পাকিস্তানের নাকের ডগায় ‘পার্ল হারবার’! তবে আমেরিকার নয়, ভারতের। আরব সাগরের প্রবাল দ্বীপমালায় কৌশলগত নৌসেনা ঘাঁটি তৈরি করবে নয়াদিল্লি। এই খবর প্রকাশ্যে আসতেই ঘুম ছুটেছে ইসলামাবাদের। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, সংশ্লিষ্ট ছাউনিটি তৈরি হয়ে গেলে হরমুজ় প্রণালী থেকে শুরু করে লোহিত সাগর পর্যন্ত অনায়াসে নজরদারি করতে পারবে এ দেশের নৌসেনা। পাশাপাশি, আটকানো যাবে পশ্চিমি উপকূলে শত্রুর আগ্রাসন।
দক্ষিণ ভারতে আরব সাগরের বুকে রয়েছে ৩৬টি ছোট-বড় প্রবাল দ্বীপ। এলাকাটিকে সবাই চেনে লক্ষদ্বীপ নামে। কেরলের কোচি নৌসেনা ঘাঁটি থেকে এর দূরত্ব মেরেকেটে ৪৪০ কিলোমিটার। আর হাজার কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে পাকিস্তানের করাচি বন্দর। এ-হেন কৌশলগত অবস্থানের কারণে সেখানে সামরিক ছাউনি তৈরির সিদ্ধান্ত নয়াদিল্লির ‘মাস্টারস্ট্রোক’ হতে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। আগামী দিনে সংঘাত পরিস্থিতিতে যুদ্ধের মোড় ঘোরাতে লক্ষদ্বীপের বড় ভূমিকা থাকবে বলেও স্পষ্ট করেছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
স্বাধীনতার পর থেকে এত দিন পর্যন্ত পূর্বের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে আসছিল কেন্দ্র। তামিলভূমির রাজধানী চেন্নাই থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১,২০০ কিলোমিটার। অথচ কেরল উপকূল থেকে অনেকটা কাছে হওয়া সত্ত্বেও লক্ষদ্বীপের উপর সে ভাবে নজর ছিল না প্রশাসনের। কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী সরকার আসার পর থেকে নিরাপত্তার প্রশ্নে বার বার উঠতে শুরু করে লক্ষদ্বীপের নাম। প্রাথমিক ভাবে প্রবাল দ্বীপগুলির নামানুসারে রণতরীগুলির নাম রাখা শুরু করে ভারতীয় নৌসেনা।
এ ব্যাপারে উদাহরণ হিসাবে আইএনএস কাভারাত্তি, আইএনএস কিলতন এবং আইএনএস কদমতের কথা বলা যেতে পারে। সংস্কৃত এবং মালায়লাম ভাষায় লক্ষদ্বীপ শব্দটির অর্থ হল ‘এক লাখ দ্বীপের সমাহার’। ফলে অনেকেই মনে করেন, কোনও একটা সময়ে ওই এলাকায় ছোট-বড় মিলিয়ে ছিল লাখখানেক দ্বীপ। বর্তমানে ৩৬টির মধ্যে সেখানকার ১০টি দ্বীপ বাসযোগ্য। তার মধ্যে একেবারে উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের দ্বীপটির নাম বিত্রা। সেখানে ‘পার্ল হারবার’-এর কায়দায় নৌসেনা ঘাঁটি তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে নয়াদিল্লির।
লক্ষদ্বীপের বিত্রার আয়তন মাত্র ১.৭১ বর্গকিলোমিটার। ১০৫টি পরিবার সেখানে বসবাস করে। চলতি বছরের ১১ জুলাই একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলটির রাজস্ব দফতর। সেখানে বলা হয়েছে, বিত্রায় সামাজিক প্রভাবের মূল্যায়ন করা হবে। সেই কাজ শেষ হলে সমগ্র দ্বীপটিকে তুলে দেওয়া হবে প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত সংস্থার হাতে। যদিও তার জন্য কোনও সুনির্দিষ্ট তারিখের উল্লেখ করা হয়নি।
