সোনার পর এ বার বিশুদ্ধ কোয়ার্টজ়। ফের দামি খনিজ সম্পদের ‘জ্যাকপট’ পেল চিন। শুধু তা-ই নয়, বৃহস্পতি তুঙ্গে হওয়ায় এ বার মার্কিন-নির্ভরশীলতা বেজিং পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। পাশাপাশি, ড্রাগনের সামনে খুলতে চলেছে সেমিকন্ডাক্টর এবং সৌরশক্তি শিল্পে একচেটিয়া বাজার দখলের সুযোগ। এই আবিষ্কার প্রযুক্তিক্ষেত্রে চিনকে যে কয়েক গুণ এগিয়ে দিল, তা বলাই বাহুল্য।
চলতি বছরের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে উচ্চ মানের বিশুদ্ধ কোয়ার্টজ়ের বিশাল ভান্ডারের হদিস মেলার কথা ঘোষণা করে বেজিঙের প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রক। এর পরই দুনিয়া জুড়ে পড়ে যায় শোরগোল। সরকারি ভাবে চিন জানিয়েছে, হেনান প্রদেশের কিনলিং এবং উইঘুর মুসলিম অধ্যুষিত স্বায়ত্তশাসিত শিনজিয়াং প্রদেশের আলতাই এলাকার মাটির গভীরে জমা রয়েছে ওই ‘কুবেরের ধন’। খুব শীঘ্রই এর উত্তোলন শুরু করবে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিঙের প্রশাসন।
চিনের প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রকের দাবি, ওই এলাকাগুলির ভূগর্ভস্থ কোয়ার্টজ়ের আনুমানিক পরিমাণ ৩ কোটি ৫০ লক্ষ মেট্রিক টন। সংশ্লিষ্ট খনিজ পদার্থটিতে মিশে আছে ন্যূনতম ৯৯.৯৯৫ শতাংশ সিলিকন ডাই-অক্সাইড। অর্থাৎ, সদ্য হদিস মেলা কোয়ার্টজ়ের গুণগত মান যে খুব ভাল, তা বলাই যায়। এগুলিকে অনায়াসেই সেমিকন্ডাক্টর-গ্রেড সিলিকন ওয়েফার, ফোটোভোলটাইক সেল এবং অত্যাধুনিক অপটিক্যাল উপাদান তৈরিতে ব্যবহার করতে পারবে বেজিং।
জিনপিং প্রশাসনের দাবি, ভূগর্ভস্থ কোয়ার্টজ়ের আনুমানিক বাজারমূল্য ১৪০ কোটি ইউরো। ভারতীয় মুদ্রায় যেটা প্রায় ১৪ হাজার ৭ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা। তবে এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। কারণ কোয়ার্টজ়ের দাম তার বিশুদ্ধতার উপরে নির্ভরশীল। বেজিঙের খনিজের মান যে ‘ভাল’ তার কোনও আন্তর্জাতিক প্রমাণ নেই। সেই কারণেই এই ইস্যুতে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তাঁরা।
আধুনিক সময়ে খনিজ পদার্থগুলির মধ্যে কোয়ার্টজ়ের গুরুত্ব অপরিসীম। মাইক্রোচিপ, সৌর প্যানেল এবং অন্যান্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সামগ্রী তৈরিতে অত্যাবশ্যক উপাদান হিসাবে ব্যবহার হয় এই যৌগ। সদ্য হদিস মেলা ভূগর্ভস্থ কোয়ার্টজ়ের গুণমান নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ওয়ার্ল্ড-এনার্জি এবং চিনের জনপ্রিয় গণমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস। তাদের দাবি, বিশুদ্ধতার বাইরে গিয়েও অর্থনীতিতে এর আলাদা গুরুত্ব রয়েছে।
