ঝুরঝুরে সাদা বালি আর নীলাভ সবুজ স্বচ্ছ জল। যে দিকে চোখ যায় সে দিকেই দেখা যায় অপার সমুদ্রের নীল জলের হাতছানি। প্রিয়জনের সঙ্গে নিভৃতে নির্জনে একান্তে সময় কাটানোর আদর্শ জায়গা। বালিয়াড়ি ঘেরা সমুদ্রসৈকতের লোভনীয় হাতছানি এড়াতে না পেরে লাখ লাখ মানুষ প্রতি বছর পাড়ি দেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে থাকা সমুদ্রসৈকতগুলিতে।
নিরিবিলি সমুদ্রসৈকতে মধুচন্দ্রিমা হোক কিংবা নেহাত কাজের ফাঁকে অবসরযাপন। মূলত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও মুক্ত বাতাসের জন্য পর্যটকেরা সমুদ্রসৈকতে ভিড় জমালেও পৃথিবীতে এমন কিছু সৈকত রয়েছে যেখানে নগ্নতা নিষিদ্ধ নয়। ভ্রমণপিপাসুরা নিশ্চিন্তে নগ্ন হয়ে সূর্যস্নান সারতে পারেন এখানে।
পৃথিবীবিখ্যাত এই সমস্ত সমুদ্রসৈকতে নগ্ন হয়ে ঘোরা যায় এবং সেটা আইনত বৈধ। তেমনই একটি হল ডেনি ব্লেইন পার্ক। এটি আমেরিকার সিয়াটলে অবস্থিত। এখানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পোশাক ছাড়াই অবাধে সমুদ্রসৈকতে ঘুরে বেড়াতে পারেন। এটি একটি সরকার স্বীকৃত নগ্ন সৈকত, যেখানে ভিড় জমাতেন প্রকৃতিপ্রেমী থেকে সমপ্রেমীরাও।
নিরিবিলি সমুদ্রসৈকতে পোশাকহীন হয়ে প্রকৃতির সান্নিধ্য অনুভব করার সুযোগ এ বার বন্ধ হতে চলেছে ডেনি ব্লেইন পার্কে। সমুদ্রসৈকতটি বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে স্থানীয় আদালত। কারণ উন্মুক্ত সমুদ্রের পারে চলছে যথেচ্ছ যৌনাচার।
বালিয়াড়ির মাঝে সঙ্গমসুখ খুঁজে পেতে ভিড় করছেন নারী-পুরুষেরা। সৈকত এবং বালিয়াড়ি এলাকায় যত্রতত্র যৌনমিলনে লিপ্ত হচ্ছেন পর্যটকেরা। ভূরি ভূরি অভিযোগ জমা পড়েছে প্রশাসনের কাছে। যত্রতত্র যৌনতার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে করতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। যৌনতা এবং নগ্নতার হটস্পট হয়ে উঠেছিল ডেনি ব্লেইন পার্কটি।
ডেনি ব্লেইন এলাকার বাসিন্দারা বিগত কয়েক বছর ধরে যৌন আচরণ বৃদ্ধির কথা জানিয়েছেন প্রশাসনকে। এই সমস্যা মোকাবিলায় ‘ডেনি ব্লেইন পার্ক ফর অল’ নামের একটি সংগঠন তৈরি করা হয়েছে। সেই সংগঠনটি আদালতের দ্বারস্থ হয়ে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে।
কিং কাউন্টি সুপিরিয়র আদালতের বিচারক স্যামুয়েল চুং মামলাকারীদের পক্ষে রায় দিয়ে জনপ্রিয় সমুদ্রসৈকতটি বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে সমস্যা সমাধানের জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে দু’সপ্তাহ সময় দিয়েছেন বিচারক। সম্প্রতি এই মামলার শুনানির পর চুং প্রাথমিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন বলে সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর। তিনি জানিয়েছেন, পার্কে যৌন আচরণ এবং নগ্নতা জনসাধারণের কাছে উপদ্রবের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অর্ধশতাব্দী ধরে এই পার্কে পোশাক ছাড়া ঘুরে বেড়ানোর ক্ষেত্রে কোনও কড়াকড়ি ছিল না। এলজিবিটি-কিউ-এর কাছে অত্যন্ত পছন্দের গন্তব্য এই পার্কটি। যদিও সিয়াটল ‘পার্কস অ্যান্ড রিক্রিয়েশন’-এর পক্ষ থেকে নগ্নতাকে নির্দিষ্ট ভাবে বৈধতা দেওয়া হয়নি। তা সত্ত্বেও পার্কে নগ্ন হয়ে ঘোরাফেরা করা নিয়ে অতীতে তেমন কোনও আপত্তি তোলেননি শহরের বাসিন্দারা।
