‘ইন্ডিয়া আউট’ নীতিতে ভর করে ক্ষমতায় এসেছিলেন। ক্ষমতায় এসেই চিন সফরে গিয়েছিলেন। প্রকাশ্যে এসেছিল তাঁর ‘ভারত-বৈরিতা’। মলদ্বীপের বিতর্কিত সেই প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুইজ্জুই শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে গেলেন সে দেশের প্রতিরক্ষা দফতরের নতুন সদর দফতরের উদ্বোধনে।
এ বার দ্বীপরাষ্ট্রের ৬০তম স্বাধীনতা দিবসে ‘গেস্ট অফ অনার’ বা প্রধান অতিথি হিসাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল মোদীকে। আমন্ত্রণ স্বীকার করে শুক্রবারই মলদ্বীপ পৌঁছেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
মলদ্বীপের রাজধানী মালেতে গিয়ে শুক্রবার প্রেসিডেন্ট মুইজ্জুর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার নানা বিষয় নিয়ে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। প্রতিরক্ষা সহযোগিতার প্রতীক হিসেবে মলদ্বীপ সেনার হাতে ৭২টি সামরিক যান এবং কিছু প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তুলে দেন মোদী। মুইজ্জুর প্রতিরক্ষা দফতরের নতুন ভবনকে চিহ্নিত করে বলেন, ‘‘এটি শক্তিশালী অংশীদারি এবং অটল বিশ্বাসের কংক্রিট দিয়ে নির্মিত।’’
শুক্রবার মলদ্বীপে প্রধানমন্ত্রী মোদীর গলায় শোনা গিয়েছে নয়াদিল্লি-মালে সামরিক সমঝোতা দৃঢ় করার অঙ্গীকারও। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘মলদ্বীপের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা উন্নয়নে সহায়তা অব্যাহত রাখবে ভারত। আমাদের দুই দেশের অভিন্ন লক্ষ্য, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধি অব্যাহত রাখা।’’
দুই রাষ্ট্রনেতার শুক্রবারের বৈঠকে একাধিক বিষয়ে আলোচনা হয়। তবে বিদেশ মন্ত্রকের একটি সূত্র জানিয়েছে, সেই আলোচনার অন্যতম বিষয় ছিল ভারতের তরফে মলদ্বীপকে সাড়ে ৫৬ কোটি ডলার (প্রায় ৪৮৫০ কোটি টাকা) ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব। ভারতের থেকে নেওয়া মলদ্বীপের বার্ষিক ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতাও হ্রাস করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সেই সূত্র।
এ ছাড়া মোদী-মুইজ্জু বৈঠকে ভারত-মলদ্বীপ ‘মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি’ এবং সমুদ্র গবেষণার মতো বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়েছে। দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৬০তম বার্ষিকীতে যৌথ ভাবে স্মারক ডাকটিকিটও প্রকাশ করেছেন দুই রাষ্ট্রনেতা।
পাশাপাশি, মলদ্বীপ সফরে গিয়ে শুক্রবার ভারতের ক্রেতা ঋণ সুবিধার আওতায় হুলহুমালে ৩,৩০০টি সামাজিক আবাসন ইউনিট হস্তান্তর এবং আদ্দু শহরে সড়ক ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা প্রকল্পের উদ্বোধনও করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী।
তবে মুইজ্জু সরকার হঠাৎ করে ভারতের বিষয়ে সুর নরম করলেও দু’বছর আগে পর্যন্ত পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। মুইজ্জু সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারত এবং মলদ্বীপ— দু’দেশের কূটনৈতির সম্পর্কও তলানিতে ঠেকেছিল।