লক্ষদ্বীপের বিত্রায় নৌসেনা ঘাঁটি তৈরি করার নেপথ্যে নয়াদিল্লির একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, দক্ষিণ-পশ্চিম পাকিস্তানের বালোচিস্তান প্রদেশে গ্বদর বন্দরে ধীরে ধীরে উপস্থিতি বাড়াচ্ছে চিনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ নৌসেনা। এ ছাড়া ‘আফ্রিকার সিং’ (পড়ুন হর্ন অফ আফ্রিকা) জিবুতিতে সামরিক ছাউনি রয়েছে বেজিঙের। ফলে পশ্চিম ভারতের উপকূলরেখার উপর কড়া নজর রাখার সুবিধা পাচ্ছে ড্রাগনের জলযোদ্ধার। এই পরিস্থিতিতে বিত্রায় ছাউনি তৈরি করে তাদের পাল্টা চাপে ফেলার কৌশল নিচ্ছে নয়াদিল্লি, মত বিশ্লেষকদের।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রে খবর, গত কয়েক বছরে আরব সাগর এলাকায় চিনা ‘গুপ্তচর’ জাহাজের বেড়েছে আনাগোনা। ২০০১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে অন্তত ১৪ বার ওই ধরনের জলযান নিয়ে পশ্চিম ভারতীয় উপকূলের কাছাকাছি এলাকায় ঘোরাঘুরি করতে দেখা গিয়েছে পিএলএ নৌসেনাকে। এতেই প্রমাদ গোনে নয়াদিল্লি। কারণ, আরব সাগরের গভীরে অপটিক্যাল কেব্লের জাল বিছিয়ে রেখেছে কেন্দ্র। এ ছাড়াও কিছু কিছু জায়গায় রয়েছে তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের পাইপলাইন। সেগুলিকে রক্ষা করতে প্রবাল দ্বীপে সামরিক ঘাঁটি তৈরির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
এ ছাড়া মাদক এবং হাতিয়ারের চোরাচালান বন্ধ করার জন্য আরব সাগরের বুকে দুর্ভেদ্য দুর্গ তৈরি করতে চাইছে ভারতীয় নৌসেনা। পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে সামুদ্রিক রাস্তা ধরে এগুলি এ দেশের মূল ভূখণ্ডে ঢুকিয়ে দেওয়ার অহরহ চেষ্টা চালায় পাচারকারীরা। এ ব্যাপারে বছরের পর বছর ধরে তাদের মদত জুগিয়ে যাচ্ছে ইসলামাবাদের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই (ইন্টার সার্ভিসেস ইনটেলিজেন্স)। পাশাপাশি, গুজরাট এবং মহারাষ্ট্রে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে রাশ টানতে লক্ষদ্বীপে সামরিক ছাউনি তৈরি একান্ত ভাবে দরকার বলে সুর চড়িয়েছেন সাবেক সেনাকর্তারা।
২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিগোষ্ঠী লশকর-ই-তৈবার হামলায় রক্তাক্ত হয় মহারাষ্ট্রের রাজধানী মুম্বই। ওই ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ছিল ১৭৪। আহত হন আরও ৩০০ জন। পরে হামলায় জড়িত ১০ সন্ত্রাসবাদীর ভারতে ঢোকার রাস্তার হদিস পান তদন্তকারীরা। জানা যায়, করাচি থেকে নৌকায় করে সমুদ্রপথে পশ্চিমের উপকূলে পৌঁছোয় তারা। এর পর একাধিক দলে ভাগ হয়ে নিশানা করে মুম্বই শহরের রেলস্টেশন ও হোটেলের মতো একাধিক জনবহুল এলাকাকে।
২৬/১১-র হামলার পর সামুদ্রিক সুরক্ষা এবং নজরদারি বাড়ানোর উপর আরও জোর দেয় কেন্দ্র। তখনই গভীর সমুদ্রে ছাউনি তৈরির পরামর্শ আসে নৌবাহিনীর থেকে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এর জন্য লক্ষদ্বীপের বিত্রাকে বেছে নেওয়ার নেপথ্যে আর একটি বড় কারণ হল পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে দ্রুত গতিতে নয়াদিল্লির বাণিজ্য বৃদ্ধি। খনিজ তেল-সহ বিভিন্ন পণ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ আমদানি-রফতানি বর্তমানে আরব সাগর দিয়ে করছে নয়াদিল্লি। সেগুলিকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্বও রয়েছে সরকারের উপরে।
