৪ ডিসেম্বর দু’দিনের জন্য ভারত সফরে এসেছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। কূটনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই সফরে পুতিনের মতো হেভিওয়েট রাষ্ট্রনেতার রাত্রিযাপনের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল রাজধানীর অন্যতম এক অভিজাত হোটেলকে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তাঁকে স্বাগত জানাতে দিল্লির পালমে ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হাজির ছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
করমর্দন এবং সৌজন্য বিনিময়ের পরে একই গাড়িতে সওয়ার হন দুই রাষ্ট্রনেতা। রাতে প্রধানমন্ত্রীর ৭ লোককল্যাণ মার্গের বাসভবনে পুতিন তাঁর সম্মানে আয়োজিত নৈশভোজে যোগ দেন। গার্ড অফ অনার, রাষ্ট্রপতি ভবনে নৈশভোজ থেকে কাশ্মীরি জাফরান উপহার। দু’দিনের সফরে আসা রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের খাতির-যত্নে কমতি রাখেনি নরেন্দ্র মোদী সরকার।
বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক বা হোমরাচোমরা কোনও রাষ্ট্রনেতা ভারতসফরে এলে সাধারণত আইটিসি মৌর্য হোটেলই বুক করা হয়ে থাকে। এই হোটেলের একটি বিশেষ স্যুট বরাদ্দ থাকে রাষ্ট্রনেতাদের জন্য। ভারতসফরে এসে দিল্লির আইটিসি মৌর্য হোটেলে উঠেছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। থেকেছেন প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও। পুতিনের ক্ষেত্রেও সেই নিয়মের ব্যত্যয় হয়নি।
নয়াদিল্লির চাণক্যপুরীতে অবস্থিত আইটিসি মৌর্য গত ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে। নয়াদিল্লিতে বিলাসবহুল হোটেলের মানদণ্ড হিসাবে ধরা হয়ে থাকে এটিকে। হোটেলে মোট ৪১১টি কক্ষ রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে ২৬টি স্যুট, পাশাপাশি ৯টি রেস্তরাঁ এবং ৫টি ব্যাঙ্কোয়েট ও সভাকক্ষ।
রাজধানীতে আসা বিদেশি অতিথিদের প্রথম পছন্দ এই হোটেলটি। রুশ প্রেসিডেন্টের আপ্যায়নের দায়িত্ব ছিল বিলাসবহুল হোটেলের সবচেয়ে ‘এক্সক্লুসিভ’ প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুট— চাণক্য স্যুট। মস্কোর সর্বময় কর্তাকে স্বাগত জানানোর জন্য নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলা হয়েছিল হোটেলের চৌহদ্দি। পুতিনের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মীদের চোখ এড়িয়ে মাছি গলার উপায় ছিল না।
রাশিয়ার সর্বাধিনায়কের নিরাপত্তা নিয়ে কোনও ঝুঁকি নিতে চাননি নিয়োজিত নিরাপত্তাকর্মীরা। হোটেলের সমস্ত কক্ষই বুক করে নেওয়া হয়। করিডরগুলিকে নিরাপত্তার বজ্র আঁটুনিতে বেঁধে ফেলা হয়। হোটেলর বাইরে মোতায়েন ছিলেন ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যেরা।
৪,৬০০-৪,৭০০ বর্গফুট আয়তনের এই স্যুটের এক রাতের ভাড়া ৮ থেকে ১০ লক্ষ টাকা। বিলাসবহুল প্রধান শয়নকক্ষ ছাড়াও রয়েছে ব্যক্তিগত স্টিম সনা এবং জিমের বন্দোবস্ত। অতিথি আপ্যায়নের জন্য স্বতন্ত্র স্যুট, বিশাল রিসেপশন এলাকা। ১২ জন অতিথি আপ্যায়নের জন্য আলাদা একটি ডাইনিং রুমও রয়েছে। রয়েছে স্টাডি রুম।
