আর মাত্র কয়েক দিনের অপেক্ষা। তার পরেই আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি সেরে ফেলবে ভারত। এর ফলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘শুল্ক বাণ’-এর খোঁচা থেকে আপাতত মুক্তি পাবে নয়াদিল্লি। সংশ্লিষ্ট চুক্তিটিতে সই হলে কতটা লাভবান হবে এ দেশের কৃষকসমাজ থেকে বণিকমহল? না কি উল্টে আর্থিক ভাবে লোকসানের মুখে পড়বেন তাঁরা? সমঝোতা চূড়ান্ত হওয়ার প্রাক মুহূর্তে এই সমস্ত প্রশ্নের কাটাছেঁড়ায় ব্যস্ত বিশেষজ্ঞমহল।
সূত্রের খবর, সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যচুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা আপেল, ব্লুবেরি ও ব্ল্যাকবেরির মতো বাদাম জাতীয় ফল এবং নির্বাচিত প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের শুল্ক কমাতে রাজি হয়েছে ভারত। তবে জিনগত ভাবে পরিবর্তিত ফসলকে কোনও ভাবেই এর আওতায় রাখতে নারাজ নয়াদিল্লি। আগামিদিনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে ‘মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি’ বা এফটিএ (ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট) হওয়ার কথা রয়েছে কেন্দ্রের। সে ক্ষেত্রে জিনগত ভাবে বদলে যাওয়া ফসলই হতে পারে নয়াদিল্লির তুরুপের তাস।
কেন্দ্রের দাবি, ভারত-মার্কিন বাণিজ্যচুক্তির জেরে আমেরিকার বাজারে এ দেশের পণ্যের উপর চাপবে ১১.৫ শতাংশ শুল্ক। পাল্টা আমেরিকার সামগ্রীর উপর সাত শতাংশ শুল্ক নেবে নয়াদিল্লি। তবে কৃষি, দুধ, দুগ্ধজাত সামগ্রী, গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশের ক্ষেত্রে এই হিসাব একেবারেই সরল নয়। শুধু তা-ই নয়, দুধ এবং দুগ্ধজাত সামগ্রীকে এই চুক্তির আওতায় রাখতেই চাইছে না কেন্দ্র। আর তাই এগুলি নিয়ে এখনও চলছে দর কষাকষি।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, ভারতের পক্ষে এই সমস্ত জায়গায় আমেরিকাকে খোলাখুলি ভাবে প্রবেশাধিকার দেওয়া কঠিন। কারণ, তাতে দেশের কৃষকসমাজের আর্থিক অবনতির আশঙ্কা বাড়বে। বাণিজ্যচুক্তির আলোচনাপর্বে কেন্দ্রকে এই বিষয়ে সতর্ক করে নীতি আয়োগ। সম্প্রতি, এ ব্যাপারে একটি বিস্তারিত সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া বা এসবিআই।
দেশের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কটির দাবি, কৃষি ও দুগ্ধজাত সামগ্রীর ক্ষেত্রে এ দেশের বাজার আমেরিকাকে খুলে দিলে লাভের চেয়ে লোকসান হবে বেশি। এতে দেশের দুধের ব্যবসার সঙ্গে যুক্তদের বছরে ক্ষতি হতে পারে ১.০৩ লক্ষ কোটি টাকা। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্য এ দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। জাতীয় মূল্য সংযোজন বা জিভিএ-র (গ্রস ভ্যালু অ্যাডেড) ২.৫ থেকে তিন শতাংশ উৎপাদনে বড় ভূমিকা রয়েছে এ দেশের দুধ ব্যবসায়ীদের।
এসবিআইয়ের সমীক্ষকদের দাবি, বর্তমানে দেশের প্রায় আট কোটি মানুষ দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে আছেন। জিভিএ-তে তাঁদের যে অবদান রয়েছে সেটা প্রায় ৭.৫ থেকে ন’লক্ষ কোটি টাকার সমান। এই পরিস্থিতিতে ভারতের বাজার আমেরিকার দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্যের জন্য খুলে গেলে সেগুলির দাম অন্তত ১৫ শতাংশ হ্রাস পাবে। পাশাপাশি, দেশে দুধ আমদানির পরিমাণ বছরে ২.