আগামী দিনের ‘গেম চেঞ্জার’ হতে চলা কোয়ার্টজ়ের বেশ কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন উচ্চ তাপমাত্রা সহ্য করার ক্ষমতা রয়েছে এই যৌগের। দ্বিতীয়ত, ক্ষয়প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং অপটিক্যাল স্বচ্ছতা থাকার দরুন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সামগ্রী নির্মাণে এর বহুল ব্যবহার হচ্ছে। এত দিন পর্যন্ত মূলত আমেরিকা থেকে কোয়ার্টজ় আমদানি করত চিন। এই খাতে বেজিঙের খরচ দাঁড়িয়েছে বছরে ১৫০ কোটি ডলার। যেটার পুরোটাই এ বার সাশ্রয় করতে পারবে ড্রাগন সরকার। পাশাপাশি, ব্যাপক ভাবে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধি করার সুযোগ রয়েছে মান্দারিনভাষীদের।
কোয়ার্টজ় উত্তোলনের জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনা রাজ্যের স্প্রুস পাইন খনি বিখ্যাত। ওই এলাকায় মেলা খনিজকে সর্বাধিক বিশুদ্ধ বলে ধরা হয়। চিনে আমদানি করা কোয়ার্টজ়ের ৮০ শতাংশই ওই খনি থেকে সরবরাহ করে আমেরিকা। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এই নির্ভরশীলতার কারণেই ওয়াশিংটনকে চ্যালেঞ্জ করার ব্যাপারে অনেক সময় দ্বিতীয় বার ভাবতে হত বেজিংকে, যা এ বার পুরোপুরি দূর হতে চলেছে।
বিশ্লেষকদের দাবি, ড্রাগনভূমির কিনলিং এবং আলতায় উচ্চ মানের বিশুদ্ধ কোয়ার্টজ়ের বিপুল ভান্ডারের হদিস মেলায় সংশ্লিষ্ট খনিজটির বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খল পুরোপুরি পাল্টে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে সেমিকন্ডাক্টর এবং সৌরশক্তি শিল্পে বেজিঙের একাধিক প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছে। ভূগর্ভস্থ ‘কুবেরের ধন’ হাতে পাওয়ায় অচিরেই মান্দারিনভাষীরা তাদের সবাইকে ছাপিয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
চিনের একাধিক গবেষণা এবং শিল্প সংস্থা বাণিজ্যিক ভাবে কোয়ার্টজ় উৎপাদন করে থাকে। বিশুদ্ধতার নিরিখে সেগুলি ৪এন৫ এবং ৪এন৮ স্তরে পৌঁছোতে পেরেছে। অর্থাৎ, কৃত্রিম ভাবে তৈরি কোয়ার্টজ় সিলিকন ডাই-অক্সাইড থাকছে যথাক্রমে ৯৯.৯৯৫ এবং ৯৯.৯৯৮। খনিতে যে যৌগ পাওয়া গিয়েছে সেগুলিও সমগুণগত মানসম্পন্ন বলে মনে করা হচ্ছে। তবে প্রয়োজনে কিছু ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কোয়ার্টজ়গুলিকে পরিশোধন করতে হতে পারে।
গত বছরের ২৯ নভেম্বর বিশ্বের সর্ববৃহৎ স্বর্ণখনি আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করে জিনপিং সরকার। হলুদ ধাতুর ওই খনি হুনান প্রদেশের পিংজিয়াং কাউন্টিতে রয়েছে বলে জানা গিয়েছে। বেজিঙের গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেখান থেকে আনুমানিক হাজার টন সোনা উত্তোলন করতে পারবে প্রশাসন, যার আনুমানিক বাজারদর ৮ হাজার ৩০০ কোটি ডলার।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ স্বর্ণখনি আবিষ্কারের পর সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খোলে হুনানের ভূতাত্ত্বিক ব্যুরো। তাদের দাবি, ওই এলাকায় মাটির নীচে মাত্র দু’কিলোমিটার গভীরতায় ছড়িয়ে আছে ৪০টি স্বর্ণশিরা বা গোল্ড ভেন। শুধুমাত্র স্বর্ণশিরা থেকেই ৩০০ মেট্রিক টন সোনা পাওয়া যেতে পারে। খনিতে হলুদ ধাতুর পরিমাণ জানতে ‘থ্রিডি মডেলিং’ পদ্ধতির সাহায্য নেন তাঁরা।
