মার্কিন প্রেসিডেন্টের গুমরে হাতুড়ির ঘা! ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ককাঁটা উপড়ে ফেলে দুরন্ত বেগে ছুটছে চিন। চলতি বছরে এখনও পর্যন্ত বেজিঙের রফতানি বাণিজ্যে উদ্বৃত্তের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে এক লক্ষ কোটি ডলার। এককথায় ‘পোটাস’-এর (প্রেসিডেন্ট অফ দ্য ইউনাইটেড স্টেটস) শুল্কবাণ ড্রাগনের আর্থিক বৃদ্ধির গতি কমানো তো দূরে থাক, তাতে সামান্য ধাক্কাও দিতে পারেনি। কী ভাবে সব বেড়া টপকে এই অসাধ্যসাধন করল চিন? তারই চুলচেরা বিশ্লেষণে মেতেছে বিশ্ব।
চিনা পণ্যে চড়া হারে শুল্ক চাপানোর নেপথ্যে ট্রাম্পের যুক্তি ছিল বাণিজ্যিক ঘাটতি। ওয়াশিংটন-বেজিং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের সেই ব্যবধান কমাতে শুল্ক-অস্ত্র ব্যবহার করেন তিনি। এতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রাতারাতি দামি হয়ে যায় ড্রাগনের সামগ্রী। ফলে সেখানে রফতানি করা মান্দারিনভাষীদের কাছে আগের মতো লাভজনক থাকেনি। এই পরিস্থিতিতে দ্রুত রণকৌশল বদলে ফেলে আমেরিকার থেকে মুখ ফিরিয়ে বিশ্বের অন্য দেশগুলির বাজার ধরতে কোমর বেঁধে লেগে পড়ে চিন। আর তাতেই এসেছে সাফল্য।
গত এপ্রিলে ‘পারস্পরিক শুল্কনীতি’ চালু করেন ট্রাম্প। এর পরই চিনের সঙ্গে শুল্ক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে আমেরিকা। দু’পক্ষই একে অপরের পণ্যে নিলাম ডাকার মতো করে বাড়াতে থাকে করের মাত্রা। বিশেষজ্ঞদের দাবি, এই বাণিজ্যিক লড়াই চলাকালীন ‘দ্বিতীয় ফ্রন্ট’ খোলে বেজিং। তাদের পণ্যের পরবর্তী বাজার হিসাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন (দক্ষিণ) আমেরিকার দেশগুলিকে পাখির চোখ করে ড্রাগন। ফলে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে মান্দারিনভাষীদের রফতানির সূচক।
সূত্রের খবর, গত কয়েক মাসে ইন্দোনেশিয়া, তাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ার মতো দেশে রফতানির পরিমাণ কয়েক গুণ বাড়িয়েছে চিন। ট্রাম্পের শুল্কনীতিতে বিরক্ত এবং ক্ষতিগ্রস্ত ভারতও বাধ্য হয়ে বেজিঙের সামনে আরও কিছুটা খুলেছে তার ঘরোয়া বাজার। এ ছাড়া আফ্রিকা থেকে মোটা অর্থ রোজগার করেছে ড্রাগন। ইউরোপে ধীরে ধীরে পা জমাচ্ছে চিনা বৈদ্যুতিন গাড়ি। সেখানকার বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের ভোক্তা বাজার দখলের চেষ্টাও চালাচ্ছেন মান্দারিনভাষীরা।
বিশেষজ্ঞদের একাংশ এ-হেন রফতানি উদ্বৃত্তকে ‘সেকেন্ড চাইনিজ় শক’ বা দ্বিতীয় চিনা ধাক্কার সূচনা বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের দাবি, শিল্পবিপ্লবের পর ইংল্যান্ডের কারখানায় তৈরি সামগ্রী নিয়ে যেমন ইউরোপ তথা সারা বিশ্বে কাড়াকাড়ি পড়ে গিয়েছিল, সেই একই দৃশ্য বেজিঙের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে। অন্য দিকে ‘লেস ইকোস’ নামের একটি সংবাদসংস্থাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই ইস্যুতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ। ড্রাগনের বাণিজ্য উদ্বৃত্তকে ‘অসহনীয়’ বলে তোপ দেগেছেন তিনি।
ট্রাম্পের শুল্কবাণ সত্ত্বেও চিনা রফতানি বাণিজ্যের সাফল্যের নেপথ্যে একাধিক কারণ খুঁজে পেয়েছে ওয়াশিংটন। আমেরিকার শাসক, বিরোধী দু’পক্ষই স্বীকার করেছে যে অনেক কম খরচে বিপুল পণ্য উৎপাদন করছে বেজিং। ফলে বিদেশের বাজারে সস্তায় সেগুলিকে বিক্রি করার তাসটা সব সময়েই থাকছে ড্রাগনের হাতে। ১৯৭০-এর দশকের পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী আধিপত্য অর্জন করেন মান্দারিনভাষীরা, যা আজও অটুট রয়েছে।
