প্রতি সেকেন্ডে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে বিস্ফোরণের দিকে। ফুরিয়ে আসছে সময়। যে কোনও মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে অঘটন। ভারতের একাধিক বাঁধকে তেমনই ‘টাইম বোমা’ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত বর্তমানে যে সঙ্কটগুলির মোকাবিলা করছে, তার মধ্যে অন্যতম বাঁধের সমস্যা। শুধু সঙ্কট নয়, নীরব সঙ্কট।
বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন, ভারতের বুড়ো বাঁধগুলির বেশ কয়েকটি, বিশেষ করে হিমালয়ের নদীর উপর তৈরি বাঁধগুলি ঝুঁকির মুখে রয়েছে। ঝুঁকির মুখে রয়েছেন সেই বাঁধগুলির আশপাশের এলাকার লক্ষ লক্ষ মানুষও।
হিসাব বলছে, ভারতে বড় বাঁধের সংখ্যা ছ’হাজারের বেশি। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি বাঁধের বয়স বছরের হিসাবে সেঞ্চুরি পার করেছে। হাজারেরও বেশি বাঁধের বয়স ৫০ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে ভারতে ১০৬৫টি বাঁধের বয়স ৫০ থেকে ১০০-র মধ্যে। ২২৪টির বয়স ১০০ বছরের গণ্ডি পেরিয়েছে। ২০৫০-এর মধ্যে ভারতের ৪২০০টি বাঁধের বয়স ৫০-এর উপর হয়ে যাবে।
বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, এর মধ্যে একাধিক বাঁধের প্রাথমিক কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিছু কিছু বাঁধের বার্ধক্যও চিন্তা ধরাচ্ছে। বেশ কয়েকটির জলধারণ ক্ষমতা কমেছে প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ।
ভারতের সবচেয়ে পুরনো বাঁধ তামিলনাড়ুর কাল্লানাই বাঁধ। দ্বিতীয় শতকে তৈরি সেই বাঁধ মেরামত করা হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। কেরলের মুল্লাপেরিয়ার বাঁধ তৈরি হয় ১৮৯৫ সালে। মেত্তুর বাঁধ ১৯৩৪ সালে তৈরি হয় কাবেরী নদীতে। নিজাম সাগর বাঁধ তৈরি হয়েছে ১৯৩১ সালে। ব্রিটিশ আমলে কৃষ্ণা এবং গোদাবরীর উপর অনেক বাঁধ তৈরি হয়েছে।
স্বাধীনতার পর ভারতের বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্প, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, সর্বোপরি দেশের সার্বিক উন্নতির জন্য বাঁধ তৈরির দিকে নজর দেওয়া হয়। ‘দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন’ ভারতের প্রথম বহুমুখী বাঁধ প্রকল্প।
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ভারতের অন্যতম বড় বাঁধ যেমন ভাখড়া নাঙ্গল, হিরাকুদ, তুঙ্গভদ্রা এবং কোয়েনা হয়ে ওঠে দেশের উন্নতির প্রতীক। ১৯৫১ থেকে ’৭১ পর্যন্ত ৪১৮টি বড় বাঁধ তৈরি হয় সবুজ বিপ্লবকে সফল করার জন্য।
১৯৮০-এর পর বাঁধগুলি তৈরির উদ্দেশ্যে পরিবর্তন আসে। কৃষি, বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি পর্যটন শিল্প এবং মাছচাষের উদ্দেশ্যেও বাঁধ তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ভারতের অর্থনীতিতে বাঁধের গুরুত্ব অপরিসীম। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে কৃষিকাজ এবং পানীয় জল সরবরাহের ক্ষেত্রে বাঁধ অপরিহার্য। কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকগুলি বর্তমানে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে।
