১৮ বছরে পা দিলেই সেনাবাহিনীতে চাকরি! আছে মোটা মাইনে এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। যুব সমাজের কর্মসংস্থানে সরকারের এ-হেন ঘোষণায় আট থেকে ৮০ সকলেরই আনন্দে ভেসে যাওয়ার কথা। কিন্তু, বাস্তবে দেখা গেল ঠিক তার উল্টো চিত্র! সৈনিকের বাধ্যতামূলক জীবনের বিরোধিতা করে রাস্তায় নেমেছেন হাজারে হাজারে যুবক-যুবতী। তাঁদের মুখে একটাই স্লোগান, ‘‘কামানের গোলা হতে আমরা রাজি নই।’’ এ-হেন গণবিক্ষোভের মুখে পড়ে অস্বস্তিতে প্রশাসন।
সম্প্রতি বাধ্যতামূলক সামরিক পরিষেবা আইনকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়েছে জার্মানি। এর প্রতিবাদে চলতি বছরের ৫ ডিসেম্বর দেশের ৯০টি শহরে ধর্মঘট পালন করে সেখানকার জেন জ়ি। সেই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে ছিলেন উচ্চ বিদ্যালয়ের ৫৫ হাজার শিক্ষার্থী। কয়েক সপ্তাহ ধরে সংশ্লিষ্ট গণবিক্ষোভকে সংঘটিত করেন তাঁরা। পড়ুয়াদের আন্দোলনের সমর্থনে শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং অভিভাবকদের একাংশকেও রাস্তায় নামতে দেখা গিয়েছে। তবে কোনও আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
কী আছে বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা জার্মানির এই বাধ্যতামূলক সামরিক আইনে? সেখানে বলা হয়েছে, ১৮ বছর বয়সি সমস্ত তরুণকে বাধ্যতামূলক ভাবে সেনাবাহিনীতে চাকরি করতে হবে। চাকরির সর্বনিম্ন মেয়াদ হবে ছ’মাস। তবে প্রয়োজনে সেই মেয়াদ এক বছর বা তার বেশি বৃদ্ধি করতে পারে সরকার। আপাতত এই নিয়ম পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে আগামী দিনে মহিলাদেরও ফৌজে পরিষেবা দিতে হতে পারে। জার্মান পার্লামেন্টে এ-হেন আইন পাশ হতেই দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে বিক্ষোভ।
বাধ্যতামূলক সামরিক পরিষেবার মতো ‘কালা কানুন’ পাশ করার ক্ষেত্রে জার্মান চ্যান্সেলার ফ্রিডরিখ মের্ৎজ় সরকারের অবশ্য সুনির্দিষ্ট কিছু যুক্তি রয়েছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়া ইস্তক সম্ভাব্য রুশ আক্রমণের আতঙ্কে ভুগছে ইউরোপের এই দেশ। গত পৌনে চার বছর ধরে চলা লড়াইয়ের তীব্রতা দেখে সেই ভয় কমা তো দূরে থাক উল্টে আরও বেড়েছে। বার্লিনের গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৮ বা ২০২৯ সাল নাগাদ তাদের নিশানা করবে মস্কো।
এই পরিস্থিতিতে ‘গোদের উপর বিষফোড়া’র মতো তুঙ্গে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের নেটো-ত্যাগের আশঙ্কা। আমেরিকার যুদ্ধ সদর দফতর পেন্টাগনের বেশ কয়েকটি সূত্রকে উদ্ধৃত করে তা প্রকাশ করেছে সংবাদসংস্থা রয়টার্স। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৭ সাল নাগাদ নিজের তৈরি করা ইউরোপীয় সামরিক জোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’ বা নেটো (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) ভেঙে বেরিয়ে যাবে ওয়াশিংটন। ইতিমধ্যেই এর প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
গত শতাব্দীতে ‘ঠান্ডা লড়াই’-এর সময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) থেকে পশ্চিমি দেশগুলিকে রক্ষা করতে জন্ম হয় নেটোর। বর্তমানে এর সদস্যসংখ্যা ৩২। তবে ফৌজিশক্তির নিরিখে আমেরিকাকে সংশ্লিষ্ট সামরিক জোটের ‘প্রাণভোমরা’ বলা যেতে পারে। ৭৮ বছর পর সেই সমঝোতা ভেঙে গেলে শক্তির ভারসাম্য যে বদলে যাবে, তা ভালই জানে জার্মানি। আর তাই দ্রুত সৈন্যবাহিনীকে মজবুত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন চ্যান্সেলার মের্ৎজ়।