কিন্তু কেন হঠাৎ করে ভারতকে নিয়ে কট্টর মনোভাব সরিয়ে সুর নরম করলেন মুইজ্জু? কেন ‘ভারত-বৈরিতা’ থেকে সরে এসে ‘ভারত-মুখী’ হলেন? মনে করা হচ্ছে চিন এবং উপসাগরীয় দেশগুলির সঙ্গে বিকল্প অংশীদারির প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার কারণেই আবার ভারতের মুখাপেক্ষী মলদ্বীপ।
ভারত এবং মলদ্বীপের মধ্যে সম্পর্কের অবনতির সূত্রপাত মুইজ্জু ক্ষমতায় আসার পর। ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে ‘ইন্ডিয়া আউট’ নীতির উপর ভর করে ক্ষমতায় এসেছিলেন চিনপন্থী হিসাবে পরিচিত মুইজ্জু। মলদ্বীপে নির্বাচনের আগে ভারতের বিরুদ্ধে ঢালাও প্রচারও করেছিলেন।
ক্ষমতায় আসার পর মলদ্বীপের রাষ্ট্রনেতারা সাধারণত প্রথম বিদেশ সফর হিসাবে ভারতকে বেছে নেন। কিন্তু মুইজ্জু তা করেননি। চিন সফরে গিয়েছিলেন তিনি। চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি করেন। পরিকাঠামো এবং পরিবেশ সংক্রান্ত একাধিক চুক্তিও স্বাক্ষর করেন। বেজিঙের থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ঋণ হিসাবে পেয়েছিল মলদ্বীপ।
বিষয়টি নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি। মলদ্বীপের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কেরও অবনতি হতে শুরু করে। এর মধ্যেই মুইজ্জুর মন্ত্রিসভার তিন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী মোদীর লক্ষদ্বীপ সফরের ছবি নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্যের অভিযোগ ওঠে। মোদীর লক্ষদ্বীপ সফরকে কেন্দ্র করে মলদ্বীপের প্রাক্তন ওই মন্ত্রীদের মন্তব্যে বিতর্ক দানা বেঁধেছিল।
সঙ্গে সঙ্গে ঝড় বয়ে যায় ভারত জুড়ে। ভারতে ‘মলদ্বীপ বয়কট’-এর ডাক ওঠে। মলদ্বীপের শয়ে শয়ে টিকিট বাতিল করে দেন ভারতের পর্যটকেরা। ধাক্কা খায় পর্যটননির্ভর দেশ মলদ্বীপ।
ভারত থেকে প্রতি বছর বহু মানুষ সেখানে ঘুরতে যান, যার উপর দেশটির অর্থনীতি অনেকটাই নির্ভর করে। ভারতে ‘বয়কট মলদ্বীপ’ রব উঠলে ক্ষতির মুখে পড়ে মলদ্বীপের অর্থনীতি। যেখানে ২০২৩ সালে মলদ্বীপে ঘুরতে যাওয়া ভারতীয়ের সংখ্যা দু’লাখের কাছাকাছি ছিল, ২০২৪ সালে তা কমে হয়ে যায় মাত্র ৪০ হাজার।
তবে তাতেও দমেননি মুইজ্জু। এত কাণ্ডের মাঝেই মলদ্বীপ থেকে ভারতকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। এর পরে নয়াদিল্লি-মালে টানাপড়েন নতুন মাত্রা পেয়েছিল। এই নিয়ে পর পর ঘটনাক্রমে দুই দেশের সম্পর্কে তিক্ততাও বাড়ছিল।
২০২২-’২৩ এবং ২০২৩-’২৪-এর বাজেটে মলদ্বীপের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছিল ভারত। ২০২৩-’২৪ সালে মলদ্বীপের জন্য বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৭৭০ কোটি টাকা। তবে ২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষের বাজেটে দেখা যায় বরাদ্দ কমিয়ে ৪০০ কোটি করা হয়।
এর মধ্যেই আন্তর্জাতিক স্তরে মলদ্বীপের উপর পাহাড়প্রমাণ ঋণের বোঝা চাপে। চিনের সঙ্গে মলদ্বীপের দহরম-মহরম শুরুর পর সে দিকে নজর পড়েছিল সারা বিশ্বের। আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার (আইএমএফ) সাবধান করে, চিনের ঋণের জালে জড়িয়ে পড়তে পারে মলদ্বীপ। কারণ চিনের থেকে দু’হাতে ঋণ নিলেও তা ফেরত দেওয়ার ক্ষমতা নেই মলদ্বীপের।