সুপার কম্পিউটার পরিচালিত থ্রি ডি মডেলিং পদ্ধতিতে জানা গিয়েছে, খনির গভীরে অতিরিক্ত সোনা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর জন্য ভূগর্ভের তিন কিলোমিটার নীচে নামতে হতে পারে খনি শ্রমিকদের। একে অবশ্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছে ভূতাত্ত্বিকদের দল।
গত বছরের ডিসেম্বরে চিনা ভূতাত্ত্বিক ব্যুরোর পদস্থ কর্তা চেন রুলিন জানান, স্বর্ণখনির হদিস পেতে পাথুরে ভূপৃষ্ঠের কোর এলাকা খোদাই করতে হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘খনি থেকে তোলা প্রতি টন হলুদ ধাতু শোধন করলে ১৩৮ গ্রাম বিশুদ্ধ সোনা পাওয়া যাবে।’’
বিশেষজ্ঞদের মতে, বেজিংয়ের দাবি সত্যি হলে হুনানের স্বর্ণ আকরিককে উৎকৃষ্ট মানের বলে স্বীকৃতি দিতে হবে। আকরিক শোধন করে ৮ গ্রাম বা তার বেশি সোনা পাওয়া গেলে এই তকমা দেওয়া হয়।
নতুন স্বর্ণখনির আবিষ্কার চিনা হলুদ ধাতুর শিল্পে বড় প্রভাব ফেলবে বলে স্পষ্ট করেছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী স্বর্ণ উৎপাদনে ড্রাগনল্যান্ডের অবদান মাত্র ১০ শতাংশ। গত বছরের গোড়ায় বেজিংয়ের কাছে দু’হাজার টনের বেশি সোনা মজুত রয়েছে বলে খবর মেলে। এর উপর ভিত্তি করে বিশ্বের স্বর্ণবাজারের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছে চিন।
চিনা সরকারি সংবাদমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার জেরে সোনা-সহ অন্যান্য মূল্যবান ধাতুর চাহিদা ড্রাগনল্যান্ডে উত্তরোত্তর বাড়ছে। ফলে গত বছরের স্বর্ণখনির আবিষ্কার দেশের সম্পদের নিরাপত্তারক্ষায় তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে বলে দাবি করেছে হুনান ভূতাত্ত্বিক ব্যুরো।
গত কয়েক বছর ধরেই আর্থিক ভাবে নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে চিন। ডলারের নিরিখে বেশ দুর্বল হয়েছে চিনা মুদ্রা ইউয়ানের দর। নেমেছে জিডিপির সূচক। এই পরিস্থিতিতে নতুন স্বর্ণখনির আবিষ্কারকে চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের কাছে ‘দেবতার আশীর্বাদ’ বলেই উল্লেখ করেছেন দুনিয়ার তাবড় আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
সোনার পাশাপাশি খনিজ তেল-সহ দামি ধাতুর খোঁজ পেতে গত দু’বছরে কোটি কোটি ডলার খরচ করেছে বেজিং। ২০২২ সালে খনিজ সম্পদের সন্ধান পেতে ১.১ লক্ষ কোটি ইউয়ান ব্যয় করে জিনপিং প্রশাসন। ভারতীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ ছিল ১.২৭ লক্ষ কোটি টাকা। ধাতু শিল্পে বিদেশি নির্ভরতা কমাতে ওই সিদ্ধান্ত নেয় ড্রাগন সরকার।
স্বর্ণখনির পর কোয়ার্টজ় ভান্ডারের হদিস মেলায় স্বভাবতই উচ্ছ্বসিত জিনপিং প্রশাসন। আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, এর জেরে আগামী দিনে বেজিঙে বাড়বে বিদেশি লগ্নি। তবে কোয়ার্টজ়ের খোঁজ এখনই বন্ধ করছে না ড্রাগন সরকার। এই খনিজের আরও কোনও ভান্ডার মাটির গভীরে লুকিয়ে আছে কি না, তা জানতে দেশব্যাপী একটি সমীক্ষা শুরু করেছে সেখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রক।
সব ছবি: সংগৃহীত।