেখে একবাক্যে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন দারা। ‘ফওলাদ’ ছবিতে একসঙ্গে অভিনয়ও করেছিলেন তাঁরা। দুই তারকার জুটি কম সময়ের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিল।
কানাঘুষো শোনা যেতে থাকে যে, শুটিং শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও নাকি দারার সঙ্গে একান্তে সময় কাটাতেন মুমতাজ়। নায়িকার সঙ্গে হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল দারার। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দুই তারকাকে একসঙ্গেও দেখা যেতে থাকে।
বলিপাড়ায় গুঞ্জন শোনা যেতে থাকে, মুমতাজ়ের সঙ্গে নাকি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন দারা। তবে ‘ফওলাদ’ মুক্তির পর দারার চেয়েও বেশি জনপ্রিয়তা পেয়ে গিয়েছিলেন মুমতাজ়। একের পর এক হিন্দি ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব পাচ্ছিলেন নায়িকা।
মুমতাজ় সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে যত উপরে উঠতে থাকেন, দারার সঙ্গে তাঁর দূরত্বও তত বাড়তে থাকে। কাজের চাপের জন্য দারার সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ পেতেন না নায়িকা।
বড়পর্দায়ও আর দারার সঙ্গে জুটি বাঁধা হয়ে উঠত না মুমতাজ়ের। বলিপাড়ার জনশ্রুতি, মুমতাজ়ের রাতারাতি সাফল্যের কারণে দারার সঙ্গে সম্পর্কে চিড় ধরেছিল তাঁর। সম্পর্কে ভাঙনের জন্য বলিউডকে দায়ী করেছিলেন দারা।
এক পুরনো সাক্ষাৎকারে দারা বলেছিলেন, ‘‘মুমতাজ়কে আমার কাছ থেকে বলিউড ছিনিয়ে নিল।’’ বলিপাড়া সূত্রে খবর, মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল দারার। পাত্রী অবশ্য তাঁর চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন। তবে সেই সংসার সুখের ছিল না।
১৯৩৭ সালে বিয়ে করেছিলেন দারা। এমনকি, অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় বাবা হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু প্রথম বিয়ে টেকেনি তাঁর। বিয়ের দশ বছর পর ছাদ আলাদা হয়ে গিয়েছিল তাঁদের।
১৯৬১ সালে সুরজিৎ কৌর নামে এক তরুণীকে বিয়ে করেছিলেন দারা। দ্বিতীয় বিয়ে থেকে তিন পুত্র এবং তিন কন্যাসন্তানের পিতা হয়েছিলেন অভিনেতা।
অভিনয়ের পাশাপাশি পরিচালনায়ও হাতেখড়ি হয়েছিল দারার। ১৯৭০ সালে একটি ছবি পরিচালনা করেছিলেন তিনি। সেই ছবির নায়কও ছিলেন দারা নিজেই। রামানন্দ সাগরের ‘রামায়ণ’ ধারাবাহিকে হনুমানের চরিত্রে অভিনয় করে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন তিনি।
‘মেরা নাম জোকার’, ‘দিললাগি’, ‘আজুবা’ এবং ‘কাল হো না হো’র মতো একাধিক হিন্দি ছবিতে অতিথিশিল্পী হিসাবে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। ২০০৬ সালে ‘জব উই মেট’ ছবিতে শেষ অভিনয় করতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। করিনা কপূর খানের ঠাকুরদার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন দারা।
১৯৯৮ সালে বিজেপি প্রার্থী হিসাবে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন দারা। ২০০৩ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৮৩ সালে কুস্তি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ২০১২ সালে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান দারা।
সব ছবি: সংগৃহীত।