শুধুমাত্র অত্যাধুনিক অস্ত্র আমদানিতে আটকে থাকা নয়। ‘মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি’ বা এফটিএ (ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট) সেরে নিতে ইহুদি ‘বন্ধু’দের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করেছে ভারত। এতে যে ইজ়রায়েলের সঙ্গে নয়াদিল্লির ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য। সম্প্রতি দুই দেশের সম্পর্ককে মজবুত ভিত্তি দিতে ‘১০ডি’ শব্দবন্ধের ব্যবহার করেন কেন্দ্রীয় বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী পীযূষ গয়াল। তাঁর ওই মন্তব্যের কাটাছেঁড়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
কী এই ‘১০ডি’? ভারত-ইজ়রায়েল ব্যবসায়িক শীর্ষ সম্মেলনে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন মন্ত্রী পীযূষ। তাঁর দাবি, সামাজিক ও প্রশাসনিক ভাবে ১০টি কাঠামো এ দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। এর প্রতিটির আদ্যক্ষরে রয়েছে ইংরেজি বর্ণমালার ‘ডি’। সংশ্লিষ্ট কাঠামোয় লগ্নি কতটা লাভজনক এবং এর থেকে বিনিয়োগকারীরা কী কী সুবিধা পাবেন, অনুষ্ঠানে তা-ও স্পষ্ট করে দেন কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী মন্ত্রিসভার ওই সদস্য। শুধু তা-ই নয়, ইহুদিদের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধির ডাকও দিয়েছেন তিনি।
চলতি বছরের নভেম্বরে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের ৬০ সদস্যের প্রতিনিধি দল নিয়ে ইজ়রায়েল সফর করেন পীযূষ। তেল আভিভে ইহুদিদের অর্থনীতি এবং বাণিজ্যমন্ত্রী নীর বারাকাতের সঙ্গে দীর্ঘ ক্ষণ কথা বলেন তিনি। গত ২০ নভেম্বর ‘মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি’র আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করার শর্তাবলি বা টিওআরে (টার্মস অফ রেফারেন্স) সই করে দুই দেশ। এর পরেই ব্যবসায়িক শীর্ষ সম্মেলনে দেওয়া ভাষণে ‘১০ডি’ শব্দবন্ধটি শোনা গিয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর মুখে।
কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রীর ‘১০ডি’তে রয়েছে গণতন্ত্র (ডেমোক্র্যাসি), সিদ্ধান্তমূলক নেতৃত্ব (ডিসাইসিভ লিডারশিপ), ১৪০ কোটি জনগণের চাহিদা (ডিম্যান্ড), জনসংখ্যাতাত্ত্বিক লভ্যাংশ (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড), বৈচিত্র্য (ডাইভারসিটি), কার্বন নিঃসরণ কমানোর সদিচ্ছা (ডিকার্বোনাইজ়েশন), ডিজিটাল অর্থনীতি, ভারতীয়দের সংকল্প (ডিটারমিনেশন), পরিকাঠামোগত উন্নয়ন (ডেভেলপমেন্ট) এবং নির্ভরযোগ্যতা (ডিপেন্ডিবিলিটি)। তাঁর কথায়, এগুলির জন্যেই একটা বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছে নয়াদিল্লি।
অনুষ্ঠানে গয়াল বলেন, ‘‘অর্থনৈতিক সহযোগিতার ভিত্তিতে দুই দেশের উন্নতি করার প্রভূত সম্ভাবনা রয়েছে। ফিনটেক, কৃষি-প্রযুক্তি, ওষুধ, মহাকাশ, প্রতিরক্ষা, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং মেশিন লার্নিংয়ের মতো ক্ষেত্রগুলিতে আমরা যৌথ ভাবে কাজ করতে পারি।’’ সেই লক্ষ্যেই ‘মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি’ করতে চাইছে দুই দেশ। টিওআর সমঝোতায় শুল্ক বাধা দূর করে পণ্যের বাজার কী ভাবে খুলে দেওয়া যায় তা নিয়ে আলোচনা করবে নয়াদিল্লি ও তেল আভিভ।
বাণিজ্যচুক্তির জন্য ইতিমধ্যেই ভারত ও ইজ়রায়েলের মধ্যে আট দফা আলোচনা হয়েছে। ইহুদিভূমির সঙ্গে লেনদেন বাড়ানোর ব্যাপারে নয়াদিল্লির প্রবল আগ্রহ রয়েছে। কারণ রফতানি বাণিজ্যে ঘাটতি কমাতে সেখানে বৈচিত্র্য আনার মরিয়া চেষ্টা করছে মোদী সরকার। আর তাই কৌশলগত প্রকৃতি বিবেচনা করে তেল আভিভকে বিশেষ ‘বন্ধু’ হিসাবেই দেখছে কেন্দ্র।
তবে ইহুদিদের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তিতে বেশ কিছু বাধাও রয়েছে। প্রথমত, ইজ়রায়েলে কোনও বড় বাজার নেই। যদিও পশ্চিম এশিয়ার দেশটির হাতে রয়েছে একাধিক অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। তারা অবশ্য এ দেশের বাজারকে ভিত্তি করে রফতানি বৃদ্ধির দিকে নজর দিতে পারে। এই চ্যালে়ঞ্জের কারণে দু’তরফে ‘বন্ধুত্ব’ থাকলেও বাণিজ্য কখনওই সেখানে জায়গা করতে পারেনি।