সামুদ্রিক রাস্তায় ভারতকে ঘিরতে দীর্ঘ দিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে চিন। ড্রাগনের এই ষড়যন্ত্রকে ‘মুক্তোর সুতো’ (স্ট্রিং অফ পার্লস) বলে উল্লেখ করেছেন সাবেক সেনাকর্তারা। এর জন্য পাকিস্তানের গ্বদরের পাশাপাশি মায়ানমারের কিয়াউকফিউ এবং শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটায় কৌশলগত প্রভাব রয়েছে বেজিঙের। এই এলাকাগুলিকে প্রয়োজনমতো নৌঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করতে পারে লালফৌজ।
চিনের ‘মুক্তোর সুতো’ ষড়যন্ত্র টের পেতেই পাল্টা ‘হিরের হার’ নীতিতে (পড়ুন ডায়মন্ড নেকলেস পলিসি) বেজিঙের গলা পেঁচিয়ে ধরার নীলনকশা ছকে ফেলে নয়াদিল্লি। এ ব্যাপারে কেন্দ্রের কৌশলগত পদক্ষেপ হিসাবে প্রথমেই বলতে হবে ইরানের চাবাহার বন্দরের কথা। গ্বদর থেকে এর দূরত্ব মেরেকেটে ১৭০ কিলোমিটার। সাবেক পারস্য দেশের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে ওই সমুদ্রবন্দরটি তৈরি করেছে ভারত।
এ ছাড়া চাবাহারের পাশাপাশি ওমান, ইন্দোনেশিয়া, সেসেলস, মরিশাস এবং ভিয়েতনামে ধীরে ধীরে নৌঘাঁটি তৈরি করছে ভারত। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, এই পরিস্থিতিতে লক্ষদ্বীপে সামরিক ঘাঁটি তৈরি হয়ে গেলে বাড়তি অক্সিজেন পাবে এ দেশের নৌবাহিনী। কারণ কৌশলগত অবস্থানের কারণে বিত্রা থেকে চাবাহার হোক বা সেসেলস, যোগাযোগ রক্ষা করা বেশ সহজ। শুধু তা-ই নয়, এলাকাটিকে ভারত মহাসাগরীয় এলাকার ‘দুয়ার’ (গেটওয়ে) বলা যেতে পারে। ফলে বিত্রাকে ব্যবহার করে সেখানে চিনা প্রভাব কমাতে সক্ষম হবে দিল্লি, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
লক্ষদ্বীপের অদূরে রয়েছে ভারতের প্রতিবেশী দ্বীপরাষ্ট্র মলদ্বীপ। সম্প্রতি সেখানকার সরকারের সঙ্গে চিনের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর তাই দ্বীপদেশটিকে কেন্দ্র করে ভারতের দক্ষিণ উপকূলে নজরদারি চালানোর সুযোগ পেয়ে গিয়েছে বেজিং। এর জেরে মলদ্বীপের ঠিক উল্টো দিকে থাকা লক্ষদ্বীপকে শক্তিশালী করা অত্যন্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বলে মনে করছে নয়াদিল্লি।
এ দেশের সেরা পর্যটন কেন্দ্রগুলির তালিকায় আগামী দিনে শীর্ষস্থান পেতে পারে লক্ষদ্বীপ। এর জন্য ৮৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে কেন্দ্র। আদাতি এবং মিনিকয়তে তৈরি হচ্ছে বিমানবন্দর। সুহেলি এবং চেরিয়াম দ্বীপে পৃথক দু’টি নৌসেনাছাউনি তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে গত কয়েক বছরে আরব সাগরের দিক থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা। বিত্রাকে ব্যবহার করে সেগুলির চরিত্র আগাম বুঝে নিতে চাইছে কেন্দ্র।
