ইরান-ইজ়রায়েল সংঘাতে ক্রমশ তীব্র হচ্ছে ‘ক্রুসেড’ বা ধর্মযুদ্ধের আশঙ্কা! আরব দুনিয়ায় লড়াই ছড়িয়ে পড়তেই ধীরে ধীরে এককাট্টা হতে দেখা গিয়েছে সেখানকার একাধিক মুসলিম দেশকে। সেই আগুনে হাত সেঁকতে মরিয়া পাকিস্তান। এর জন্য ধর্মীয় তাস খেলে তেহরানকে খোলাখুলি ভাবে সমর্থনের ইঙ্গিত দিয়েছে ইসলামাবাদ। পাল্টা পূর্বের প্রতিবেশীটিকে সামনে রেখে পরমাণু হামলার হুমকি এসেছে সাবেক পারস্য দেশ থেকে। এতে লড়াইয়ের আগুনে আরও ঘি পড়ল বলেই মনে করছেন দুনিয়ার তাবড় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
সম্প্রতি ইহুদি ও শিয়াদের যুদ্ধকে নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন পাক সাংসদ আসাদ কায়সার। ইসলামাবাদের পার্লামেন্ট তথা ‘ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’তে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘‘ইরানের মতো আগামী দিনে আমাদেরও নিশানা করতে পারে ইজ়রায়েল। আর তাই দেশের আমজনতা থেকে শুরু করে সরকার, যতটা সম্ভব সবটুকু নিয়ে তেহরানের পাশে দাঁড়াতে হবে।’’ পাক পার্লামেন্টে দেওয়া তাঁর এই ভাষণ কিছু ক্ষণের মধ্যেই সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়।
ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইরানকে সমর্থনের কারণ অবশ্য স্পষ্ট করেছেন ‘ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’র সাবেক স্পিকার আসাদ। এ ব্যাপারে ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর প্রসঙ্গ টানেন তিনি। তাঁর যুক্তি, ‘‘ইহুদিদের তৈরি ড্রোন দিয়ে পাকিস্তানের উপর হামলা চালিয়েছিল নয়াদিল্লি। কোনও ভাবেই সেগুলিকে আটকানো যায়নি।’’ আর সেই কারণে দেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ‘ইসলামিক ভ্রাতৃত্ববোধের’ উপর জোর দেওয়ার দাবি তুলেছেন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ বা পিটিআইয়ের সাংসদ।
তবে ‘ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’তে আসাদের ওই ভাষণের আগেই ইরানকে সমর্থনের বিষয়টি স্পষ্ট করে দেন পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী খোয়াজা আসিফ। গত ১৪ জুন পশ্চিম এশিয়ার সংঘর্ষ নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেন তিনি। সেখানে আসিফ বলেন, ‘‘এই কঠিন সময়ে আমরা সর্বতোভাবে ইরানের পাশে আছি। তেহরানের স্বার্থ আমাদের রক্ষা করতেই হবে। কারণ, তারা আমাদের ভাই। তাদের দুঃখ-বেদনা ভাগ করে নেওয়া আমাদের কর্তব্য।’’
পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রীর অভিযোগ, ইজ়রায়েল শুধুমাত্র ইরানকে নিশানা করছে, এমনটা নয়। ইয়েমেন, লেবানন এবং প্যালেস্টাইনকে ধ্বংস করার পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের। সেই কারণে বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসলামিক দুনিয়ার ঐক্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আসিফ বলেন, ‘‘আজ যদি সকলে নীরব থাকি, তা হলে এক এক করে সবাইকে নিশানা করবে ইহুদিরা। আর তাঁদের শেষ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে পাকিস্তান।’’
পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সাংসদের এ-হেন মন্তব্যের পর যথেষ্টই উচ্ছ্বসিত ইরান। এই ইস্যুতে সরকারি নিউজ় চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিষয়টি স্পষ্ট করেন তেহরানের আধা সেনা ‘ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোর’ বা আইআরজিসির কমান্ডার ও জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য সিনিয়র জেনারেল মোহসেন রেজ়াই। তিনি বলেন, ‘‘ইসলামাবাদ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যদি ইজ়রায়েল আমাদের উপর পারমাণবিক বোমা ফেলে, তা হলে তারাও পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে ইহুদিভূমিতে আক্রমণ শানাবে।’’
