সৌদি আরবের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি। তুর্কি সামরিক ড্রোন কারখানায় সিলমোহর। ‘অপারেশন সিঁদুর’ পরবর্তী সাত মাসে ভারতের রক্তচাপ বাড়িয়ে একের পর এক ‘মাস্টারস্ট্রোক’ দিয়ে চলেছে পাকিস্তান। এ-হেন পরিস্থিতিতে ফের নয়াদিল্লির দিকে ‘বন্ধুত্ব’র হাত বাড়িয়ে দিল ইজ়রায়েল। আগামী দিনে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির হাতিয়ারের উৎপাদন এ দেশে সরিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে পশ্চিম এশিয়ার ওই ইহুদি রাষ্ট্র। এতে ইসলামাবাদের পাশাপাশি আঙ্কারা এবং রিয়াধকেও ‘কিস্তিমাত’ দেওয়া যাবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
সম্প্রতি, পশ্চিম এশিয়ার ইহুদিভূমিতে বৈঠকে বসে ‘ভারত-ইজ়রায়েল জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ (জ়েডব্লিউজি)। সেখানে হাজির ছিলেন নয়াদিল্লির প্রতিরক্ষা সচিব রাজেশকুমার সিংহ। আলোচনায় অত্যাধুনিক হাতিয়ারের যৌথ উৎপাদনে সম্মত হয় দুই দেশ। এর পরেই সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে নতুন একটি সমঝোতা স্মারক বা মউ (মেমোরেন্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং) সই করে নয়াদিল্লি ও তেল আভিভ। এতে অস্ত্রের পাশাপাশি কৃত্রিম মেধা বা এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) এবং সাইবার নিরাপত্তার মতো সংবেদনশীল বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে, খবর সূত্রের।
ইজ়রায়েলি গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগামী দিনে উচ্চ প্রযুক্তির ড্রোন, অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বা এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের মতো হাতিয়ারগুলির উৎপাদন পুরোপুরি ভাবে ভারতে সরিয়ে আনবে তেল আভিভ। এ দেশের মাটিতে তৈরি হতে পারে ইহুদিদের লাইট মেশিন গান এবং অ্যাসল্ট রাইফেল। অস্ত্রনির্মাণের পাশাপাশি নয়াদিল্লির সঙ্গে যৌথ ভাবে প্রতিরক্ষা গবেষণাতেও অংশ নিতে চাইছে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার।
কিন্তু কেন হঠাৎ হাতিয়ার উৎপাদন ভারতে স্থানান্তরিত করতে চাইছে ইজ়রায়েল? প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, এর নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ। প্রথমত, গত দু’বছর ধরে চলা গাজ়া যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইরানের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে তেল আভিভ। ফলে ইহুদিদের শহরগুলিকে ‘হাইপারসনিক’ ক্ষেপণাস্ত্রে নিশানা করে সাবেক পারস্য দেশের আধা সেনা ‘ইসলামিক রিপাবলিক অফ গার্ড কোর’ বা আইআরজিসি। আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে (পড়ুন এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) কাজে লাগিয়েও তা আটকাতে পারেনি নেতানিয়াহুর ফৌজ।
চলতি বছরের জুনে ১২ দিনের যুদ্ধে তেহরানের ছোড়া ‘হাইপারসনিক’ ক্ষেপণাস্ত্রে তছনছ হয়ে যায় একাধিক ইজ়রায়েলি শহর। সংঘাতে থামলে ইহুদি গুপ্তচরবাহিনী ‘মোসাদ’-এর একাধিক এজেন্টকে ফাঁসিতে ঝোলায় পারস্য উপসাগরের কোলের ওই শিয়া মুলুক। তেল আভিভের আশঙ্কা, আগামী দিনে তাঁদের অস্ত্র কারখানাগুলিকে নিশানা করবে আইআরজিসি। সেই ছক এখন থেকেই কষতে শুরু করেছে ইরানি সরকার। আর তাই হাতিয়ার উৎপাদন ভারতে স্থানান্তরিত করে নিশ্চিত হতে চাইছে তেল আভিভ।
দ্বিতীয়ত, হাতিয়ারের ব্যাপারে আমেরিকার উপর ইজ়রায়েলের নির্ভরশীলতা সর্বজনবিদিত। অতীতে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে অস্ত্রের ঝাঁপি খুলে ইহুদিদের পাশে বার বার যুক্তরাষ্ট্রকে দাঁড়াতে দেখা গিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, তেল আভিভের হাতে থাকা লড়াইয়ের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া কোনও হাতিয়ার কখনওই পশ্চিম এশিয়ার কোনও আরব দেশকে বিক্রি করত না ওয়াশিংটন। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে বদলেছে সেই সমীকরণ। এতে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিশ্বাস কিছুটা টোল খেয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