১৯৭০ সালে চিনের বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য এবং মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) অনুপাত ছিল প্রায় ২৫ শতাংশ। ২০২২ সালের মধ্যে তা বেড়ে ৬০ শতাংশে পৌঁছে যায়। বেজিঙের সস্তা পণ্যের চাহিদা যে আন্তর্জাতিক বাজারে উত্তরোত্তর বেড়েছে, এই তথ্যেই তা স্পষ্ট। কিন্তু সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়েনি অভ্যন্তরীণ চাহিদা। ফলে বিদেশ থেকে বিপুল আমদানি করতে হচ্ছে না ড্রাগনকে। তাদের বাণিজ্যিক উদ্বৃত্তের এটা একটা বড় কারণ, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
এ ছাড়া মুদ্রাস্ফীতির জেরে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে জিনিসের দাম বৃদ্ধি চিনের রফতানি বাড়ানোর ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে। বেজিঙের লক্ষ্মীলাভের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে রোডিয়াম গ্রুপের গবেষণা এবং নোয়া স্মিথের লেখা ‘উৎপাদন এখন একটি যুদ্ধ’ শীর্ষক প্রবন্ধে। সেখানে বলা হয়েছে, শিল্পবিপ্লব পরবর্তী ব্রিটেনকে বাদ দিলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি যেমন দুরন্ত বেগে ছুটছিল, বর্তমানে সেই গতি ড্রাগনের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে।
তৃতীয় কারণ হিসাবে বিশেষজ্ঞদের একাংশ চিনা মূদ্রা ইউয়ানের অবমূল্যায়নকে দায়ী করেছেন। তাদের অভিযোগ, ইচ্ছাকৃত ভাবে ডলারের নিরিখে নিজেদের মুদ্রার দাম কমিয়ে রেখেছে বেজিং। ফলে অনেক কম ডলার খরচ করে বেশি পরিমাণে ড্রাগনভূমির সামগ্রী কিনে নিতে পারছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিল্পপতি থেকে আমজনতা। এর জেরেও রফতানির সূচক বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিঙের সরকার।
গত ১০ ডিসেম্বর বার্ষিক পর্যালোচনা সভা শেষে চিনা ইউয়ানের অবমূল্যায়ন নিয়ে সতর্কতামূলক বিবৃতি দেয় ‘আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার’ বা আইএমএফ (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড)। সেখানে বলা হয়েছে, ‘‘ইউয়ানের মূল্য ইচ্ছাকৃত ভাবে কমিয়ে রাখার কারণে মুদ্রাস্ফীতির সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বেজিঙের এ দিকে নজর দেওয়া উচিত।’’ তা ছাড়া ড্রাগন সরকারকে আমদানি বৃদ্ধি এবং ভোক্তা পণ্যের দাম বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ।
মার্কিন সংস্থা ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ়’-এর (সিএসআইএস) ব্রায়ান হার্ট, হিউ গ্রান্ট-চ্যাপম্যান এবং লিওন লি জানিয়েছেন, ঘরোয়া চাহিদা কম হওয়ায় দশকের পর দশক ধরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কেবলমাত্র রফতানিমুখী নীতি নিতে পেরেছে চিন। প্রতিটি পণ্যে বিদেশি প্রতিযোগীদের কী ভাবে হারানো যায়, সে দিকে নজর ছিল বেজিঙের। এই পরিস্থিতিতে ট্রাম্পের শুল্ক চলে আসায় সস্তায় পণ্যসামগ্রী কিনতে ইউরোপীয় দেশগুলিও ড্রাগনের উপর ধীরে ধীরে নির্ভরশীল হচ্ছে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে সিএসআইএস জানিয়েছে, গত ২০ বছরে চিনে উৎপাদিত পণ্যের নিট রফতানি ২৫ গুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতের মধ্যেও প্রেসিডেন্ট শি-র নেতৃত্বে ‘উৎপাদনকারী শক্তি’র ভাবমূর্তি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে বেজিং। জিনপিং অবশ্য বর্তমানে বৈদ্যুতিন যান, উচ্চমানের বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম এবং প্রতিরক্ষা সামগ্রী বিক্রির দিকে জোর দিয়েছেন। রফতানি বাণিজ্যকে দ্বিগুণ করার লক্ষ্য রয়েছে তাঁর।
চিনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে ভারতেরও। এতে সংশোধন আনতে তাই প্রাথমিক ভাবে ট্রাম্পের নীতির বিরোধিতা করেনি নয়াদিল্লি। যদিও পরবর্তী সময়ে শুল্কের অঙ্ক বাড়িয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ৫০ শতাংশ করে দিলে ক্ষুব্ধ হয় কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। তথ্য বলছে, চলতি আর্থিক বছরের (২০২৫-’২৬) প্রথম সাত মাসে এ দেশে বেড়েছে বেজিঙের পণ্যের আমদানি। তবে সেটা যাতে বন্যার জলের মতো ঢুকে না পড়ে, সে দিকে নজর রাখছে প্রশাসন।