শিয়া ফৌজের কমান্ডারের ওই মন্তব্যের পর দুনিয়া জুড়ে হইচই শুরু হয়ে যায়। ফলে আন্তর্জাতিক ভাবে চাপের মুখে পড়ে ইসলামাবাদ। এর পর তেহরানের ওই দাবি খারিজ করে দেন পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী। তবে সরকারি ভাবে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি শাহবাজ় শরিফ সরকার। সেখানকার বিদেশমন্ত্রী ইশাক দার ইরানের উপর ইজ়রায়েলি হামলার তীব্র নিন্দা করেছেন।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, ইজ়রায়েলকে নিয়ে পাকিস্তানের ভয় নেহাত অমূলক নয়। কারণ সন্ত্রাসবাদকে মদত দেওয়া কোনও ইসলামীয় দেশের কাছে পরমাণু অস্ত্র থাকুক, তা একেবারেই চায় না ইহুদি সরকার। কয়েক বছর আগে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে এ ব্যাপারে খোলাখুলি ভাবে তাঁদের আপত্তির কথা জানান ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। সেই সাক্ষাৎকারের ভিডিয়োও সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়।
সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে নেতানিয়াহু বলেন, ‘‘আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য হল ইরান। তার পর অবশ্যই পাকিস্তানের কথা বলতে হবে। তালিবানের মতো কোনও কট্টরপন্থী দল ওই দেশের ক্ষমতা দখল করলে পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ। আমরা কখনওই সেই ঝুঁকি নিতে পারি না। তখন ইসলামাবাদকে নিশানা করা ছাড়া আমাদের হাতে দ্বিতীয় কোনও রাস্তা থাকবে না।’’
ইজ়রায়েল-ইরান সম্পর্ক যেমন সাপে নেউলে, ভারত-পাকিস্তানও ঠিক তাই। ইসলামাবাদ যাতে পরমাণু শক্তিধর হয়ে উঠতে না পারে, গত শতাব্দীতে সেই পরিকল্পনা করেও ফেলে ইহুদি সরকার। এ ব্যাপারে নয়াদিল্লির পূর্ণ সমর্থন পেয়েছিল তেল আভিভ। কিন্তু, তার পরও নানা কারণে পাকিস্তানের পরমাণু কর্মসূচি বিনষ্ট করতে সক্ষম হয়নি ইজ়রায়েল এবং ভারত।
১৯৮০-র দশকে ইসলামাবাদ দ্রুত গতিতে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দিকে এগোতে থাকে। পাক সেনার সদর দফতর রাওয়ালপিন্ডি সংলগ্ন কাহুতায় এই সংক্রান্ত গবেষণা চালাচ্ছিলেন সে দেশের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। যদিও বিশ্লেষকদের বড় অংশই মনে করেন চিন এবং উত্তর কোরিয়া থেকে প্রযুক্তি চুরি করে আণবিক বোমা তৈরি করেছেন তাঁরা।
১৯৭১ সালের যুদ্ধে ভারতের হাতে পুরোপুরি পর্যুদস্ত হওয়ার পর পরমাণু হাতিয়ার নির্মাণে মনোনিবেশ করে পাক সরকার। ওই সময় এ ব্যাপারে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী তথা পাকিস্তান পিপল্স পার্টির (পিপিপি) প্রতিষ্ঠাতা জুলফিকর আলি ভুট্টো। তিনি বলেন, ‘‘প্রয়োজনে সবাই ঘাসপাতা খেয়ে থাকবে, কিন্তু আমাদের আণবিক বোমা চাই।’’
সাবেক পাক প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর ওই মন্তব্যের পর প্রমাদ গোনে নয়াদিল্লি। ইসলামাবাদের পরিকল্পনা জানতে কোমর বেঁধে নেমে পড়ে ভারতের গুপ্তচর সংস্থা ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং’ বা র। কাহুতায় কর্মরত প্রতিরক্ষা গবেষকদের চুলের নমুনা সংগ্রহ করেন তাঁরা। রাসায়নিক পরীক্ষায় তাতে ভারী মাত্রায় ইউরেনিয়ামের অস্তিত্ব মেলে। ফলে দু’য়ে দু’য়ে চার করতে ভারতীয় গুপ্তচরদের খুব একটা সমস্যা হয়নি।
