সঙ্গীতানুষ্ঠান উপলক্ষে বিদেশ সফরে গিয়েছিলেন জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী জ়ুবিন গার্গ। শুক্রবার সিঙ্গাপুরের ‘নর্থইস্ট ফেস্টিভ্যাল’-এ পারফর্ম করার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু পারফরম্যান্সের আগেই ঘটল দুর্ঘটনা। স্কুবা ডাইভিং করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তড়িঘড়ি তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিছু ক্ষণ পর মৃত্যু হয় গায়কের।
১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসে মেঘালয়ের তুরা শহরে জন্ম জ়ুবিনের। তার পর অসমের জোরহাটে পরিবার-সহ চলে যান তিনি। সেখানেই বাবা-মা এবং দুই বোনের সঙ্গে থাকতেন জ়ুবিন।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত কন্ডাক্টর জ়ুবিন মেহতার নামানুসারে নাম রাখা হয়েছিল জ়ুবিনের। তাঁর বাবা পেশায় ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। পাশাপাশি কপিল ঠাকুর ছদ্মনামে গানের বাণী রচনাও করতেন তিনি।
জ়ুবিনের মা পেশায় সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন। বাবা-মা দু’জনেই সঙ্গীতজগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে শৈশব থেকেই সঙ্গীতের প্রতি তাঁর আগ্রহ জন্মায়। অসমের একটি স্কুল থেকে পড়াশোনা শেষ করেন জ়ুবিন।
বিজ্ঞানে স্নাতক হওয়ার জন্য অসমের একটি কলেজে ভর্তি হন জ়ুবিন। কিন্তু সঙ্গীত নিয়ে কেরিয়ার গড়তে চান বলে মাঝপথেই কলেজের পড়াশোনা ছেড়ে দেন তিনি। ২০২৪ সালে মেঘালয়ের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে সাম্মানিক ডক্টর অফ লিটারেচার (ডি. লিট) ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছিল।
তিন বছর বয়স থেকে গান গাইতে শুরু করেন জ়ুবিন। মায়ের কাছেই প্রথম গান শিখেছিলেন তিনি। দীর্ঘ ১১ বছর তবলার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন তিনি। তবলার পাশাপাশি গিটার, ড্রাম, হারমোনিয়াম-সহ মোট ১২টি বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শিখেছিলেন জ়ুবিন।
১৯৯২ সালে সঙ্গীতকে পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন জ়ুবিন। অসমিয়া ভাষায় ‘অনামিকা’ নামের একটি গানের অ্যালবাম মুক্তি পেয়েছিল তাঁর। তিন বছর অসমে থাকার পর ১৯৯৫ সালে সঙ্গীতজীবনে উন্নতির আশায় মুম্বই চলে গিয়েছিলেন জ়ুবিন।
অসমিয়া-সহ ৪০টি ভাষায় গান গাইতে পারদর্শী ছিলেন জ়ুবিন। ২০০৬ সালে বড় সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। অনুরাগ বসুর পরিচালনায় প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ‘গ্যাংস্টার’। এই ছবিতে ‘ইয়া আলি’ গানটি গেয়ে রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিলেন জ়ুবিন।
২০০৬ সালের পর জ়ুবিনের কেরিয়ার অন্য দিকে মোড় নেয়। ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গরিমা শইকীয়া নামে এক তরুণীকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। অসমে পোশাক পরিকল্পক হিসাবে কাজ করেন গরিমা।
বলিপাড়া সূত্রে খবর, জ়ুবিনের গান শুনে তাঁর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন গরিমা। তাঁকে চিঠি লিখে সে কথা জানিয়েছিলেন তিনি। জ়ুবিনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ক্রমে গভীর হতে শুরু করে। ২০০২ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তাঁরা।
জ়ুবিনের এক বোন পেশায় অভিনেত্রী এবং সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন। অসমের সোনিতপুর জেলায় অনুষ্ঠানের জন্য গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বাড়ি ফেরার সময় পথ দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলেন জ়ুবিনের বোন। সেই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন তিনি।
বোন মারা যাওয়ার পর মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলেন জ়ুবিন। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মারা গিয়েছিলেন তাঁর বোন। বোনের স্মৃতিতে অসমিয়া ভাষায় একটি গানের অ্যালবাম প্রকাশ করেছিলেন তিনি।
কোনও ধর্মে বিশ্বাস রাখতেন না জ়ুবিন। ২০২৪ সালে একটি কনসার্টে গিয়ে সেই সংক্রান্ত মন্তব্য করায় বিতর্কেও জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। দানধ্যানের পাশাপাশি নানা ধরনের সমাজসেবার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন জ়ুবিন।
কোভিড অতিমারির সময় জ়ুবিনের অচেনা রূপ দেখেছিল দেশ। গুয়াহাটিতে দোতলা বাড়িতে থাকতেন গায়ক। কোভিডের সময় আক্রান্তদের জন্য নিজের বাড়ির দরজা খুলে দিয়েছিলেন তিনি। অসমের ডিগবয় শহরে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ২০ ফুট উঁচু মূর্তি তৈরি হয়। ২০২২ সালে নিজেই সেই মূর্তি উন্মোচন করেছিলেন গায়ক।
গত মে মাসে বেশ কয়েক দিন ধরে জ্বর ও সর্দিতে ভুগছিলেন জ়ুবিন। অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ায় তাঁকে অসমের হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল। পরে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন তিনি।
শোনা যায়, বোনের মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি জ়ুবিন। সেই শোকে একসময় নাকি মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছিলেন গায়ক।
শুক্রবার সিঙ্গাপুরে ‘নর্থইস্ট ফেস্টিভ্যাল’-এ যোগ দিতে গিয়েছিলেন জ়ুবিন। স্থানীয় সময় দুপুর দেড়টা নাগাদ স্কুবা ডাইভিং করতে গিয়ে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা শুরু হয় গায়কের। আইসিইউ-তে ভর্তি করা হলে দুপুর আড়াইটে নাগাদ মৃত ঘোষণা করা হয় শিল্পীকে। মাত্র ৫২ বছর বয়সে চিরশান্তির দেশে চলে গেলেন গায়ক।
সব ছবি: সংগৃহীত।