তার পরেও বাধ্যতামূলক সামরিক পরিষেবার মতো সংবেদনশীল আইন তৈরি করা বার্লিনের জন্য মোটেই সহজ ছিল না। জার্মানির পার্লামেন্টের দু’টি অংশ রয়েছে। নিম্নকক্ষের নাম ‘বুন্দেসটাক’, যা মূলত আইনপ্রণয়নকারী সংস্থা। এটি আবার ‘ফেডারেল ডায়েট’ নামেও পরিচিত। সংশ্লিষ্ট আইনটি পাশ হওয়ার আগে সেখানে কয়েক সপ্তাহ ধরে চলে আলোচনা। শেষে ৩২৩-২৭২ ভোটে পাশ হয় বিল। সূত্রের খবর, সংশ্লিষ্ট আইনের অনুমোদন দিয়েছে পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ তথা ‘বুন্দেসরাট’ বা ‘ফেডারেল কাউন্সিল’।
বাধ্যতামূলক সামরিক পরিষেবা আইন চালু হওয়ার পর গণমাধ্যমে বিবৃতি দেন জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী বরিস পিস্টোরিয়াস। তিনি জানিয়েছেন, এর উদ্দেশ্য হল স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগের মাধ্যমে ‘বুন্দেসওয়ের’-এর (জার্মান সেনাবাহিনীর নাম) সৈন্যসংখ্যাকে ৪ লাখ ৬০ হাজারে নিয়ে যাওয়া। প্রথমে ২০৩০ সালের মধ্যে ২ লাখ ৬০ হাজারের একটি বাহিনী তৈরি করবে বার্লিন। পরবর্তী সময়ে আরও দু’লক্ষ সৈনিকের একটি রিজ়ার্ভ দল তৈরি করবে সরকার।
বর্তমানে পুরুষ-মহিলা এবং অফিসার-জওয়ান মিলিয়ে ‘বুন্দেসওয়ের’-এ রয়েছে মাত্র ১ লক্ষ ৮২ হাজার সৈনিক। এঁদের একাংশের আবার বেশ বয়স হয়েছে। অবসরের দিন গুনছেন তাঁরা। এই পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য রুশ আক্রমণ রুখে দিতে শক্তিশালী বাহিনীর প্রয়োজনীয়তার কথা বার বার বলেছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিস্টোরিয়াস। তাঁর কথায়, ‘‘বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য ২০২৭ সালের জুলাই থেকে দেশ জুড়ে শুরু হবে মেডিক্যাল ক্যাম্প। সেখানে ফিটনেস পরীক্ষা করে বাহিনীতে ভর্তি নেওয়া হবে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের।
জার্মানির নতুন আইন অনুযায়ী, ২০০৬ সালে জন্ম হওয়া প্রত্যেক নাগরিক ১৮ বছরে পা দিলেই হাতে পাবেন একটি বিশেষ ফর্ম। সেটা পূরণ করে মেডিক্যাল ক্যাম্পে চলে যেতে হবে তাঁদের। বর্তমানে যাঁদের ২০-৩০ মধ্যে বয়স, তাঁদের সৈন্যবাহিনীতে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হবে ২০২৭ সাল থেকে। ফৌজের স্বেচ্ছাসেবী পরিষেবার বেতনকাঠামোও ঘোষণা করেছে চ্যান্সেলার মের্ৎজ়ের সরকার।
প্রতিরক্ষা দফতরের জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, তরুণ সৈনিকেরা প্রথম দিকে প্রতি মাসে পাবেন ২,৪০০-২,৬০০ ইউরো। প্রশিক্ষণের সময়ে অন্তত হাজার ইউরো করে দেওয়া হবে তাঁদের। এ ছাড়া বাহিনীর অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও নিতে পারবেন তাঁরা। এ ছাড়াও পাবেন নিখরচার গণপরিবহণ এবং বিনামূল্যের ড্রাইভিং লাইসেন্স। ১৮ বছর বয়সিদের ক্ষেত্রে এর আবেদন বর্তমানে নিষিদ্ধ। এটি পেতে গেলে ফি বাবদ সরকারি কোষাগারে জমা করতে হয় চার হাজার ইউরো।
নতুন আইনে বিবাহিত সৈনিকদের আরও কিছু সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। যেমন তাঁদের স্ত্রীদের দেওয়া হবে সন্তান পালনের জন্য সরকারি ভর্তুকি। নিয়োগ কেবলমাত্র স্থলবাহিনীতেই হবে কি না তা স্পষ্ট নয়। জার্মান নৌসেনা এবং বিমানবাহিনীতেও সৈনিকের অভাব রয়েছে। ১৯৯১ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ কমাতে শুরু করে বার্লিন। শুধু তা-ই নয়, ধীরে ধীরে ফৌজের সংখ্যা পাঁচ লক্ষে নামিয়ে এনেছিল তারা।