গত দু’বছরে মলদ্বীপের আর্থিক পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হয়েছে। বেজিংয়ের তরফে প্রত্যাশিত সহায়তা না পাওয়ারও অভিযোগ উঠেছে ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রের অন্দরে। বার বার অনুরোধ সত্ত্বেও নাকি মলদ্বীপকে নতুন করে সাহায্যদানে খুব বেশি উৎসাহ দেখায়নি বেজিং। সৌদি আরব এবং অন্যান্য পশ্চিম এশীয় দেশও মুখ ফিরিয়েছিল মলদ্বীপের থেকে। এর পর সে দেশের অন্দরেও প্রশ্ন উঠতে শুরু করে ‘ইন্ডিয়া আউট’ নীতির কার্যকারিতা নিয়ে।
সব দিক থেকে সাঁড়াশি চাপে মলদ্বীপের অর্থনীতির কোমর আরও নুইয়ে পড়ে। এর পরেই নাকি টনক নড়ে মুইজ্জু সরকারের। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি থেকে হঠাৎই ভারত নিয়ে নিজেদের অবস্থান থেকে সরে এসে সম্পর্কের উন্নতির জন্য চেষ্টা চালাতে শুরু করে মলদ্বীপ। ভারতের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হন মুইজ্জু।
গত বছরের জুন মাসে মুইজ্জু প্রথম ভারতে আসেন। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মোদীর তৃতীয় বারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল তাঁকে। এর পর আবার অক্টোবরে সস্ত্রীক ভারতে আসেন তিনি। দু’দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকও হয়। মাঝে সে দেশের এক মন্ত্রী এসেও দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতির চেষ্টা করে মলদ্বীপের পর্যটনকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করেন।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের দেওয়া অর্থসাহায্য পেয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে ঋণখেলাপি হওয়া এড়াতে সক্ষম হন মুইজ্জু। মলদ্বীপকে সে সময় ৭৫.৭ কোটি ডলারের সহায়তা প্রদান করেছিল ভারত। উত্তর মলদ্বীপে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, দক্ষিণ মলদ্বীপে একটি সেতু ও সড়ক প্রকল্প, রাজধানী মালেতে একটি বৃহৎ আবাসন উন্নয়ন প্রকল্প এবং মালেকে তার পশ্চিম শহরতলির দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে সংযুক্ত করতে নতুন সেতু নির্মাণেও সাহায্য করে মোদী সরকার।
প্রত্যাশিত ভাবেই, মলদ্বীপের সঙ্কটে প্রয়োজনীয় অর্থসাহায্য দিয়ে ত্রাণদাতার ভূমিকা পালন করেছিল ভারত। আপাতত মালের সঙ্গে সমীকরণ কিছুটা ঠিকঠাক হলেও দিল্লি ভোলেনি যে মালে ও বেজিঙের সম্পর্ক এখনও ঘনিষ্ঠ।
ভারত মহাসাগরে তার ভূ-কৌশলগত অবস্থানের জেরে ও এই অঞ্চলে ভারতের উপরে চাপ বজায় রাখতে মলদ্বীপকে কোনও দিনই হাতছাড়া করতে চাইবে না বেজিং। অন্য দিকে, ভারত মহাসাগরে চিনা আধিপত্য একেবারেই চায় না ভারত। এ ছাড়াও বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কায় সাম্প্রতিক সরকার বদলের জেরে ভারত অন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চাইছে। তাই মলদ্বীপকে হাতে রাখতে মরিয়া নয়াদিল্লিও।
এর মধ্যেই স্বাধীনতা দিবসে প্রধান অতিথি হিসাবে মোদীকে আমন্ত্রণ জানান মুইজ্জু। মোদী প্রথম রাষ্ট্রনেতা যাঁকে মলদ্বীপের স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনে সম্মানিত অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুইজ্জু। আর মোদী শুক্রবার মলদ্বীপ সফরে গিয়েই মুইজ্জুর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার নানা বিষয় নিয়ে বৈঠক করেছেন। ভারতের তরফে প্রায় ৪৮৫০ কোটি টাকা ঋণের প্রস্তাবও পেয়েছে মলদ্বীপ। এমতাবস্থায় বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, ভারতের কাছে নতিস্বীকার করে আখেরে লাভই হয়েছে মুইজ্জুর।
ছবি: সংগৃহীত।