মন্ত্রীর এ বারের সফরে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধির দিকে নজর দিয়েছে ইজ়রায়েলও। তেল আভিভ জানিয়েছে, মুক্ত বাণিজ্যচুক্তির আলোচনায় নয়াদিল্লির জন্য সংবেদনশীল ক্ষেত্রগুলিতে ঢোকার কোনও চেষ্টা করবে না তারা। এর মধ্যে থাকছে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য, চাল, গম এবং চিনি।
চলতি বছরের এপ্রিল থেকে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি সেরে ফেলার চেষ্টা চালাচ্ছে আমেরিকা। এর মাধ্যমে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের বাজার খুলে দেওয়ার দাবি তোলে ওয়াশিংটন। কিন্তু, ঘরোয়া ডেয়ারি শিল্প এবং পশুপালকদের লোকসানের ভয়ে তাতে রাজি হয়নি নয়াদিল্লি। সেই জট কাটিয়ে এখনও বাণিজ্যচুক্তি করতে পারেনি দুই দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ইজ়রায়েল তাই আগেই ওই সংবেদনশীল ক্ষেত্রগুলির সঙ্গে দূরত্ব রাখার কথা ঘোষণা করেছে।
পীষূষের সঙ্গে বৈঠকের পর নানা ইস্যুতে ভারতের প্রশংসা করেন ইজ়রায়েলি অর্থনীতি ও বাণিজ্যমন্ত্রী নীর বারাকাত। তিনি বলেন, ‘‘বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের জন্য নয়াদিল্লি একটা দুর্দান্ত বাজি হতে যাচ্ছে। ওদের সবচেয়ে স্মার্ট পরিকল্পনা হল মেক ইন ইন্ডিয়া। এই পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত থেকে কাজও করেছে বেশ কিছু ইজ়রায়েলি সংস্থা। এর পরিসর বাড়ানোর সময় এসে গিয়েছে।’’
এর পাশাপাশি ‘ভারত-পশ্চিম এশিয়া-ইউরোপ অর্থনৈতিক বারান্দা’ বা আইম্যাকের (ইন্ডিয়া মিডল-ইস্ট ইউরোপ ইকোনমিক করিডোর) কথা উল্লেখ করেছেন বারাকাত। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি আঞ্চলিক বাণিজ্যকে বদলে দেবে বলে দাবি করেছেন তিনি। সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক রাস্তাটির এক দিকে থাকছে মহারাষ্ট্রের রাজধানী তথা বন্দর শহর মুম্বই। বারান্দাটির ইজ়রায়েলের হাইফা বন্দর হয়ে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপে ঢোকার কথা রয়েছে।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয় জি-২০র শীর্ষ সম্মেলন। সেখানেই আইম্যাক তৈরির প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট বারান্দাটির মাধ্যমে ভারত, সৌদি আরব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপকে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এর জন্য জাহাজ, রেল এবং সড়ক যোগাযোগের বিশাল একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে। তবে এর ফলে যে বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত এবং ইজ়রায়েলের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে উল্লেখ্যযোগ্য পতন দেখতে পাওয়া গিয়েছে। গত আর্থিক বছরে (পড়ুন ২০২৪-’২৫) ইহুদিভূমিতে নয়াদিল্লি রফতানি করেছে মাত্র ২১৪ কোটি ডলারের পণ্য। ২০২৩-’২৪ অর্থবর্ষে তা ছিল ৪৫২ কোটি ডলার।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর প্যালেস্টাইনের গাজ়া ভুখণ্ড থেকে ইজ়রায়েলের উপর মারাত্মক হামলা চালায় হামাস। এর পরই তাদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ইহুদিরা। গত দু’বছরের বেশি সময় ধরে চলেছে সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। পশ্চিম এশিয়ায় ওই যুদ্ধের জেরে ভারতের রফতানি বাণিজ্যের সূচক নেমেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
রফতানির পাশাপাশি ২০২৪-’২৫ আর্থিক বছরে ইজ়রায়েলি পণ্যের আমদানি কমেছে ২৬.২ শতাংশ। ফলে সেটা ১৪৮ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। ২০০০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৫ সালের জুনের মদ্যে ইহুদিভূমি থেকে ৩৩ কোটি ৭৭ লক্ষ ডলারের প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই (ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট) পেয়েছে নয়াদিল্লি। এই অঙ্ক আগামী দিনে আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
এ বছরের ডিসেম্বরে ভারত সফরে আসার কথা রয়েছে ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর। প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন তিনি। দু’তরফে একাধিক প্রতিরক্ষা চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তার মধ্যেই ইহুদিদের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি নয়াদিল্লি সেরে ফেলতে পারে কি না, সেটাই এখন দেখার।
সব ছবি: সংগৃহীত।