গত কয়েক বছরে সেই দৃশ্যপটের আকস্মিক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। চলতি বছরের (২০২৫ সালে) মার্চ মাসে পর পর বেশ কয়েকটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার পর নড়েচড়ে বসেন আশপাশের বাসিন্দারা। পার্কে আক্রমণাত্মক যৌন আচরণ বৃদ্ধির অভিযোগ এনেছেন ‘ডেনি ব্লেইন পার্ক ফর অল’-এর সদস্যেরা।
পার্কের সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য যে দলটি চেষ্টা চালাচ্ছে তাদের পক্ষ থেকে প্রশাসন ও সিয়াটলবাসীর কাছে একটি খোলা চিঠি প্রেরণ করা হয়। সেখানে প্রকাশ্য যৌন কার্যকলাপ, অবাঞ্ছিত যৌন হয়রানিমূলক ও আক্রমণাত্মক ঘটনার উল্লেখ ছিল।
চিঠির বয়ান অনুসারে চলতি মার্চেই এক সপ্তাহের মধ্যেই চারটি প্রকাশ্যে হস্তমৈথুনের ঘটনা ঘটেছে। ক্রমাগত অনুপ্রবেশ, অশ্লীল নগ্নতা প্রদর্শন এবং প্রতিবাদ করলেই হুমকির মতো ক্রমবর্ধমান সমস্যায় জর্জরিত স্থানীয় বাসিন্দারা। দু’টি ঘটনার উল্লেখ রয়েছে চিঠিতে।
একটি হল স্থানীয় বাসিন্দা এক মহিলার সঙ্গে তর্ক করার সময় যৌন আক্রমণাত্মক মন্তব্য করেন এক পুরুষ পর্যটক। এখানেই শেষ হয়নি বিষয়টি। বাগ্যুদ্ধের সময় পোশাক খুলে ফেলেন ওই পর্যটক। দ্বিতীয়টি হল এক বাসিন্দার গাড়ির উপর বহুক্ষণ হস্তমৈথুনে লিপ্ত ছিলেন এক নগ্ন পুরুষ।
যৌন অসদাচরণ, অশ্লীল কার্যকলাপ, হস্তমৈথুন এবং জনসমক্ষে যৌন কার্যকলাপ বন্ধ করার দাবি তুলেছে সংগঠনটি। সদস্যেরা জানিয়েছেন, এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য শহরের প্রশাসনকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁরা। সমস্ত সম্ভাবনা নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পর শেষ পদক্ষেপ হিসাবে আদালতের দ্বারস্থ হন তাঁরা।
সিয়াটল শহরে নগ্নতা সাধারণত বৈধ বলেই বিবেচিত হয়। ‘ডেনি ব্লেইন পার্ক ফর অল’-এর মুখপাত্র লি কেলার বলেন, ‘‘আমাদের অন্তত আইনি হস্তক্ষেপের রাস্তা খোলা রাখা দরকার।’’ নতুন আইনটি বলবৎ করার জন্য শহরের প্রশাসন কী পরিকল্পনা করছে তা এখনও সুস্পষ্ট নয়।
সংগঠনটির দাবি, সৈকতে নগ্ন হওয়ায় ছাড় দেওয়া হোক, কিন্তু যৌনতায় নয়। প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি করে অবাধ যৌনতায় লাগাম দিক প্রশাসন, এটাই কাম্য অধিবাসীদের। অন্যান্য পর্যটকেরও বিরক্তির উদ্রেক করে এমন অবাঞ্ছিত আচরণ অবশ্যই বন্ধ করা উচিত। শৃঙ্খলা ও জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তাঁরা সুর চড়িয়েছেন।
সিয়াটলের মেয়র ব্রুস হ্যারেল অবশ্য আদালতের নির্দেশের সুরে সুর মিলিয়ে জানিয়েছেন, যা কিছু নিন্দনীয় বা অশ্লীল আচরণ, পার্কে তার কোনও স্থান নেই। এ বিষয়ে কী পদক্ষেপ করা যায় তা নিয়ে তিনি শহরের অ্যাটর্নির অফিসের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন।
আমেরিকায় বেশ কয়েকটি সৈকত রয়েছে, যেখানে নগ্ন হয়ে ঘোরা যায় এবং তা আইনত বৈধ। নগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা রয়েছে সেই সব সৈকতে। কিন্তু, সে জন্য পর্যটকদের কঠোর বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয়। নগ্ন হওয়ার ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে মানেই যে অবাধ যৌনতা, তা কিন্তু নয়।
প্রিয়জনের শরীর স্পর্শ করা কিংবা নিজের যৌনাঙ্গ স্পর্শ করা— এই ধরনের কাজ একেবারেই নিষিদ্ধ। যদি কোনও পর্যটক যৌনতায় মত্ত হন কিংবা কোনও ধরনের যৌন আচরণ করেন, তা হলে তাঁকে গ্রেফতারও করা হতে পারে।
সব ছবি: সংগৃহীত।