একসময় নেটো-ভুক্ত এই ইউরোপীয় দেশে চালু ছিল বাধ্যতামূলক সামরিক আইন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-’৪৫) সময় তা আরও কঠোর করে জার্মান ফ্যুয়েরার আডল্ফ হিটলারের নাজ়ি পার্টি। ২০১১ সালে সাবেক চ্যান্সেলার আঙ্গেলা মেরকেল পার্লামেন্টে আইন পাশ করে বাধ্যতামূলক সামরিক আইন প্রত্যাহার করে নেন। ১৪ বছরের মধ্যেই তা ফেরত আনলেন তাঁর উত্তরসূরি মের্ৎজ়।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে বাহিনীতে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দিতে এ বছরের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বিস্ফোরক মন্তব্য করে বসেন জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী বরিস পিস্টোরিয়াস। তিনি জানিয়েছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ২০৩১ সাল পর্যন্ত সরকারি পেনশন নীতিতে কোনও বদল হচ্ছে না। ফলে স্বেচ্ছাসেবক সৈনিকেরা সেখান থেকেও আর্থিক সুবিধা পাবেন।
জার্মান প্রতিরক্ষা মন্ত্রক অবশ্য বাহিনীতে ভর্তি হওয়া স্বেচ্ছাসেবী তরুণদের প্রশিক্ষণ কত দিন ধরে চলবে, তা স্পষ্ট করেনি। তবে পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেটা সর্বোচ্চ ১০ মাস হতে পারে। এ প্রসঙ্গে পিস্টোরিয়াস বলেছেন, ‘‘যাঁরা কঠিন সময়ে সরকারের পাশে দাঁড়াতে চাইছেন না, তাঁরা দেশদ্রোহী। কারণ, যুবসমাজের সমস্যা হবে, এমন কিছুই বাধ্যতামূলক সামরিক পরিষেবা আইনে রাখা হয়নি।’’ তাঁর এই মন্তব্যের জেরে গণবিক্ষোভ আরও তীব্র হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ওই মন্তব্যের প্রতিবাদে গত ৫ ডিসেম্বর বার্লিন, ফ্রাঙ্কফুট বা হামবুর্গের রাস্তায় হাজার হাজার শিক্ষার্থী প্ল্যাকার্ড হাতে মিছিল করেন। তাঁদের যুক্তি, কেউ যদি দেশের জন্য মৃত্যুবরণ করতে না চান, তা হলে তাঁকে কাপুরুষ বলা যাবে না। যুদ্ধ কোনও সমস্যার সমাধান নয়। রাজনৈতিক ভাবে ‘আগ্রাসী’ রাশিয়ার মোকাবিলা করুক সরকার।
ইউরোপের রাজনীতিতে রুশ-জার্মান শত্রুতার লম্বা ইতিহাস রয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-’১৮) চলাকালীন ট্যানেনবার্গের লড়াইয়ে মস্কোকে পর্যুদস্ত করে বার্লিন। যদিও জার্মান বাহিনীর আগ্রাসন ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হয় ক্রেমলিন। তত দিনে অবশ্য দু’পক্ষেরই বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। আর তাই বার্লিনের সঙ্গে সন্ধি করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বাহিনী সরিয়ে নেয় রাশিয়া।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-’৪৫) সময় ছবিটা ছিল আরও জটিল। লড়াই শুরু হওয়ার আগে মস্কোর সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তি করেন জার্মান ফ্যুয়েরার হিটলার। কিন্তু ফ্রান্স দখলের পর সেই সমঝোতা ভেঙে রাশিয়া আক্রমণের নির্দেশ দেন তিনি। ফলে ১৯৪১ সালের ২২ জুন ক্রেমলিনের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে নামে তাঁর নাজ়ি বাহিনী, যার পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন বারবারোসা’।
কিংবদন্তি ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্টের রাশিয়া অভিযানের ১২৯ বছর পর একই দিনে মস্কোর লালফৌজের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হিটলারের নাজ়ি বাহিনী। লড়াইয়ের গোড়ার দিকে অভূতপূর্ব সাফল্য পায় তারা। যুদ্ধের প্রথম দিনেই হাজারের বেশি সোভিয়েত যুদ্ধবিমান ধ্বংস করে জার্মান বায়ুসেনা। পূর্ব রণাঙ্গনে ৩০ লক্ষ সৈনিক এবং ছ’লক্ষ মোটরযান পাঠিয়েছিল বার্লিন। কিন্তু মরণপণ লড়াই করে শেষ পর্যন্ত জয় ছিনিয়ে নেয় ক্রেমলিনের লালফৌজ।
‘অপারেশন বারবারোসা’ ব্যর্থ হতেই পতন হয় হিটলারের। ওই সময় বার্লিনে ঢুকে পড়ে ক্রেমলিনের ফৌজ। সেই স্মৃতি এখনও ভোলেননি জার্মানেরা। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, প্রথম জীবনে মস্কোর গুপ্তচরবাহিনী কেজিবির এজেন্ট হিসাবে পূর্ব জার্মানিতে মোতায়েন ছিলেন বর্তমান রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফলে তাঁর আগ্রাসন ঠেকানো যে বার্লিনের পক্ষে মোটেই সহজ নয়, মানছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরাও।
সব ছবি: রয়টার্স ও সংগৃহীত।