কেন্দ্রের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি আর্থিক বছরের (পড়ুন ২০২৫-’২৬) প্রথম সাত মাসে চিনে ৬,৪০০ কোটি ডলারের পণ্য বিক্রি করেছে ভারত। গত বছর এই সময়সীমায় এই পরিমাণ ছিল ৫,৭৬৫ কোটি ডলার। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষে বেজিঙের সঙ্গে নয়াদিল্লির বাণিজ্যিক ঘাটতি ৯,৯১২ কোটি ডলার ছুঁয়ে ফেলে। এ বার সেই অঙ্কই ১০ হাজার কোটি ডলার ছাপিয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
২০২০-’২১ আর্থিক বছর থেকে চড়চড়িয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে ভারত-চিন বাণিজ্যিক ঘাটতি। ওই সময় থেকে শুরু করে ২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষের মধ্যে ড্রাগনভূমিতে নয়াদিল্লির পণ্য রফতানি হ্রাস পায় ৩৩ শতাংশ। উল্টো দিকে বেজিঙের আমদানি সূচককে প্রায় ৭৪ শতাংশ বাড়তে দেখা গিয়েছে। গত বছর (পড়ুন ২০২৪ সাল) উত্তর-পূর্বের প্রতিবেশী দেশটিকে ১,৪২৫ কোটি ডলারের সামগ্রী বিক্রি করে মোদী সরকার, যা সর্বকালের সর্বনিম্ন।
এ বছরের প্রথম সাত মাসে ১,০০৩ কোটি ডলারের পণ্য বেজিঙে পাঠিয়েছে নয়াদিল্লি। ড্রাগনভূমির সামগ্রী এ দেশে বহুল পরিমাণে সরবরাহ করার মূল কারণ হল বৈদ্যুতিন পণ্য, ব্যাটারি, সবুজ শক্তির সৌর প্যানেল এবং ওষুধ তৈরির কাঁচামালের অভাব। এ ব্যাপারে বিস্ফোরক তথ্য দিয়েছে ‘গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ’। তাদের দাবি, ভারতের প্রধান আটটি শিল্পক্ষেত্রের মূল পণ্য সরবরাহকারী দেশ হল চিন।
বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে মুখ খুলেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রকের এক শীর্ষ আধিকারিক। তাঁর কথায়, ‘‘সবচেয়ে বিপদের জায়গা হল, রফতানি বাড়িয়েও বাণিজ্যিক ঘাটতি কমানো যাচ্ছে না। এ বছরের এপ্রিল থেকে অগস্টের মধ্যে বেজিঙে পণ্য সরবরাহ চার শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু, ঘাটতি বেড়ে গিয়েছে ১৫ শতাংশ। ফলে কোনও লাভই হয়নি।’’ এই প্রবণতা অন্য কোনও দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নেই বলে স্পষ্ট করেছেন তিনি।
চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক ঘাটতির কারণ অবশ্য ব্যাখ্যা করেছেন ওই শীর্ষ আধিকারিক। তাঁর যুক্তি, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বেজিঙের থেকে সস্তায় কাঁচামাল কিনতে পারছেন। তাঁদের কাছে কোনও বিকল্প তুলে ধরা যাচ্ছে না। সেই কারণেই যত সময় গড়াচ্ছে ততই চওড়া হচ্ছে আমদানি-রফতানির ব্যবধান। এই পরিস্থিতির রাতারাতি বদল যে সম্ভব নয়, তা বলাই বাহুল্য।
অন্য দিকে রফতানি বাণিজ্যের অভূতপূর্ব সাফল্যের খবর আসতেই সম্পাদকীয়তে বেশ কিছু বিস্ফোরক দাবি করে চিনা রাষ্ট্রীয় সংবাদসংস্থা গ্লোবাল টাইমস। সেখানে বলা হয়েছে, ‘‘বিদেশের বাজারকে ‘ডাম্পিং গ্রাউন্ড’ হিসাবে বেজিং ব্যবহার করছে বলে মিথ্যা প্রচার চলছে। কেউ কেউ আবার আমাদের শ্রম মডেলের কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। রফতানির সাফল্য বেজিঙের উন্নয়নের মডেলকেই তুলে ধরে। শ্রম বিভাজনের ভুল ব্যাখ্যা তাই ধোপে টিকছে না।’’
চিনা শুল্ক দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম ১১ মাসে বিদেশি বিনিয়োগে আমদানি ও রফতানির পরিমাণ মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের ২৯ শতাংশ ছিল। সেটা বিশ্বব্যাপী শ্রম বিভাজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে সম্পর্কিত। আর তাই বেজিঙের রফতানি উদ্বৃত্তকে বিভিন্ন দেশের ‘পারস্পরিক সহযোগিতার’ ফল বলে উল্লেখ করেছে গ্লোবাল টাইমস।
সব ছবি: সংগৃহীত।