এ ব্যাপারে উদাহরণ হিসাবে সৌদি আরবের যুবরাজ তথা প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ বিন সলমনের কথা বলা যেতে পারে। গত নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন তিনি। এর পরই রিয়াধকে পঞ্চম প্রজন্মের ‘স্টেলথ’ শ্রেণির লড়াকু জেট ‘এফ-৩৫ লাইটনিং টু’ সরবরাহের ইঙ্গিত দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। বর্তমানে পশ্চিম এশিয়ায় ইহুদি বিমানবাহিনীর বহরেই একমাত্র রয়েছে ‘লকহিড মার্টিন’-এর তৈরি ওই অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান। ফলে সংঘাত পরিস্থিতিতে দ্রুত শত্রুর আকাশের দখল নিতে কোনও সমস্যা হচ্ছে না ইজ়রায়েলের।
আর তাই মার্কিন নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠে ধীরে ধীরে সামরিক ক্ষেত্রে ‘আত্মনির্ভর’ হতে চাইছে ইহুদিভূমি। জুনের লড়াই থেকে শিক্ষা নিয়ে অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, ড্রোন, হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং গ্লাইড ভেহিকল তৈরিতে জোর দিয়েছেন তেল আভিভের প্রতিরক্ষা গবেষকদের একাংশ। ইরানি হামলা আটকাতে আমেরিকার তৈরি ‘থাড’-এর (পড়ুন টার্মিনাল হাই অলটিচ্যুড এরিয়া ডিফেন্স) উপর ভরসা রেখেছিল ইজ়রায়েল। কিন্তু বাস্তবে তাদের শহরগুলিকে রক্ষা করতে সে ভাবে কার্যকর হয়নি ওই এয়ার ডিফেন্স।
জুনের লড়াইয়ে ঝটিতি হামলায় ইরানি পরমাণু কেন্দ্রগুলিকে ওড়ানোর মরিয়া চেষ্টা করে ইজ়রায়েলি বিমানবাহিনী। কিন্তু, সাবেক পারস্য দেশের আণবিক কেন্দ্রগুলি মাটির গভীরে থাকায় সেগুলিকে ধ্বংস করতে প্রয়োজন ছিল ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমার। ফলে ফের আমেরিকার দ্বারস্থ হন প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। বেশ কয়েক দিন টালবাহানার পর শেষে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলিতে জিবিইউ-৫৭ নামের ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমা ফেলে মার্কিন বিমানবাহিনী। সেই অপারেশন শেষ হতেই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা করেন ট্রাম্প।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের ওই পদক্ষেপকে একেবারেই ভাল চোখে দেখেননি ইজ়রায়েলি রাজনৈতিক নেতৃত্বের একাংশ। তখন থেকেই অস্ত্রনির্মাণে আমেরিকার নির্ভরশীলতা কমানোর উপর জোর দেন তাঁরা। এ ব্যাপারে ভারতকে বেছে নেওয়ার সবচেয়ে বড় যুক্তি হল নয়াদিল্লির বিশ্বাসযোগ্যতা। ‘অপারেশন সিঁদুর’ পরবর্তী পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি পদক্ষেপে তা আরও মজবুত হয়েছে। পাশাপাশি, এ দেশের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে হাতিয়ার নির্মাণ তেল আভিভের বাণিজ্যিক ঘাটতি মেটাতেও যে সাহায্য করবে, তা বলাই বাহুল্য।
২০১৫-’১৯ সালের মধ্যে ইজ়রায়েলের হাতিয়ার রফতানির ৩৪ শতাংশ ছিল ভারতনির্ভর। কিন্তু, ২০১৮-’২২ সালের মধ্যে সেটা নেমে এসেছে মাত্র ন’শতাংশে। কারণ, এখন আর কোনও দেশের থেকে শুধু অস্ত্র কিনছে না নয়াদিল্লি। সেখানে যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তির হস্তান্তর এবং ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পে স্থানীয় উৎপাদনের শর্ত, যা মানার ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা নেই ইহুদিদের। সূত্রের খবর, এ ব্যাপারে ‘বারাক-৮’ ক্ষেপণাস্ত্র মডেল অনুসরণ করতে চাইছে তারা।
হিব্রু ভাষায় ‘বারাক’ শব্দটির অর্থ হল বজ্রপাত। ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে দূরপাল্লার এবং মাঝারি পাল্লার ভূমি থেকে আকাশের এই ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছে ইজ়রায়েল। ২০১৬ সাল থেকে তা ব্যবহার করছে দুই দেশের ফৌজ। শুধু তা-ই নয়, ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি রফতানিও করেছে নয়াদিল্লি এবং তেল আভিভ। এই একই কায়দায় ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের উৎপাদন এবং গবেষণা ইহুদিরা এ দেশে সরাবে বলে জানা গিয়েছে।
