ঘড়িতে তখন সময় রাত ৯টা ৪৫ মিনিট। দিনটা ছিল ২০১২ সালের ১৩ জানুয়ারি, শুক্রবার। ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপ গিগলিয়োরের পাশ দিয়ে এগোচ্ছিল কোস্টা কনকর্ডিয়া নামে বিশাল এক প্রমোদতরী।
প্রমোদতরীর নাম কোস্টা কনকর্ডিয়া। মোট ৩,২০০ যাত্রী এবং ১,০২৩ জন কর্মী নিয়ে ধীরে ধীরে উত্তর ইতালির দিকে যাচ্ছিল প্রমোদতরীটি। মোট সাত দিনের যাত্রাপথে মাঝে বেশ কিছু উপকূলে দাঁড়ানোর কথা ছিল প্রমোদতরীটির।
Costa Concordia
প্রায় ১,১৪,৫০০ টন ওজন এবং ২৯০ মিটার দৈর্ঘ্য ছিল প্রমোদতরীটির। এর ক্যাপ্টেন ছিলেন ফ্রান্সেস্কো শেটিনো। তিনি ২০০৬ সালে বেশ কয়েক বার কোস্টা কনকর্ডিয়া চালিয়েছেন। তা হলে কী হবে! তাঁরই একটি ভুল সিদ্ধান্তের জেরে প্রাণ গিয়েছিল ৩২ জনের।
Costa Concordia
শেটিনোর সঙ্গে তাঁর বান্ধবী ডমনিকা সেমোর্টান ছিলেন। ডমনিকা ছিলেন একজন নর্তকী। কোস্টা কনকর্ডিয়াতেও আগে কাজ করেছেন তিনি। যদিও ওই সময় তিনি আর কাজে নিযুক্ত ছিলেন না।
শেটিনো এর আগে ইতালির মারিয়ো পালোম্বোয়ের অধস্তন হিসাবে কাজ করতেন। মারিয়ো গিগলিয়ো দ্বীপে থাকতেন তিনি। হঠাৎই শেটিনোর মনে হয় প্রমোদতরীটি নিয়ে ওই দ্বীপের কাছে যাবেন এবং মারিয়োকে দেখে হাত নাড়াবেন।
তবে মারিয়োকে যখনই খবর দেওয়া হয় প্রমোদতরী গিগলিয়ো দ্বীপে যাচ্ছে তাঁর জন্য, মারিয়ো তৎক্ষণাৎ জানিয়ে দেন যে তিনি ওই দ্বীপে নেই। তাই গিয়ে কোনও লাভ হবে না।
মারিয়োর এমন উত্তরে কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। যে পথ ধরে যাওয়ার কথা ছিল সেখানে না গিয়ে গিগলিয়ো দ্বীপের দিকে এগোতে থাকে শেটিনোর প্রমোদতরী। সে বার শেটিনো নিজের চশমাও ভুলে এসেছিলেন।
শেটিনোর সহকারীরও তেমন অভিজ্ঞতা ছিল না। অথচ শেটিনো তাঁকেই বলেছিলেন পথনির্দেশ দিতে, কারণ তিনি ভাল ভাবে দেখতে পাচ্ছিলেন না। প্রমোদতরীটি গিগলিয়ো দ্বীপের একেবারে কিনারার কাছে চলে যায়।
হঠাৎই বিকট শব্দ হয়। কিনারার কাছে থাকা পাথরের গায়ে সজোরে ধাক্কা খায় প্রমোদতরীটি। নীচের অংশে প্রায় ৭০ মিটার লম্বা অংশ জুড়ে চিড় ধরে। কিন্তু তাতেও দমেননি শেটিনো।
ওই অবস্থাতেও যেন কিছুই হয়নি এমন হাবভাব ছিল তাঁর। যাত্রীরাও প্রথমে বুঝতে পারেনি তাঁদের সঙ্গে কী হতে চলেছে! সাহায্য করতে চেয়েছিলেন গিগলিয়ো দ্বীপের নিয়ন্ত্রণকর্তারা। কিন্তু শেটিনো তাঁদেরও বুঝিয়েছিলেন যে তেমন কিছুই হয়নি।
দ্বীপ থেকে মাত্র ১০০ মিটার দূরত্ব। ধাক্কা খাওয়ার কিছু ক্ষণের মধ্যেই ইঞ্জিনঘরে জল ঢুকতে শুরু করে দিয়েছিল। প্রমোদতরীর তৃতীয় নাবিক ছিলেন আন্দ্রেয়া করোলো। ঘটনার সময় তিনি তাঁর ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন।