রাজকীয় এই স্যুটের সূক্ষ্ম অন্দরসজ্জা চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো। বিখ্যাত শিল্পী তৈয়ব মেহতার শিল্পকর্ম দিয়ে সজ্জিত এই স্যুট। ঐতিহ্যবাহী নকশার সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটিয়ে তৈরি হয়েছে স্যুটের বাহারি সজ্জা। রয়েছে সিল্ক প্যানেলের দেওয়াল, পালিশ করা কাঠের মেঝে। স্যুটটি এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে সফররত রাষ্ট্রপ্রধানদের একটি রাজকীয় ও আরামদায়ক আতিথেয়তা প্রদান করা যায়।
মৌর্য সাম্রাজ্যের মন্ত্রী এবং কূটনীতিক, চিন্তাবিদ চাণক্যের নামে নামকরণ করা ভিভিআইপি স্যুটটির ঐশ্বর্য তাকলাগানো। স্যুটে রয়েছে অনন্য সব শিল্পকর্মের সংগ্রহ। স্যুটে বসবাসকারী অতিথিদের খাবারের জন্য রাখা থাকে বিশেষ কাচ ও রুপোর তৈজসপত্রের সম্ভার। অধিকাংশই বিদেশ থেকে আনানো নামীদামি ব্র্যান্ডের।
দিল্লির সর্দার পটেল মার্গে অবস্থিত এই হোটেলে বসানো হয়েছে শক্তিশালী বায়ুশোধন যন্ত্র, যা দিল্লির ধুলোবালি ও বিষকণা ছেঁকে বাতাসকে একেবারে তরতাজা করে তোলে। দিল্লির বাতাসের গুণমানের কথা চিন্তা করেই পুতিনের জন্য এই আয়োজন। দিল্লির বাতাসের বিপজ্জনক মান নিয়ে শহরবাসীই বিড়ম্বনায়। পুতিনের স্বাস্থ্য নিয়ে তাই কোনও ঝুঁকি নিতে চায়নি সরকার।
আইটিসি মৌর্যে রয়েছে কয়েকটি বিশেষ রেস্তরাঁ। সেখানে ভারতীয় নানা পদ চেখে দেখার সুযোগ থাকে বিদেশি অভ্যাগতদের। এর মধ্যে একটি বুখারা, যা উত্তর ভারতীয় খাবারের জন্য প্রসিদ্ধ। অন্যটি অবর্তনা, যেখানে দক্ষিণ ভারতীয় খাবার পরিবেশন করা হয়।
পুতিনের থাকার ব্যবস্থা মৌর্যতে করা হলেও তাঁর সঙ্গে আসা রুশ প্রতিনিধিদল ছিলেন পাশের তাজ প্যালেসে। বিদেশি অতিথিদের আগমনে তাজ প্যালেস, তাজমহল, ওবেরয়, লীলা এবং মৌর্য-সহ মধ্য দিল্লির সব শীর্ষস্থানীয় বিলাসবহুল হোটেলের সর্বত্র ‘ঠাঁই নাই’ অবস্থা তৈরি হয় গত সপ্তাহে। ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত হোটেলগুলির গড় ভাড়া ছিল ৫০,০০০-৮০,০০০ টাকার মধ্যে। বৃহস্পতিবার থেকে সেই ভাড়া ৮৫,০০০ থেকে ১.৩ লক্ষ টাকায় পৌঁছে যায় বলে জানান এক হোটেলের কর্মকর্তা।
৫ ডিসেম্বর দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে রুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক সারেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। রাষ্ট্রপতি ভবনে শুক্রবার নৈশভোজের আয়োজন করা হয়েছিল পুতিনের সম্মানে। নিরামিষ খাবারের এলাহি আয়োজন করা হয়েছিল। পাতে পড়েছিল ঝোল মোমো থেকে শুরু করে পনির রোল, নানা ধরনের কবাব। নৈশভোজে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু এবং কেন্দ্রের শীর্ষ আধিকারিকেরা।
পুতিনের সম্মানে রাষ্ট্রপতি ভবনে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। ভারতীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি সেখানে ছিল রাশিয়ান মেলোডি। শুক্রবার রাতে দিল্লি থেকে মস্কো ফেরার বিমান ধরেন পুতিন। তাঁকে বিদায় জানাতে বিমানবন্দরে হাজির ছিলেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।
সব ছবি: সংগৃহীত।