৫ কোটি টন বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সমীক্ষকেরা জানিয়েছেন, দুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বর্তমানে যথেষ্ট ভাল জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ভারত। এই পরিস্থিতিতে আমেরিকা থেকে বিপুল পরিমাণে দুধ ঘরোয়া বাজারে ঢুকে পড়লে এর দাম যে হু-হু করে পড়বে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এতে আর্থিক ভাবে লোকসান হবে এ দেশের দুধ ব্যবসায়ীদের। বাণিজ্যচুক্তিতে কৃষিক্ষেত্রেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরল সমঝোতায় আসা নয়াদিল্লির পক্ষে একেবারেই সহজ নয়। কারণ, দুই দেশের চাষের মধ্যে রয়েছে আকাশ-পাতাল ফারাক।
বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, ভারতের একজন সাধারণ কৃষকের তুলনায় মার্কিন চাষিরা অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর ফসল উৎপাদন করে থাকে। কৃষিক্ষেত্রে এ দেশের উন্নতি করার এখনও অনেক জায়গা রয়েছে। তাই সূত্রের খবর, এই বাজারও পুরোপুরি আমেরিকাকে খুলে দিচ্ছে না নয়াদিল্লি। বর্তমানে জৈব খাদ্যদ্রব্য (অর্গানিক ক্রপ্স), মশলা, কফি-সহ বেশ কিছু ভারতীয় ফসলের আমেরিকার বাজারে দারুণ চাহিদা রয়েছে। বাণিজ্যচুক্তিতে সেই রফতানি কয়েক গুণ বাড়িয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে নয়াদিল্লির।
আমেরিকা কখনও কখনও বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহারের অজুহাত দিয়ে ভারতের আম, লিচু, কলা এবং ঢেঁড়শ-সহ বেশ কিছু তাজা সব্জির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে থাকে। বাণিজ্যচুক্তিতে এ ব্যাপারে একটা সমঝোতায় আসতে চাইছে নয়াদিল্লি। এ ছাড়া এ দেশের জৈব খাদ্যদ্রব্য (অর্গানিক ক্রপ্স), মশলা, কফি-সহ প্রিমিয়াম ফসলের রফতানি বর্তমানে ১০০ কোটি ডলারের নীচে রয়েছে। সেটা বাড়িয়ে ৩০০ কোটিতে নিয়ে যেতে চাইছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার।
আমেরিকায় তৈরি গাড়ির উপরে আপাতত কোনও শুল্কছাড় দেওয়ার পরিকল্পনা নেই ভারতের। তবে গাড়ির ধরনের উপর ভিত্তি করে শুল্কের একাধিক স্ল্যাব তৈরির বিষয়ে দু’পক্ষের আলোচনা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। সূত্রের খবর, এ ব্যাপারে নয়াদিল্লির প্রস্তাব একরকম মেনে নিয়েছে ওয়াশিংটন।
এসবিআইয়ের সমীক্ষা অনুযায়ী, আমেরিকার কাপড়ের বাজারে ঢুকতে পারলে আখেরে লাভ হবে ভারতের। নয়াদিল্লির কাছে বস্ত্র রফতানি পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া আয়ুষ এবং জেনেরিক ওষুধ এই বাণিজ্যচুক্তির ‘কালো ঘোড়া’ হতে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে। এই খাতে রফতানি বাড়াতে পারলে ১০০ থেকে ২০০ কোটি ডলার অতিরিক্ত রাজস্ব আয় হবে কেন্দ্রের, জানিয়েছেন এসবিআইয়ের সমীক্ষকেরা।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যচুক্তিতে আমেরিকায় রাসায়নিক রফতানির বাজারের দু’শতাংশ পর্যন্ত দখল করতে পারে ভারত। এতে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) বাড়বে ০.১ শতাংশ। বিনিময়ে, আমেরিকার ডিজিটাল ও অন্যান্য প্রযুক্তির দুনিয়ায় অনুপ্রবেশ চাইছে নয়াদিল্লি। সেই তালিকায় রয়েছে কৃত্রিম মেধা বা এআই (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স) এবং টেলিকম।
উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল যখন আমেরিকার সঙ্গে অন্তর্বর্তী বাণিজ্যচুক্তি সারতে ওয়াশিংটনে দর কষাকষি করছে, তখন ফের বোমা ফাটিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তাঁর দাবি, ইন্দোনেশিয়ার মতো ভারতের সঙ্গে আমেরিকার চুক্তি হতে চলেছে। তাঁর ওই মন্তব্যে অস্বস্তি বেড়েছে নয়াদিল্লির। কারণ বিশেষজ্ঞদের দাবি, তাতে লাভের পুরো গুড়টাই চলে যাবে যুক্তরাষ্ট্রের দখলে।
বস্তুত, ভারত-মার্কিন বাণিজ্যচুক্তি ইন্দোনেশিয়ার নকল হলে, এ দেশ থেকে রফতানি করা পণ্যের উপরে চাপবে ১৯ শতাংশ শুল্ক। কিন্তু আমেরিকা থেকে আমদানি করা সামগ্রীতে কোনও শুল্ক নেবে না নয়াদিল্লি। ফলে এই ইস্যুতে কেন্দ্রের মোদী সরকারকে নিশানা করতে ছাড়েনি প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস। ১৭ জুলাই এ ব্যাপারে মুখ খোলেন দলের সাধারণ সম্পাদক জয়রাম রমেশ।
ভারত-মার্কিন সম্ভাব্য বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) রমেশ লিখেছেন, ‘‘ভারত-পাকিস্তান পারমাণবিক উত্তেজনা এড়াতে ট্রাম্প বাণিজ্যকে টোপ করেছেন দাবি করলেও কেন নীরব রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী? লোকসভা এবং রাজ্যসভায় প্রধানমন্ত্রীকে এ ব্যাপারে স্পষ্ট উত্তর দিতে হবে। দেশ জানতে চায়।”
অন্য দিকে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ইন্দোনেশিয়ার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ওই দেশে এখন আমরা পূর্ণ প্রবেশাধিকার পেয়েছি। সকলেই জানেন যে ইন্দোনেশিয়া তাম্রসমৃদ্ধ দেশ। কিন্তু সেখানে আমাদের কোনও শুল্ক দিতে হবে না। ভারতও সেই দিশাতেই চলছে। আমরাও ভারতের বাজারে ঢুকব। আপনাদের বুঝতে হবে, আমাদের এর আগে এই রাষ্ট্রগুলিতে প্রবেশাধিকার ছিল না। এখন শুল্কের প্রশ্নে যে নীতি নিয়েছি তার ফলে ঢুকতে পারছি।’’
কেন্দ্রের উপদেষ্টা সংস্থা নীতি আয়োগের অবশ্য দাবি, আমেরিকার সঙ্গে চুক্তি চূড়ান্ত হলে অন্য অনেক দেশের তুলনায় রফতানিতে বেশি সুবিধা পাবে ভারত। তাদের বক্তব্য, চিন (৩০ শতাংশ), কানাডা (৩৫ শতাংশ) এবং মেক্সিকোর (২৫ শতাংশ) পণ্যের উপরে যথেষ্ট চড়া আমদানি শুল্ক বসিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এরা ওয়াশিংটনের অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্য-সহযোগী। নয়াদিল্লি যদি শুল্ক ২০ শতাংশের নীচে রাখতে পারে, তা হলে তারা অনেকটা এগিয়ে থাকবে। মোট ৩০ শ্রেণির পণ্যের মধ্যে ২২টির ক্ষেত্রে সুবিধাজনক জায়গায় থাকা যাবে বলে জানিয়েছে নীতি আয়োগ।
গত ২ এপ্রিল পারস্পরিক শুল্ক নীতি ঘোষণা করেন ট্রাম্প। তাতে ভারতীয় পণ্যের উপরে ২৬ শতাংশ শুল্ক আরোপের কথা বলা হয়েছিল। পরে এতে ৯০ দিনের ছাড় দেন তিনি। ৯ জুলাই সেই সময়সীমা শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, অতিরিক্ত আমদানি শুল্ক কার্যকর করার সময় আরও তিন সপ্তাহ পিছিয়ে ১ অগস্ট করে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট। ফলে বাণিজ্যচুক্তিতে দর কষাকষির ক্ষেত্রে আরও কিছুটা সময় হাতে পেয়েছে ভারত।
সংবাদসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যকে ৫০ হাজার কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে ভারতের। বাণিজ্যচুক্তিতে সেই বিষয়টিও মাথায় রাখছে কেন্দ্র। বর্তমানে নয়াদিল্লির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্য ঘাটতি ৪,৪০০ কোটি ডলার বলে জানা গিয়েছে। সম্ভাব্য চুক্তিতে সই হলে কোন পক্ষ লাভবান হয়, সেটাই এখন দেখার।
সব ছবি: সংগৃহীত।