বিকট শব্দে ঘুম ভাঙে তাঁর, তড়িঘড়ি ইঞ্জিনের ঘরে গিয়ে দেখেন ওই ঘরের দরজা খোলাই যাচ্ছে না। উল্টে জল ঢুকছে হুহু করে। মুহূর্তের মধ্যে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে যায় প্রমোদতরীটি। অর্ধেক অংশ প্রায় ডুবে যায়। কিন্তু সেই সময়ও শেটিনো যাত্রীদের বলে যাচ্ছিলেন যে কোনও অঘটন ঘটেনি।
শেষমেশ শেটিনো বুঝতে পারেন তাঁদের সাহায্য লাগবে, না হলে কারও প্রাণ বাঁচবে না। তড়িঘড়ি খবর দেওয়া হয় উপকূলরক্ষী বাহিনীকে। প্রমোদতরীতে বিপদঘণ্টি বাজানো হয়। যাত্রীদের নির্ধারিত একটি জায়গায় থাকার জন্য বলা হয়।
এখানে আরও একটি বিষয় বলে রাখা দরকার, জরুরি সময়ে কী কী করণীয় তার প্রশিক্ষণই দেওয়া ছিল না প্রমোদতরীর যাত্রী বা কর্মীদের। এটি নিয়ম-বহির্ভূত। এর পর শেটিনো প্রমোদতরী পরিত্যাগ করার কথা ঘোষণা করেন। প্রশিক্ষণ না থাকায় ভয়ে কে কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না।
ঘটনাটি ঘটার পর প্রায় এক ঘণ্টা পেরিয়ে যায়। তত ক্ষণে ৩০ ডিগ্রি বেঁকে গিয়েছে প্রমোদতরীটি। অবশেষে প্রমোদতরী ঘুরিয়ে দ্বীপের দিকে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, তা-ও সম্ভব হচ্ছিল না। কিছু কর্মী যাত্রীদের লাইফ জ্যাকেট দেন। কিছু যাত্রী ভাবেন, সাঁতরে দ্বীপে চলে যাবেন।
সে দিন প্রমোদতরীতে দু’জন ভারতীয় কর্মী ছিলেন, কর্ণনাথ রমেশনা নামে এক মহিলা এবং রাসেল রেবেলো। কর্ণনাথ এবং রাসেল দু’জনেই পারদর্শিতার সঙ্গে যাত্রীদের লাইফ বোটে বসাচ্ছিলেন। সে সময় দুর্ঘটনায় রাসেল মারা যান।
শেটিনো সবার আগে প্রমোদতরী ছেড়ে দ্বীপে চলে গিয়েছিলেন। বেশ কিছু কর্মীও দ্বীপে চলে যান। কিছু কর্মীর সাহায্যে উদ্ধারকাজ চলছিল।
দুর্ঘটনায় ৩২ জন মারা যান। বাকিদের কোনও মতে বাঁচানো গিয়েছিল। ইতালির নৌ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের তরফে শেটিনোকে নির্দেশ দেওয়া হয় প্রমোদতরীতে ফিরে যেতে, কারণ তিনি ক্যাপ্টেন। সেই নির্দেশ অমান্য করেছিলেন শেটিনো।
এই ঘটনার পরদিন সকালে গিগলিয়ো দ্বীপ এক ভয়ানক রূপ নিয়েছিল। কোনও রকমে প্রমোদতরীকে দ্বীপের কাছে নিয়ে আসা হয়েছিল। তখনও অনেকে সেখানে আটকে। ধীরে ধীরে সকলকে উদ্ধার করা হয়।
অনেকেই বলেন, বান্ধবীর জন্য কাজে মনোযোগ দিতে পারেননি শেটিনো। পাশাপাশি, চশমা না নিয়ে আসার মতো ভুল কী ভাবে করতে পারেন— এমন প্রশ্নও উঠেছিল।
শেটিনোকে পরে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি সম্পূর্ণ দোষ অন্য এক নাবিক রবার্টো বোসিয়োর উপর দায় চাপিয়ে দেন। শেটিয়ো আদালতে জানান, পা পিছলে গিয়ে লাইফ বোটের উপর পড়ে গিয়েছিলেন, তাই প্রমোদতরী ছেড়ে দ্বীপে চলে যান।
তবে শেটিনোর একটা যুক্তিও খাটেনি। আদালত শেটিনোর কোনও কথাই বিশ্বাস করেনি। বর্তমানে শেটিনো জেলে রয়েছেন। তাঁর একটা ভুলের জন্য কোস্টা কনকর্ডিয়ার দু’হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছিল।
সব ছবি: সংগৃহীত।