পাকিস্তানের পরমাণু হাতিয়ার তৈরির বিষয়টি ভাল চোখে দেখেনি ইজ়রায়েলও। কারণ ইহুদিভূমিকে মান্যতা দিতেই রাজি নয় ইসলামাবাদ। শুধু তা-ই নয়, প্যালেস্টাইনের প্রবল সমর্থক রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা তেল আভিভকে শত্রু বলে মনে করেন। ফলে গাছ বড় হওয়ার আগেই তা কেটে ফেলার নীল নকশা ছকে ফেলে গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ।
১৯৮১ সালে ইরাকের ওসিরাক পারমাণবিক প্রতিষ্ঠান উড়িয়ে দেয় ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ)। ইহুদি বায়ুসেনার বিমানহানায় ধ্বংস হয় বাগদাদের আণবিক চুল্লি। আইডিএফ এই আক্রমণের নামকরণ করে ‘অপারেশন ব্যাবিলন’। ঠিক একই কায়দায় পাকিস্তানের কাহুতার পারমাণবিক গবেষণাকেন্দ্রটিকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল ইহুদি গুপ্তচরদের।
ওই সময় আনুষ্ঠানিক ভাবে ইজ়রায়েলের সঙ্গে ভারতের কোনও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু, বিভিন্ন ইস্যুতে নয়াদিল্লি এবং তেল আভিভের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। সূত্রের খবর, কাহুতা ধ্বংসের পরিকল্পনায় প্রাথমিক ভাবে সবুজ সঙ্কেত দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ফলে ভারতীয় ফৌজ এবং গুপ্তচরদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা শুরু করেন আইডিএফের সেনাকর্তারা।
ওয়াশিংটন পোস্ট এবং এবিসি নিউজ়ের প্রতিবেদনে ভারত ও ইজ়রায়েলের যৌথ উদ্যোগে পাক পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংসের পরিকল্পনা ফাঁস হয়। এই দুই সংবাদমাধ্যমের দাবি, ঝুঁকিপূর্ণ এই অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এফ-১৫ এবং এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ব্যবহারের কথা ছিল আইডিএফের।
পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমগুলির দাবি, ইজ়রায়েলি লড়াকু জেটগুলির গুজরাতের জামনগরের বায়ুসেনা ঘাঁটি থেকে ওড়ার কথা ছিল। তবে সেখান থেকে সীমান্ত পেরিয়ে কাহুতায় হামলা চালাত না তারা। উল্টে সোজা কাশ্মীর উড়ে গিয়ে নিয়ন্ত্রণরেখা (পড়ুন লাইন অফ কন্ট্রোল বা এলওসি) পেরিয়ে রাওয়ালপিন্ডির দিকে যাওয়ার কথা ছিল তাদের।
সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৮৪ সালের মার্চে এই অভিযানের চূড়ান্ত ছাড়পত্র দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ইজ়রায়েলের কুর্সিতে তখন ইৎজ়্যাক শামির। সূত্রের খবর, বিষয়টি নিয়ে একাধিক বার নয়াদিল্লির সঙ্গে কথা বলেন তিনি। তবে ইন্দিরার সঙ্গে সরাসরি এ ব্যাপারে তাঁর আলোচনা হয়েছিল কি না, তা স্পষ্ট নয়।
কাহুতা ধ্বংসের পরিকল্পনা যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখনই বাদ সাধে আমেরিকা। পাকিস্তানের কাছে সব কিছু ফাঁস করে দেয় মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ। ফলে এ ব্যাপারে আগাম সতর্কতা নিয়ে ফেলে ইসলামাবাদ। বাধ্য হয়ে হামলার পরিকল্পনা বাতিল করে ভারত ও ইজ়রায়েল। দু’টি দেশ অবশ্য সরকারি ভাবে কখনওই বিষয়টি স্বীকার করেনি।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, সময়ের চাকা ঘোরায় ফের এক বার সেই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পাকিস্তান খোলাখুলি ভাবে ইরানের পাশে দাঁড়ালে ইজ়রায়েলের পক্ষে চুপ করে থাকা একেবারেই সম্ভব নয়। অন্য দিকে পশ্চিম এশিয়ায় নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে হলে কখনওই ইহুদিদের বিরুদ্ধে যেতে পারবে না আমেরিকা। সেই সুযোগকে কাজে লাগাতে পারে ভারতীয় গুপ্তচরেরা। যুদ্ধের জেরে পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায় সেটাই এখন দেখার।
সব ছবি: সংগৃহীত।