গত ৫ ডিসেম্বর তুর্কি-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা সমঝোতা সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ‘ব্লুমবার্গ’। সেখানে একটি সূত্রকে উল্লেখ করে মার্কিন গণমাধ্যমটি জানিয়েছে, গত অক্টোবর থেকে যৌথ ভাবে ড্রোন নির্মাণের বিষয়টি নিয়ে ইসলামাবাদ ও আঙ্কারার মধ্যে চলছে আলোচনা। সেখানে যথেষ্ট সাফল্য পেয়েছেন রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলরা। ফলে পশ্চিমের প্রতিবেশীর জমিতে পাইলটবিহীন বিমানের কারখানা তৈরি এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা বলে মনে করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট সূত্রটি ‘ব্লুমবার্গ’কে জানিয়েছে, পাক জমিতে ‘স্টেলথ’ শ্রেণির দূরপাল্লার ড্রোন তৈরি করবে তুরস্ক। তবে সম্ভবত পাইলটবিহীন বিমানের প্রযুক্তি আঙ্কারার থেকে পাচ্ছে না ইসলামাবাদ। ভূমধ্যসাগরের কোলের ইউরোপীয় দেশটি থেকে ড্রোনের বিভিন্ন অংশ হাতে পাবেন রাওয়ালপিন্ডির জেনারেলরা। পরে সেগুলিকে জুড়ে মানববিহীন উড়ুক্কু যান নির্মাণ করবেন তাঁরা। অর্থাৎ, ড্রোন ‘অ্যাসেম্বলিং’ কারখানা খুলতে চলেছে ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশী।
আগামী দিনে পাকিস্তানের অ্যাসেম্বলিং কারখানায় কী কী ধরনের ড্রোন তৈরি করার পরিকল্পনা তুরস্কের রয়েছে, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। তবে বিশ্লেষকদের অনুমান, সেটা ‘বের্যাক্টার টিবি-২’ এবং ‘সোঙ্গার’ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, এই দুই পাইলটবিহীন বিমানের অন্যতম ক্রেতা হল ইসলামাবাদ। চালকবিহীন জেট-ইঞ্জিন-চালিত যুদ্ধবিমান (ফাইটার ড্রোন) দিয়ে ‘আকাশ থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র’ (‘এয়ার টু এয়ার মিসাইল) ছুড়তে সক্ষম ইউরোপের ওই দেশ। কিন্তু সেই প্রযুক্তি এখনই রাওয়ালপিন্ডির জেনারেলদের পাওয়ার সম্ভাবনা কম বলেই মনে করা হচ্ছে।
এ বছরের সেপ্টেম্বরে সৌদি আরবের সঙ্গে ‘কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি’ করে পাকিস্তান। সেখানে বলা হয়েছে, এই দু’য়ের মধ্যে কোনও একটি দেশ তৃতীয় কোনও শক্তি দ্বারা আক্রান্ত বা আগ্রাসনের শিকার হলে, তাকে উভয় দেশের উপর আঘাত বা যুদ্ধ হিসাবে বিবেচনা করা হবে। সাবেক সেনাকর্তাদের দাবি, ইসলামাবাদ ও রিয়াধের মধ্যে এই সমঝোতা ভারত ও ইজ়রায়েলকে কাছাকাছি আসতে যথেষ্ট সাহায্য করেছে।
পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং তুরস্ক, এই তিন দেশের সঙ্গেই ঘোরতর শত্রুতা রয়েছে ইজ়রায়েলের। ইসলামাবাদ তো ইহুদি রাষ্ট্রটিকে স্বীকৃতিই দেয়নি। অন্য দিকে পাকিস্তানের প্রতি রিয়াধ ও আঙ্কারার প্রেম নয়াদিল্লির উদ্বেগ বাড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ইহুদিদের অস্ত্র নির্মাণ ‘গেম চেঞ্জার’ হতে চলেছে বলেই মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন তেল আভিভে মোতায়েন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত। তাঁর কথায়, ‘‘আগামী ছ’মাস থেকে এক বছরের মধ্যে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে আরও মজবুত হবে দুই দেশের অংশীদারি। কারণ এই সমঝোতাটি ভারতের কাছে ঐতিহাসিক হতে যাচ্ছে। আমরা হাতে পাব ইহুদিদের সামরিক প্রযুক্তি, যেটা আমাদের বাহিনীকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলবে।’’
এ বছরের ডিসেম্বরে ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ভারতসফরে আসার কথা ছিল। কিন্তু, নভেম্বরে দিল্লি বিস্ফোরণের পর নিরাপত্তা সমস্যার কথা মাথায় রেখে সেটা পিছিয়ে দেন তিনি। তবে জানুয়ারির মধ্যে নয়াদিল্লিতে পা পড়তে পারে তাঁর। তখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠকে এ ব্যাপারে আরও এক ধাপ এগিয়ে চুক্তি করতে পারে দুই দেশ, বলছেন সাবেক সেনাকর্তারা।
সব ছবি: সংগৃহীত।