রক্ষণশীল সৌদি আরবে প্রকাশ্যে শুরু হল সুরা বিক্রি। সে দেশে বসবাসকারী অমুসলিম বিদেশি বাসিন্দাদের জন্য মদ্যপানের ছাড়পত্র দিয়েছে রিয়াধ। মদের গ্লাসে চুমুক দেওয়ার জন্য অবশ্য শর্ত আরোপ করেছে সৌদি প্রশাসন।
মোটা বেতনের চাকরি হলে তবেই মদ খাওয়ার অনুমতি মিলবে। মদ কেনার জন্য মাসিক বেতন হতে হবে ৫০ হাজার রিয়াল বা ১৩ হাজার ৩০০ ডলার। অর্থাৎ, ভারতীয় মুদ্রায় ১২ লক্ষ টাকার বেশি রোজগার হলে মদ্যপানের যোগ্যতা অর্জন করবেন বিদেশিরা।
সৌদি আরবে মূলত সুন্নি মুসলমান সম্প্রদায়ের বাস। সে দেশের রাজপরিবার দেশে রক্ষণশীল ইসলামিক আইন বহাল রাখার পক্ষপাতী। দেশের প্রাচীন ঐতিহ্য এবং মূল্যবোধ রক্ষা করার জন্য প্রকাশ্যে তো বটেই, গোপনেও মদ বিক্রি নিষিদ্ধ ছিল মক্কার দেশে।
বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৌদি কর্তৃপক্ষের সুরা বিক্রি সম্প্রসারণের উদ্দেশ্য স্পষ্ট। ২০৩৪ সালে ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য রাজস্ব বৃদ্ধিই এই সিদ্ধান্তের অন্যতম কারণ। ব্যবসা এবং পর্যটনে জোয়ার আনতেই রাজপরিবার মদ্যপান বিরোধিতার কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসতে চাইছে। দেশের প্রাচীন ঐতিহ্য এবং মূল্যবোধ রক্ষা করার পাশাপাশি নিজেদের পর্যটনবান্ধব হিসাবেও তুলে ধরতে চাইছে পশ্চিম এশিয়ার এই দেশটি।
পর্যটন এবং তেল-বহির্ভূত রাজস্ব বৃদ্ধির চাপের মুখে পড়েছে পশ্চিম এশিয়ার দেশটি। রাজস্ব ঘাটতি পূরণ করতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ টানতে চায় সৌদি। তাই রাজস্ব বৃদ্ধিতেই কঠোর বিধিনিষেধ এ বার কিছুটা আলগা করতে চলেছে মুসলিম দেশটি।
ইতিমধ্যেই সে দেশের যুবরাজ মহম্মদ বিন সলমন বিদেশি পর্যটকদের টানতে ‘ভিশন ২০৩০’ পরিকল্পনার সূচনা করেছেন। বিদেশি বিনিয়োগে কোষাগার ভরার অঙ্ক মাথায় রেখেই রক্ষণশীলতার মুঠো কিছুটা আলগা করতে চাইছে সৌদি আরব, এমনটাই মত কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের।
তেলের সম্পদে বলীয়ান সৌদি আরবে আগামী বছরগুলিতে রাজস্ব ঘাটতি দেখা দিতে পারে। আশঙ্কা, বাজেট সঙ্কটে পড়তে পারে মরু দেশটি। তাই অপরিশোধিত তেলের ওপর নির্ভরতা কমানোর পদক্ষেপ হিসাবে এই শিথিলতা বলে মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
রিয়াধে অবস্থিত দেশের একমাত্র মদের দোকানে প্রবেশের জন্য বেতন বা আয়ের শংসাপত্র দেখাতে হবে বিত্তবান বিদেশিদের। তবেই মিলবে হুইস্কি, রাম, জিন, শ্যাম্পেন। ব্লুমবার্গের একটি পুরনো রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশের অন্য দু’টি শহর জেদ্দা এবং দাহরানে নতুন মদের দোকান তৈরি করার অনুমতি দিয়েছে সৌদি সরকার।
রাজধানীর কূটনৈতিক এলাকায় অবস্থিত দেশের একমাত্র মদের দোকানটি ৭০ বছরেরও বেশি সময় পর ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে খোলা হয়েছিল। তবে তা খোলা হয়েছিল শুধুমাত্র বিদেশি অমুসলমান কূটনীতিক, উদ্যোক্তা, বড় বিনিয়োগকারীদের মতো সমাজের অভিজাত অংশের জন্য।
ইসলাম ধর্মে যে কোনও ধরনের নেশাকেই ‘হারাম’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে অমুসলমান বহু মানুষই বসবাস করেন সেই দেশে। তাঁদের কথা মাথায় রেখেই দেশের রাজধানী রিয়াধে প্রথম মদের দোকান খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সৌদি যুবরাজ মহম্মদ বিন সলমন।
মদ কিনতে গেলে আগে সেই দেশের সরকার প্রদত্ত নির্দিষ্ট মোবাইল অ্যাপে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন বা নাম নথিভুক্ত করাতে হত বিদেশি অমুসলমানদের। এর পর পররাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে ছাড়পত্র সম্বলিত একটি কোড পাঠানো হত ওই নির্দিষ্ট মোবাইল অ্যাপে। সেই কোড পেলে তবেই নির্দিষ্ট পরিমাণ মদ কিনতে পারতেন অমুসলমান কূটনীতিক ও শিল্পপতিরা।
১৯৫২ সালে সৌদি আরবে রাজা আবদুল আজ়িজ়ের মদ্যপ পুত্র এক ব্রিটিশ কূটনীতিককে গুলি করে হত্যা করার পর মদ্যপানের উপর কঠোর আইন কার্যকর করা হয় সৌদিতে।
সৌদি আরবের মতো অতিরিক্ত রক্ষণশীল, মুসলমান অধ্যুষিত দেশে মদ খাওয়া অপরাধ। মদ্যপান রুখতে কঠোর আইনও রয়েছে। ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী কেউ মদ্যপান করলে তাঁকে কঠোর সাজা দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে উপসাগরীয় দেশটিতে।
১৯৫২ সাল থেকে সৌদি আরবে মদ নিষিদ্ধ। নতুন আইন চালু হওয়ার আগে বিদেশিরাও সেখানে মদ কিনতে বা খেতে পারতেন না। সৌদিতে কোনও বড় হোটেলেও মদ বিক্রি করা হয় না। ২০২৪ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের আগে আবগারি আইন শিথিল করা হয়েছিল।
২০৩৪ সালে ফুটবল বিশ্বকাপের আসর বসতে চলেছে সে দেশে। তার আগে বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করতে ধাপে ধাপে মদ্যপানের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে পারে সৌদি প্রশাসন। স্থির হয়েছে, ২০২৬ সালের মধ্যে পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় ৬০০টি জায়গায় ধাপে ধাপে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে।
সব ছবি: সংগৃহীত।