২০২৩ এবং ২০২৪ সালে তিস্তায় বান আসার কারণে নদীর উপর তৈরি বাঁধের কাঠামোর একাংশ ক্ষতির মুখে পড়েছিল। পুরো বাঁধ না ভাঙলেও বিষয়টি উদ্বেগের বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, তিস্তার বাঁধের মতো ভারতের অনেক নদীবাঁধের অবস্থা খারাপ। জায়গায় জায়গায় ফাটল ধরেছে। জল চুঁইয়ে পড়ছে। বাঁধের নীচে পলি জমে কমে গিয়েছে জলধারণ ক্ষমতা।
পাশাপাশি, ওই বাঁধগুলির আশপাশে প্রচুর মানুষের বসবাস। ফলে বাঁধ ভাঙলে ক্ষতির মুখে পড়তে হবে তাঁদের। অনেক প্রাণসংশয়ের আশঙ্কা রয়েছে। আশঙ্কা রয়েছে হাজার হাজার কোটির সম্পত্তি নষ্ট হওয়ারও।
চলতি বছরে উদ্বেগ আরও বেশি। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝির পর তাপমাত্রা কমার কথা। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তেমনটা হয়নি। বরং দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় বৃষ্টি হয়ে চলেছে বর্ষাকালের মতো। পাহাড়ি এলাকাগুলিতে হড়পা বানের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই পরিস্থিতিতে বাঁধ সংক্রান্ত উদ্বেগ উত্তরোত্তর বাড়ছে বলেই মত বিশেষজ্ঞদের।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের যে বাঁধগুলি এক সময় সেচ, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তার মধ্যে অনেকগুলির কাঠামো পুরোনো হয়ে গিয়েছে।
সেই পুরোনো বাঁধগুলিরই এখন নতুন করে পরিচর্যার সময় এসেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের। তাঁদের মতে, বাঁধগুলি নতুন করে এমন ভাবে তৈরি করতে হবে যাতে সেগুলি জলবায়ুর পরিবর্তন সহ্য করতে পারে।
বাঁধগুলির স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য ইতিমধ্যেই ‘ড্যাম সেফটি অ্যাক্ট ২০২১’ কার্যকর হয়েছে। ‘ন্যাশনাল ড্যাম সেফটি অথরিটি’, ‘ন্যাশনাল কমিটি অন ড্যাম সেফটি’, ‘স্টেট ড্যাম সেফটি অর্গানাইজ়েশন’-এর মতো কয়েকটি সরকারি সংস্থাও তৈরি হয়েছে।
সংস্থাগুলির মূল উদ্দেশ্য হল, বাঁধসুরক্ষার মান বজায় রাখা, বাঁধ সম্পর্কিত দুর্যোগ প্রতিরোধ করা, বাঁধসুরক্ষার নীতি ও বিধিমালা তৈরি করা এবং বাঁধের সঠিক তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করা।
বর্ষাকালের আগে এবং পরে বাঁধগুলির স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা, কোনও বছর খুব বেশি বৃষ্টি হলে কী করতে হবে এবং বাঁধ ভাঙলে কী ক্ষতি হতে পারে, তা আগেভাগে হিসাব কষে রাখার দায়িত্বও বর্তায় সংস্থাগুলির উপর। কোনও বাঁধের স্বাস্থ্য ভাল না থাকলে তারও রিপোর্ট দেবে ওই কমিটিগুলি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যে বাঁধগুলি বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে এবং যেগুলি ভাঙলে বেশি ক্ষতি হবে সেগুলি দ্রুত খুঁজে চিহ্নিত করতে হবে সংস্থাগুলিকে। বাঁধগুলির ভিত্তি এবং জলধারণ ক্ষমতা কী ভাবে বাড়ানো যায়, সে দিকেও নজর দিতে হবে।
পাশাপাশি, সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে বাঁধগুলির কাঠামো মজবুত করা, বাঁধগুলিতে ‘আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম’ বসানোর সপক্ষেও কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞেরা। বাঁধগুলির আশপাশের এলাকার মানুষকেও জানিয়ে রাখতে হবে আশঙ্কার বিষয়ে। তা হলেই মুক্তি পাওয়া যাবে বাঁধসঙ্কট থেকে।
সব ছবি: সংগৃহীত।