তবে প্রবাল দ্বীপে নৌসেনা ঘাঁটি তৈরি করা মোটেই সহজ নয়। কারণ, সমুদ্রের জলরাশি থেকে মাত্র এক থেকে দু’মিটার উঁচুতে রয়েছে গোটা লক্ষদ্বীপ অঞ্চল। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বাধার মুখে পড়তে পারে কেন্দ্র। ইতিমধ্যেই লক্ষদ্বীপের কংগ্রেস সাংসদ হামদুল্লা সইদ দাবি করেছেন, এলাকার শান্তি বিঘ্নিত করার জন্য এই পদক্ষেপ করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকেরা অবশ্য বলছেন, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হওয়ায় এই বাধা সহজেই টপকাতে পারবে কেন্দ্র। আইন অনুযায়ী, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ওই এলাকার জমি অধিগ্রহণে নৌবাহিনীর কারও অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। যদিও তার আগে এর ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিকগুলি চিহ্নিত করতে চাইছে সরকার। জনসংখ্যা কম হওয়ায় সেখানকার বাসিন্দাদের পুনর্বাসন দেওয়া একেবারেই কঠিন হবে না।
দক্ষিণ চিন সাগর এবং পূর্ব চিন সাগরে একাধিক কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করে সেখানে নৌঘাঁটি তৈরি করেছে চিন। লক্ষদ্বীপের ক্ষেত্রেও সেই রাস্তা নিতে পারে ভারত। এ ক্ষেত্রে কৃত্রিম ভাবে দ্বীপগুলিকে উঁচু করার রাস্তায় হাঁটার সুযোগ রয়েছে নয়াদিল্লির। তাতে কম খরচে দ্রুত নৌসেনা ঘাঁটি তৈরি করে ফেলতে পারবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। উল্লেখ্য, এ দেশের উপকূলরেখা প্রায় সাড়ে সাত হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ হওয়া সত্ত্বেও নৌঘাঁটি রয়েছে মাত্র ১০টি। আগামী দিনে নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে এই সংখ্যা বাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠেছে কেন্দ্র।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এই ধরনের দ্বীপকে সামরিক ছাউনি হিসাবে ব্যবহার করার সুফল গোটা দুনিয়াকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় জাপান। ১৯৪১ সালে টোকিয়োর আক্রমণে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের মার্কিন নৌঘাঁটি পার্ল হারবার ধ্বংস হলে টনক নড়ে আমেরিকার। পরবর্তী কালে ওই এলাকায় ফের ঘাঁটি তৈরি করে ওয়াশিংটন। বর্তমানে সেখান থেকে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় নজরদারি চালায় যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া গুয়াম এবং দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপেও সেনাছাউনি রয়েছে মার্কিন নৌবাহিনীর।
ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দুই দ্বীপরাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার মাঝে আছে সরু একফালি সামুদ্রিক রাস্তা। নাম মলাক্কা প্রণালী। বেজিঙের সমুদ্র বাণিজ্যের সিংহভাগই ওই পথ গিয়ে চলাচল করে। আন্দামান-নিকোবরকে ব্যবহার করে প্রয়োজনে তা যে কোনও সময়ে বন্ধ করতে পারে ভারত। এ বার লক্ষদ্বীপে নৌঘাঁটি তৈরি করে ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় ড্রাগনের ‘দৌরাত্ম্য’ পুরোপুরি বন্ধ করতে পারবে ভারত? উঠছে প্রশ্ন।
সব ছবি: সংগৃহীত।